ফিরে যায় মাটির টানে
রবি রায়হান
🕐 ১১:৪২ পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ০৩, ২০২১
লাখ লাখ মানুষ কর্মসংস্থানের সন্ধানে ছুটে আসে এই রাজধানী ঢাকা শহরে। কেউ টিকতে পারে আবার কেউ ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায় আপন গ্রামের জন্ম ভিটায়। এই করোনায় কাজ হারিয়ে, আয়-রোজগার হারিয়ে গ্রামে ফেরা মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। গ্রামে আগের চেয়ে সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, যোগাযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি ও কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির কারণে ঢাকার নাগরিক সুবিধা থেকে দূরে থাকলেও কিছুটা স্বস্তির জীবন পেয়েছে কাজ হারানো এ সব মানুষ। অর্থ ও কর্ম ছাড়া এই আলো ঝলমলে শহরে টিকে থাকা অসম্ভব; একদিনও চলে না। কঠোর পরিশ্রম করে কেউ ভাগ্য বদলাতে পারে আবার কেউ সংসার চালাতে হাবুুডুবু খায়।
এক বুক স্বপ্ন নিয়ে ঢাকা শহরে এসেছিল মধ্যে একজন মাহবুব হোসেন, ব্যর্থ হয়ে সে ফিরতে বাধ্য হয় নিজ গ্রামে আপন ঠিকানায়। খুুবই নম্র ভদ্র অমায়িক মানুষ মাহবুব হোসেন রামপুরা মহানগর প্রজেক্টের একটি বাসাতে ভাড়া থাকতেন স্ত্রী ও ফুটফুটে তিনটি সন্তান নিয়ে। সুখী পরিবার ছিল তাদের। মাঝে মাঝে তার সঙ্গে কথা হতো, আলাপ হতো বিভিন্ন বিষয়ে। গত বছর হঠাৎ একদিন মন খারাপ করে কাছে এসে বিদায় চাইল। ঢাকা শহর ছেড়ে গ্রামের বাড়ি চলে যাচ্ছেন তিনি। শুনে তো অবাক।
ভদ্রলোক চীন থেকে ডাইস কেমিক্যাল সরবরাহকারী ব্যবসায়ী ছিলেন, গার্মেন্টস এর কাপড় রঙ করার কাঁচামাল আমদানি করতেন। করোনার প্রকোপ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গার্মেন্টস রপ্তানি কমে যায়। এর ফলে বাংলাদেশের ডাইং ফ্যাক্টরির কাজ প্রায় বন্ধ হয়ে পড়ে। এই কারণে ডাইস কেমিক্যালের চাহিদা কমে যায়। পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় মাহাবুবের ডাইস কেমিক্যাল আমদানি। এবং এক অনিশ্চিত ভবিষ্যত সামনে এসে হাজির হয়। কর্ম ছাড়া ঢাকা শহরে বাসা ভাড়া দিয়ে চলা এক অসাধ্য ব্যাপার। জমানো আয়ের বেশির ভাগ টাকা বাড়ি ভাড়ার পেছনে ব্যয় করতে হয়। সন্তানের লেখাপড়ার খরচও অধিক। করোনার দশ মাসে দিনে দিনে সঞ্চিত সব অর্থই শেষ হয়ে যায়। এরপর কোনো দিশা না পেয়ে বাধ্য হয়ে গ্রামের ভিটায় ফিরে যেতে হয়। খুব মন খারাপ করে সেদিন তাকে বিদায় দিতে হয়।
গ্রামের পথে রওনা হওয়ার সময় মাহবুব বলেন, এ মুহূর্তে ব্যবসা করার পরিস্থিতি আমার আর নেই। কবে শুরু করতে পারব তাও বলতে পারছি না। এ অবস্থায় উচ্চ খরচে ঢাকা শহরে আমার আর থাকা সম্ভব নয়। তাই বাড়ি যাচ্ছি। গ্রামে আগের অবস্থা থাকলে বাড়িতে থাকা খুব কষ্ট হতো। এখন গ্রামও উন্নত হয়েছে। রাস্তাঘাট হয়েছে, বিদ্যুৎ এসে গেছে, নেট-অনলাইন সুবিধা গেছে, মোবাইল ফোন সুবিধা আছে, কৃষি উৎপাদন বেড়েছে- এসব কারণে গ্রামে বসবাস খুব একটা সমস্যা হবে না। ছেলেমেয়ে প্রথম কিছুদিন সমস্যায় পড়লেও আস্তে আস্তে মানিয়ে নেবে। তারপর করোনা দূর হলে, বিশ্ব বদলালে আবার ঢাকাতে ফিরে আসব। বিপদের দিনে গ্রামের দিকেই যাচ্ছি।
২০২১ সালের প্রথম দিন ফোনে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাতে আরেক পরিচিত রাকিব এমন কথাই জানালেন। তার গ্রামের বাড়ি নাটোর চিনিকলের পাশের একটি গ্রামে। সেও করোনা আগ্রাসন শুরু হলে আগস্ট মাসে ঢাকা ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে পাড়ি জমায়। ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে তার চাকরি ছিল। করোনার কারণে তার চাকরিটি চলে যায়। বাড়িতে পৈতৃক চাষাবাদ থাকার কারণে গ্রামে সেখানে গিয়ে দাঁড়ায়। গ্রামে ঢাকার মতো উঁচু উঁচু বাড়ি না থাকলেও বিদ্যুতের আলো, ফোনে যোগাযোগ, ইন্টারনেটের মাধ্যমে দেশ-বিদেশের খবরাখবর জানার কোনো সমস্যা হচ্ছে না। কম আয়েই মিলছে প্রয়োজনীয় মোটা চাল। অন্যান্য নিত্যপণ্যের দামও নাগালের মধ্যে পাচ্ছে। ফলে সমস্যা হলেও সংকট হচ্ছে না। এভাবে বিপদের দিনে ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছে গ্রাম।
গ্রাম এখন আর আগের মতো নেই, যোগাযোগ ব্যবস্থার এতই উন্নতি ঘটেছে যে গ্রামে গ্রামে পিচঢালা বা ইটের পথ। বিদ্যুতের আলো, ইন্টারনেট কানেকশন, ডিস টিভি সব কিছুতেই শহরের সুযোগ-সুবিধা, ঘরে বসে পাওয়া যাচ্ছে। আগের পুরনো ব্যবসাও কেউ কেউ চালিয়ে যাচ্ছে প্রযুক্তির সুবিধা নিয়ে। প্রয়োজনে মাসে একবার ঢাকায় এসে জরুরি কাজ করে ফিরে যায়। নিজের বসত ভিটায় সুখের বাস। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া কিছু আবাদি জমি তাদের বিভিন্ন ধরনের চাষ করে প্রয়োজনে সবজি চাষ ও হাঁস মুরগি পাওয়া চাচ্ছে। নিজের চাহিদা মিটিয়ে ফড়িয়ার নিকট পাইকারি দরে বিক্রিও করে খুব ভালো আয় করছে অনেকে। এখন তার অনিশ্চয়তা কেটে স্বস্তির জীবন শুরু করেছে। সুখের নতুন আরেক আধার এখন পদ্মা সেতু। পদ্মার পারের দক্ষিণের অনেকের মনেই নতুন স্বপ্ন উঁকি দিচ্ছে পদ্মা সেতুকে ঘিরে।
সেতু চালু হলে যোগাযোগব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি হবে। এপার ওপারের দূরত্ব কমে আসবে। গড়ে উঠবে হাজারো কল কারখানা নানা ধরনের শিল্পপ্রতিষ্ঠান সহ গার্মেন্ট কারখানা। মানুষের কর্মসংস্থান বাড়বে, আয় উন্নতি বাড়লে সুখ শান্তি বাড়বে, উন্নত জীবন ব্যবস্থা হবে সকলের, তাই সকলে আগামীর সুখ স্বপ্নে বিভোর। এ সব কিছুই সম্ভব হয়েছে গ্রামীণ জনপদে অবকাঠামো প্রভূত উন্নতির কারণে। বিদ্যুতের সহজলভ্যতা, ইন্টারনেট সংযোগ, ডিস সংযোগ সহ শহরের মতো প্রায় সুযোগ-সুবিধা বিদ্যমান। সারা দেশটাকে এক সুতোয় বাঁধতে গ্রামের কাঠামো ঠিক রেখে শহরের সুযোগ-সুবিধা তৈরি করতে পারলে শহরের মানুষ অধিক সংখ্যক হারে গ্রামে ফিরে যাবে এতে কোনো সন্দেহ নাই। অথবা স্বপ্নের শহর থেকে ঢাকা ছাড়তে বাধ্য হলেও অভ্যাস আবার গ্রাম ছাড়তে বাধ্য করবে না। শহরের জনসংখ্যার চাপ কমবে, শহর বসবাসের যোগ্য হবে। বৈষম্য কমবে নগর ও গ্রামের মানুষের।
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228