ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

সময়ের চপেটাঘাত

শফিক হাসান
🕐 ১০:৪২ পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ১৭, ২০২১

সময়ের চপেটাঘাত

উন্নয়ন, অগ্রগতি হচ্ছে ঠিকই, তাই বলে ক্ষুধা-দারিদ্র্য কখনই ছেড়ে কথা কয়নি! বৈশি^ক মহামারী করোনার আগেও মানবেতর জীবন ছিল অনেকের। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে এসেছে দুর্যোগ। বালাইয়ের অভিঘাতে মোটামুটি সচ্ছল যারা ছিল, অনেকেরই জীবনধারা পাল্টে গেছে আমূল। পরিবর্তিত জীবনধারায় অভিযোজন ঘটাতে বেগ পেতে হচ্ছে। কিন্তু সময়ের চপেটাঘাত না সয়ে উপায় নেই। অভিধানে আগামীতে যুক্ত হবে নতুন শব্দ- করোনাকাল। এর লণ্ডভণ্ড করার ক্ষমতা নিয়েও বর্তমানে যেমন আলোচনা হচ্ছে, ভবিষ্যতেও তাত্ত্বিকদের গবেষণার বিষয় হবে।

 

মানুষের জীবনযাপনকে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে অর্থনীতি। এখনকার অর্থনীতির মন্দাবস্থা নানাভাবেই বিপর্যস্ত করে তুলছে সাধারণ মানুষের জীবন। দুর্বিষহ হয়ে উঠছে টিকে থাকা। নিত্যদিনের চলাফেরায় এমন সব দৃশ্য রচিত হচ্ছে- না চমকে-থমকে উপায় নেই। মিরপুরের দুটি ফুটওভার ব্রিজে ভ্রাম্যমাণ যৌনকর্মীদের আনাগোনা দীর্ঘদিনের। করোনাকালে ভাসমানদের সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে হয়তো।

করোনাকালে ফুটওভার ব্রিজের নিচে এক মহিলাকে দেখে চমকে উঠলাম। সন্ধ্যা নেমেছে কিছুক্ষণ আগে। ফুটওভার ব্রিজকে ঘিরে নিজেদের মুখাবয়ব আবৃত্ত করে বিকাল থেকে শুরু হয় ভাসমানদের আনাগোনা। অপ্রত্যাশিতভাবে যে মহিলাকে দেখলাম, কেমন যেন পরিচিত মনে হলো। নিশ্চিত হওয়ার ঝুঁকিতে না গিয়ে দ্রুত সটকে পড়লাম। সত্যিই যদি ‘দেখা’ সত্য হয়, বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে। ক্ষমা করতে পারব না নিজেকে।

ডিজিটাল মেশিনে ওজন মাপা হয় দুই টাকায়। সহজে বহনযোগ্য এমন একটি মেশিন নিয়ে অনেকেই নানান জায়গায় ভ্রাম্যমাণ ব্যবসা চালায়। চলতি সপ্তাহে অন্তত দুবার এমন একটি মেশিন নজরে পড়ল। রাস্তার প্রায় মাঝখানে মেশিন সামনে রেখে লোকটি বসেছে। রিকশা, অটোরিকশা, প্রাইভেট কার, ট্রাক চলছে হরদম। লোকটা পাগল নাকি; যে কোনো সময় দুর্ঘটনায় ঘটে যেতে পারে, বুঝতে পারছে না কেন! পরে ভেবে বের করেছি কার্যকারণ। স্ট্রিট লাইটের আবছা আলোয় তাকে চোখে পড়ে না তেমন। লোকজন ফুটপাত দিয়ে, রাস্তার কাছা ঘেঁসে হেঁটে যায়। তাই সহজে মানুষের মনোযোগ কাড়তে বসেছে বিপদসীমার কাছাকাছি। এত ঝুঁকি নিয়ে ব্যবসার চেষ্টা, তবুও একবারের জন্যও চোখে পড়েনি কেউ ওজন মাপাতে এসেছে!

চায়ের স্টলে আয়েশ করে চায়ে চুমুক কিংবা লোকাল বাসের একচিলতে ফুরসতে নিরবচ্ছিন্নভাবে ফেসবুক গুতানোর সুযোগ নেই। চায়ের দোকানে নানা শ্রেণির মানুষ আসে নিজেদের অসহায়ত্বের কথা শুনিয়ে সাহায্য চায়। বাসে সাহায্যপ্রার্থী মানুষের অধিকাংশেরই স্বজন দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। একটা অংশ বিক্রি করে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী। এমন আর্তিও জানায়- একটি পণ্য বিক্রির মাধ্যমে স্থবির হতে চলা জীবনটাকে টেনে নিতে পারবে। সেদিন চায়ের স্টলে এসে দাঁড়ালেন বয়স্ক এক মহিলা। আবেদন জানালেন- ‘আমার কাপড় নাই। কিছু টাকা দেন, কাপড় কিনমু।’ দেখলাম, আদতেই কাপড় নেই। কীসের সঙ্গে কী জোড়া দিয়ে যে পরেছেন অনেক সময় নিয়ে খুঁজে বের করতে হবে। তবে অধিকাংশই চান রুটি কিংবা ভাত খাওয়ার টাকা, কারও চাহিদা থাকে সন্তানের দুধ কেনার।

বেদেনিরা আগে রাস্তায় গতি রোধ করে সাপের জন্য দুধ-কলা কেনার টাকা দাবি করত। এদের দেখা যাচ্ছে না অনেক দিন যাবৎ। নিজেদের জীবন-সংকট হয়ত বেকায়দায় পড়েছে। একপোয়া মরিচের দাম ভ্যানের বিক্রেতা হাঁকল দশ টাকা বেশি। দরে না মেলায় এগোলাম সামনে। সকালের অস্থায়ী বাজারে রাস্তার ওপর প্লাস্টিক বিছিয়ে বসেছেন মধ্যবয়সী এক লোক। একপাশে কাঁচামরিচ, অন্যপাশে ধনেপাতা। মরিচ দেবেন কিন্তু পাল্লা নেই। কার দোকান থেকে মেপে আনবেন, বুঝে উঠতে পারছেন না। বললাম, ‘দাঁড়িপাল্লা ছাড়া দোকানদারি করেন কীভাবে?’ পাশে দাঁড়ানো তার স্ত্রী জানালেন, স্বামী নতুন ব্যবসায়ী। চাকরি চলে যাওয়ার পর নতুন করে শুরু করেছেন ক্ষুদ্র ব্যবসা। তাই প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নেই।

রাস্তায় বের হলেই ছেঁকে ধরবে রিকশাওয়ালারা। সমস্বরে প্রশ্ন- কই যাইবেন! অ্যাপসভিত্তিক রাইডের কল্যাণে বেড়েছে মোটরসাইকেলে যাত্রী পরিবহনের নতুন সংস্কৃতি। এদের কারও সঙ্গে চোখাচোখি হলেই অবধারিতভাবে আহ্বান আসবেই। রিকশাচালক ও বাইকচালকদের নিরাশ না করে উপায় নেই। নিজেদের জীবনই যেখানে ঝুঁকির মুখে সেখানে এমন ‘বিলাসিতা’ কজন করে!

কথায় আছে, সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়। এখন চলছে সেই ‘ফোঁড়াফোঁড়ি’কাল। মারাত্মক সংকটে পড়েছে প্রায় সব পেশাজীবী। এককালের সম্মানজনক পেশা সাংবাদিকতাও অনেকটাই কোণঠাসা এখন। এই শ্রেণি সহজেই পেশা পাল্টাতে পারেন না কিংবা পেশার বাইরে গিয়ে বিকল্প কাজও অনেকের জন্য কঠিন। পরিচিত এক সাংবাদিক প্রতিশ্রুত বেতন পাননি বলে মুদি দোকানে গিয়ে জানালেন, বাকির টাকাটা পরিশোধ করতে আরেকটু দেরি হবে। দোকানির কালো মুখের সামনে থেকে তিনি বিদায় নেওয়ার পর উপস্থিত আরেক খদ্দের প্রশ্ন করলেন- ‘কে ইনি?’

দোকানদার মুখ ত্যাড়া-বাঁকা করে জবাব দিলেন ‘বাকী খায়’! টাকা দিতে পারে না- লোকটির এমন প্রশ্নের বলে দোকানি বলে দিলে মাথা নিচু করে চলে যায়? সাংবাদিক ভদ্রলোক শোনেননি ভাব করে পা চালালেন দ্রুত। আদতে করোনাই মানুষকে কথাখেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করছে। কথা রাখতে না পারার সংখ্যা ও শঙ্কা বাড়াচ্ছে। সংসারে বেড়েছে অশান্তি, শব্দদূষণের পরিমাণ। গিন্নিদের দিয়েছে তুলনার সুযোগ- অমুক-তমুক যদি ঠিকমতো সংসার চালাতে পারে তুমি পার না কেন? গৃহকর্তা, অসহায় চাকরিজীবী কিংবা সদ্য চাকরিহারা ব্যক্তিটি কি নীরবে ওয়াশরুমে গিয়ে অশ্রু বিসর্জন দেবেন? অশ্রুজল যদি অক্ষমতা ও গ্লানি ধুয়ে-মুছে দিত অনেকেই আগ্রহী হতেন।

এত যে গল্প বললাম সবই নিরাশার? নেতিবাচক মানসিকতার দৃষ্টান্ত! না, মানুষ অফুরন্ত সম্ভাবনার আধার। আত্মবিশ্বাসী মানুষ একসময় ঠিকই ঘুরে দাঁড়ায়, তার সম্ভাবনাবৃত্তান্ত হয়ে উঠতে পারে মোটিভেশনারল স্পিচ।

পাঁচতলা বাসার বারান্দা থেকে একদিন দেখা গেল নতুন একটি সাইনবোর্ড- হোটেল আপ্যায়ন। সকালে নাশতা খেতে গিয়ে পরিচিত হলাম। কিছুদিনের মধ্যে দোকানদার শোনাল তার ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প। বাবা মারা গেলেন হঠাৎ। মা সমুদয় সঞ্চয় সাত শ’ টাকা তুলে দিলেন কাউসারের হাতে। বললেন, ‘কিছু একটা কর। তোর ভাই-বোনদেরও বাঁচাতে হবে।’

কাউসার বলল, ‘মা, তুমি কি আমার সঙ্গে মশকরা করছ? ৭০০ টাকায় তো চাঁদপুরে (বাড়ি) যাওয়া-আসার খরচও হবে না।’

কাউসারের দুলাভাই দমলেন না। এই টাকায় কিনে আনলে হাঁড়ি-পাতিল। বাসায় থাকা চাল ও তরকারি রান্না হলো। মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনে বিআরটিসির বাসস্ট্যান্ডের পাশে দাঁড়িয়ে গেল অস্থায়ী হোটেল। কাউসারের ‘লাখপতি’ হতে বেশি দিন লাগেনি। প্রতিটি মানুষের ক্ষমতা আছে, নিজেকেও পারিপার্শ্বিক পাল্টে দেওয়ার। নিজস্ব শক্তিতেই নিশ্চয়ই আমরা ঘুরে দাঁড়াব একদিন। পরাজিত হবে বাধাবিঘ্ন, ফিরে যাবে ক্ষুধার করাঘাত!

লেখক : সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ


Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228
Electronic Paper