ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

জেগেছে গ্রাম

জাফর আহমদ
🕐 ১১:৩৩ পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ০৩, ২০২১

জেগেছে গ্রাম

পাড়ার মধ্যে দোকান ছিল একটি। ওষুধের দোকান ছিল না। তবে ছিল না ইলেকট্রনিক পণ্য, কাপড়-চোপড় ও কাঁচাবাজার। এ চাহিদা পূরণের জন্য যেতে হয় প্রায় এক কিলোমিটার দূরে। দশ দোকান দেখে পছন্দসই পণ্যটি কিনতে চাইলে ১৫ কিলোমিটার দূরে শহর। আরও ভালো পণ্য কিনতে হলে জেলা শহরে যেতে হয়। তাই তো কয়েক মাসের মধ্যে এসব দোকান বসেছে। বিদ্যুৎ এসেছে দুই বছর আগে। এখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে দশ মিনিটের মধ্যে এসব পণ্য ও সেবা নিয়ে বাসায় ফেরা যাচ্ছে। দোকান থেকে একটু দূরে ইটের রাস্তা ছিল। দোকানের কাছে ইটের রাস্তা আনার জন্য তোড়জোড় শুরু হয়েছে।

এ চিত্র কুষ্টিয়ার দক্ষিণ ফিলিপনগর গ্রামের। বিদ্যুৎ, মোবাইল, ফোন ইন্টারনেট পাওয়ার অন্য চাহিদাগুলো পূরণে গ্রামের মানুষের মধ্যেই গরজ তৈরি হচ্ছে। স্থানীয় প্রতিনিধিরা মানুষের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে। স্থানীয় সামসুজ্জামান আঙ্গুর মেম্বার জানান, গ্রামটি তুলনামূলক নতুন। এখানকার প্রায় প্রতিটি বাড়ির মানুষ কর্মঠ। এই যে চাহিদা বেড়েছে এর মূলে রয়েছে এ সব কর্মঠ মানুষ। এ গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে একজন করে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কর্মরত আছে। মাস শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামে অর্থ চলে আসছে। এক্ষেত্রে মোবাইল ব্যাংকিং সবকিছু সহজ করে দিয়েছে। এছাড়া যারা বাড়িতে থাকে তারাও কৃষিকাজ, খামার, ব্যবসা-বাণিজ্য, গরু-ছাগল মোটা-তাজাকরণ, বিড়ি কারখানায় কাজ করাসহ বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত আছে। এ সব মানুষের চাহিদা মেটাতে এসব দোকান, সড়ক পাকাকরণ হচ্ছে।

খোলা কাগজের পত্নীতলা (নওগাঁ) উপজেলা প্রতিনিধি মাসুদ রানা একই খবর দিচ্ছেন। ধানের জেলার পত্নীতলা উপজেলার গ্রামগুলোতে শহরের অনেকগুলো সুবিধা তৈরি হয়েছে। পাঁচ বছর আগে এখানে যে সুবিধা ছিল না, এখন সেগুলো পাচ্ছে। ধানের উৎপাদন বেশি হচ্ছে। ধান চাষ ব্যবস্থা যন্ত্রায়ন হওয়ার কারণে এখানে ধানচাষের আধুনিক উপকরণের বাজার সৃষ্টি হয়েছে। রাস্তাঘাট তৈরি হয়েছে। মেডিকেল প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, সংস্কৃতিচর্চার জন্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ভবন, মুক্তিযোদ্ধা ভবন সহবিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার কারণে সঙ্গে সঙ্গে জীবনচর্চারও বৈচিত্র্য এনেছে। আগে থেকেই বিদ্যুৎ ছিল এখানে এসব গ্রামে। সময় বদলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট সুবিধা বেড়েছে। ই-সেবার পরিধি বেড়েছে। উপজেলার যে সব ইউনিয়নের বাজার ও অর্থনৈতিক গ্রোথ সেন্টারগুলো আছে, বেশি টাকা দিয়ে হলেও সেবা নিচ্ছে। মানুষের আয় রোজগার বেড়ে যাওয়ার কারণে নতুন নতুন বিপণন কেন্দ্র গড়ে উঠছে। এখানে নতুন নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে। যোগাযোগ সুবিধা বৃদ্ধির কারণে সবচেয়ে বেশি সুবিধা হয়েছে আশপাশের উপজেলাগুলোর সঙ্গে সংযোগের ক্ষেত্রে। স্বাস্থ্য সুবিধাতে যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে। কোনো জটিল রোগ ছাড়া রাজশাহী বা ঢাকা যাওয়ার প্রয়োজন হচ্ছে না।

পল্লী অঞ্চলে জীবনযাত্রার মান উন্নত হওয়ার কারণে আর্থিক লেনদেনও হাতের নাগালের মধ্যে এসে গেছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রগুলোতে ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হলেও তুলনামূলক ছোট্ট লেনদেনের স্থানগুলোতে উপশাখা, এজেন্ট ব্যাংকিং ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন হচ্ছে। এতে আর্থিক খাতও কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে। সুবিধা দিচ্ছে ঢাকার মতোই।

পল্লী অঞ্চলে লেনদেনের ক্ষেত্রে কৃষিঋণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বছরে প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকার কৃষিঋণ বিতরণ হচ্ছে। যা পল্লী অঞ্চলে যাচ্ছে। কৃষিতে দেওয়া নানা রকম ভর্তুকিও যাচ্ছে পল্লী অঞ্চলে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বিভিন্ন রকম কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। পল্লী অঞ্চলে অবকাঠামো নির্মাণে গ্রামের সামগ্রিক উন্নয়নের কর্মসূচির বিষয়টি প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করা হচ্ছে। ফলে গ্রামেই উন্নয়নের কেন্দ্রভূমিতে পরিণত হচ্ছে।

এ চিত্র এখন সারা দেশের গ্রামের। ঢাকার উপরে মানুষের চাপ কমাতে বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে, গ্রামে শহরের সুবিধা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। বাজেটে বরাদ্দ বাড়িয়েছে। গ্রামীণ অবকাঠামো তৈরি, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির পরিধি বৃদ্ধি, পল্লী অঞ্চলে ঋণ দেওয়ার জন্য ব্যাংকগুলোকে বিশেষ নির্দেশনাসহ সরকারের নানা কর্মসূচি চলছে। কৃষি, স্বাস্থ্যসহ সরকারের নানা রকম কার্যক্রম চলছে। এর ফলে যেমন আয়-রোজগার বেড়েছে। তেমনি বেড়েছে ক্রয়ক্ষমতা। আর এই চাহিদা বৃদ্ধির ফলে গ্রামেই বিপণী কেন্দ্র গড়ে উঠছে। গ্রামের মানুষের জীবনে এসেছে ইতিবাচক পরিবর্তন।

নগর ও গ্রামের বৈষম্য ক্রমাগতভাবে দূর করার মাধ্যমে মানুষের রাষ্ট্রীয় সুবিধা নিশ্চিত করতে সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি রয়েছে। ১৯৭২-এর সংবিধানে বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়েছে। পল্লী ও শহরের মানুষের বৈষম্য দূর করার উদ্দেশ্যে কৃষি বিপ্লবের বিকাশ, গ্রামাঞ্চলে বৈদ্যুতিকীকরণের ব্যবস্থা, কুটির ও অন্যান্য শিল্পের বিকাশ, শিক্ষা, যোগযোগব্যবস্থা ও জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের আমূল রূপান্তর সাধনের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সংবিধানে অঙ্গীকার আছে। তারই ধারাবাহিকতায় শেখ হাসিনার সরকার আগের মেয়াদের গ্রামে শহরের সুবিধা নিশ্চিত করতে নানা রকম কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।

চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটেও এ বিষয়ে কর্মসূচি রয়েছে। যা পল্লী অঞ্চলের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। বাজেটে উল্লেখ করা হয়েছে, পল্লী সেক্টরে জলবায়ু সহনশীল মধ্য আয়ের অর্থনীতি ধারণের উপযোগী নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণসহ মোট ৫ হাজার ৫৫০ কিলোমিটার নতুন সড়ক নির্মাণ এবং এ সড়কে ৩১ হাজার মিটার ব্রিজ/কালভার্ট সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। নির্মিত গ্রামীণ সড়ক অবকাঠামো টেকসই করার জন্য ১৩ হাজার ৫০০ কিলোমিটার পাকা সড়ক এবং ৩,৮০০ মিটার ব্রিজ সংরক্ষণ করার কার্যক্রম চলমান আছে।

এছাড়া গ্রামীণ অর্থনীতির সঞ্চালন, দ্রুত বিকাশ, কর্মসংস্থান তৈরি এবং সাপ্লাই চেইনে প্রভাবিত করে কৃষি-অকৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করার জন্য ১৯৫টি গ্রোথ সেন্টার বা হাটবাজার উন্নয়নের কাজ চলমান আছে। সরকার বর্তমান মেয়াদে ২০১৯ সালে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে এ ধরনের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে আসছে। এর প্রভাব পড়ছে গ্রামীণ জীবন ও জীবিকাতে। এর ফলে কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ সকল খাতে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

পল্লীতে শহরের সুবিধা বৃদ্ধির জন্য শহরের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে বিশেষ সহায়তা দিয়ে এগিয়ে নেওয়ার জন্য সম্পদ স্থানান্তরের ক্ষেত্রে অনেকগুলো কর্মসূচি চালু আছে। এ সব কার্যক্রম সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় চলমান আছে। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, দুস্থ মা ভাতা, প্রবীণ ভাতা, অতি দরিদ্র ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতাসহ নানা রকম কর্মসূচি। পল্লী অঞ্চলের বিকাশে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে কৃষি উন্নয়নে গৃহীত নানা কার্যক্রম। কৃষিতে নানা রকম উদ্ভাবন ও উন্নয়নের ফলে আগের চেয়ে অনেক উৎপাদন বেড়েছে। এর ফলে কর্মসংস্থানও বেড়েছে। পল্লী অঞ্চলে শিক্ষার হার ও পেশাভিত্তিক প্রশিক্ষণ বৃদ্ধির ফলে মানুষ কৃষি থেকে অকৃষি ও শিল্পের দিকে ধাপিত হয়েছে। এতে কৃষিতে কর্মী স্বল্পতা দেখা দিয়েছে। এই জনবল স্বল্পতা মোকাবিলার জন্য কৃষিকে যন্ত্রায়নের দিকে যেতে হয়েছে। করোনাকালে ধান কেটে ঘরে তোলার ক্ষেত্রে যন্ত্রায়ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। পল্লী অঞ্চলে সড়ক উন্নয়নের ফলে উৎপাদিত কৃষিপণ্য শহরাঞ্চলে বিক্রি করে মূল্য পেতে সহায়তা করছে। এখন কৃষক তার উৎপাদিত ফসলের আগের চেয়ে বেশি দাম পাচ্ছে। যদিও দাম পাওয়ার ক্ষেত্রে এখনো বঞ্চনা রয়ে গেছে। মধ্যসত্বভোগী ফড়িয়ারা ফায়দা লুটছে।

পল্লীর উন্নয়নে যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে। যা সরকারের আর্থিক অন্তর্ভুক্তিমূলক কার্যক্রমের ফলে সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ড. আতিউর রহমান। তিনি খোলা কাগজকে বলেন, সম্পদ ও প্রযুক্তি স্থানান্তর এবং অবকাঠামো উন্নয়নের ফলে পল্লী কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এই সাফল্যের যে ভিত্তি তা একদিনে তৈরি হয়নি। অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তিমূলক যে অভিযাত্রা তা স্বাধীনতার পরপরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুরু করতে পেরেছিলেন। স্বাধীন দেশে শাসনভার কাঁধে নিয়ে মাত্র তিন বছরে মাথাপিছু আয় দ্বিগুণেরও বেশি করে ফেলেছেন। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা ক্ষমতায় এসে অন্তর্ভুক্তিমূলক ধারাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করলেন। ২০০৯ সালের পর গত ১০ বছরে আমরা অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছি। এটা পেরেছি প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে। তার নেতৃত্বে দেশ টেকসই উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যেতে পারছে।

গ্রামীণ অর্থনীতি মজবুত হওয়ার কারণে করোনার মতো ভয়ঙ্কর থাবাও ক্ষতি করতে পারেনি। পোল্ট্রি বলেন, খামার বলেন, সবজি চাষ বলেন- সব ক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্য এসেছে। কৃষিতে সরকার প্রতি বছরে ১০ হাজার কোটি টাকা করে ভর্তুকি দিচ্ছে। এর ফলে চলতি বছরে বন্যার কারণে আমন ধানে কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু বোরোতে তা পূরণ করে ফেলব।

তিনি আরও বলেন, পল্লী উন্নয়নের ধারা অব্যাহত ও পুরোপুরি অভীষ্টে পৌঁছাতে গ্রামে-গঞ্জে পূর্তকর্ম আরও খানিক করা উচিত; পাইপের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করতে পারি, স্যানিটেশন সুবিধা দিতে পারি, গ্রামে যে সব কমিউনিটি হাসপাতাল আছে সেগুলো দিয়ে আরও স্বাস্থ্যসেবা বাড়াতে পারি। এর ফলে গ্রামের মানুষের যে আয়-রোজগার বাড়ছে তার গতি বৃদ্ধি পাবে এবং দ্রুত কাক্সিক্ষত স্থানে পৌঁছানো সম্ভব হবে।

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ


Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228
Electronic Paper