বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় নাগরিকদের আচরণ
গোলাম সরওয়ার
🕐 ৫:০৫ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ১৩, ২০২০
কয়েক বছর আগে থেকেই আড়মোড়া দিয়ে জেগে উঠেছে বাংলাদেশ। চারদিকে পরিবর্তনের বসন্ত বাতাস। অবিশ্বাস্য উন্নয়নের যাত্রা এতটায় সুআয়তনের, তা আজ মানুষের স্বভাবের সঙ্গে সমান্তরাল হতে পারছে না। মানুষের ধারণার বাইরে চলে গেছে আমাদের সামগ্রিক উন্নয়ন। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়গুলোতে জরাগ্রস্ত সামাজিক ব্যবস্থাপনায় যে দৈন্য শুরু হয়েছিল তা আজকের উন্নত অবকাঠামোতে একেবারে বেমানান দেখায়। তাই আজকের লেখায় রাষ্ট্র ভাবনার পাশাপাশি নাগরিকদের স্বভাবগত পরিবর্তনের আবেদন থাকবে।
আমরা জাতীয় জীবনে অন্যান্য দেশ থেকে একটু দুর্বল প্রকৃতির, যা ফুটে ওঠে জীবনবোধ ও সম্পদ আহরণের প্রক্রিয়া মধ্য দিয়ে। আমরা লক্ষ করে থাকি নৈতিক ও অনৈতিক জীবনাচারের দৈন্য ও কৌলিন্যের সামাজিক দ্বন্দ্ব। প্রায়শই খেদোক্তি মেটাতে দেখি অদৃষ্টের সিদ্ধান্তের প্রতি।
চরম কটাক্ষের বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়। বহুকাল থেকে সমাজ ও মানুষ নিয়ে গবেষণায় জানা যায়, আমরা জাতি হিসেবে মারাত্মক আত্মপরায়ণ ও আবেগী তকমাধারী। যা ক্ষেত্র বিশেষে চরম আকার ধারণ করে। এখনো আমরা সামগ্রিক সম্পদকে নিজের সম্পদ ভাবতে পারি না। রাষ্ট্রের প্রতি আমাদের আচরণটা এমন যে রাষ্ট্রটাকে আমার মায়ের জায়গায় বসাতে পারছি না। অথচ আদর্শ নাগরিকের কাছে দেশ তার মায়ের সমতুল্য।
সরকারি বেসরকারি আর্থিক পরিম-লের প্রতিটা ক্ষেত্রেই আমরা একটা বিশেষ শ্রেণির উপস্থিতি লক্ষ করি। এরা আর্থিক জ্ঞানে পরিপূর্ণ এবং এদের মোটিভেশনাল ক্ষমতা অন্য দশজনের চেয়ে অনেক পরিপক্ব, সুচারু ভঙ্গিতে বিদেশি ভাষা সমৃদ্ধ বচনে পরিপাটি। লাখো কোটির বাজেটে এরা গোপন অভিসারে একটা বড় অংশ ভোগ করে থাকে। এরা প্রথম শ্রেণির খাদক হওয়ায় বনরাজ থেকে শুরু করে বনের বিশালাকার হাতিটিও টুঁ-শব্দটিও করে না। এদের উচ্ছিষ্ট থেকে যে উন্নয়নটুকু আমরা পাই তাতেই এ মাটির কপোলের টিপটা মেঘে ঢাকা সূর্যের মতো উঠে আর আড়ালে যায়।
মাইলফলকের উপরে আঁকা একটি নদী যেমন নির্বোধের মতো তার অস্তিত্ব ধরে রাখে, তেমনি আমাদের আত্মচিন্তার ভয়াল থাবায় সরকারি বাজেটের বিশাল অর্থ এপাশ ওপাশ হতে হতে এগিয়ে চলছে সর্পিল গতিতে।
আজ আমরা সর্বত্রই দেখি পদ্মা নদীর বাঁধের বাধাভাঙা উচ্ছ্বাসের চিত্র। বাঁধের ইশারায় হাত নেড়ে বিদায় নিতে যাচ্ছে খরা আর বন্যার অর্থনীতি। মানুষ নতুন যুগের স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যেতে প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। কিন্তু যখন দেখি কয়েক বছরে যে পরিমাণ ডলার এদেশ থেকে চলে গেছে তা দিয়ে আমরা এরকম বারোটি সেতু বানাতে পারতাম! চুরির অর্থ সংখ্যাবাচক কিন্তু অনুমানবাচক না। এই চুরি ষোল কোটি সন্তানের মাকে বিবস্ত্র করে দাঁড়িয়ে রাখছে সাত শ’ কোটি মানুষের সামনে। এক সময় গ্রামগঞ্জে দেখতাম সিঁদেল চোররা সিঁদ কেটে গৃহস্থের বাড়িতে চুরি করে পালাত। শীতের রাতে তাদের লক্ষ্য থাকত লেপ কাঁথার দিকে। চুরি করা মালামাল লুকাতে না পেরে মাঠে-ঘাটে ফেলে রেখে যেত। পরে খবর পেয়ে সেগুলো আবার গৃহস্থের ঘরে ফিরিয়ে আনত। আজকের এসব চোর কোথাও ফেলে রাখে না, হয় তারা হারিয়ে ফেলে, না হয় ধ্বংস করে ফেলে। কী তাদের উদ্দেশ্য, কে তাদের শত্রু?
বেসরকারি সেক্টরের চোররা ছিঁচকে চোরের মাসতুতো ভাই বলে এদের বিষয়টা খুব একটা আলোচনায় আসে না। এদের চেনা খুবই মুশকিল। এরা খুবই বাকপটু এবং এদের সীমানাও খুবই দুর্ভেদ্য। এরা আগারটাও খায় গোড়ারটাও খায়। এদের কারণে গতরে খাটা শ্রমিকের পাতে ঝোল ছাড়া আর কিছুই পড়ে না।
বাংলাদেশের বেশির ভাগ বেসরকারি বিনিয়োগ হয়ে থাকে ব্যক্তি মালিকানা কোম্পানির মাধ্যমে। এসব কোম্পানি পরিচালনা করতে তিন ধরনের জনবল প্রয়োজন হয়। যারা টপ লেভেলে থাকে তাদের সিদ্ধান্তেই কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালিত হয়। আর যারা বটম লেভেলে থাকে, তাদের শ্রম আর ঘামের ফসলে শিল্পের উৎপাদন হয়। আর মিডল লেভেলে থাকে, একটা গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণি যাদের সুবুদ্ধি কুবুদ্ধির দ্বারা রসদ পায় টপ লেভেল আর বোটম লেভেলের জনশক্তি। এখানে এক শ্রেণির আত্মপরায়ণ ও দুর্বল মানসিকতার লোক থাকে যাদের কাছে কোম্পানির সম্পদের উপরে নিজের অবস্থান কল্পনা করে। এরা বিভিন্ন অজুহাতে ক্রয়নীতিতে পরিবর্তন করে এবং অবস্থানগত সুবিধা নিয়ে থাকে। আর এই সুবিধা নিয়ে নিজেরাই অনেক সম্পদশালী হয়ে ওঠার সুযোগ সৃষ্টি করে। এরা তিলে তিলে শেষ করে দিতে পারে লাখো শ্রমিকের কষ্টে গড়া বিশাল সাম্রাজ্য। এরূপ ঘটনার উদহারণ আমরা অহরহই দেখে আসছি।
সামাজিক রীতিতে আজ যে দীনতা ফুটে উঠেছে, তা পারস্পরিক দূষিত আবেশের চেয়ে রাষ্ট্রের সংকোচনে বেশি কার্যকর। একটু লক্ষ করলে আমরা সামাজিক বিয়ে বন্ধনের রীতিতেও দেখতে পাই, পাত্রের উপার্জনের অনৈতিক পন্থা কতটুকু সমাদৃত হয়। এসব কিছুই রাষ্ট্রের বাজেটের ঝরে পড়া অংশের বাহাদুরি।
আজ সাধারণ মানুষের নৈতিকতা বদলানোর সময় এসে গেছে। মানুষের অর্থিক নীতির পরিবর্তন করতে হবে। কয়েক বছর আগেও আমাদের দেশে হাইওয়ে ছিল না। দ্রুতগতির যানবাহনের সঙ্গে মানুষের আচরণের মেলবন্ধন নিয়ে আসতে হবে। দেশে আজ যে সমস্ত রাস্তা, ব্রিজ তৈরি হচ্ছে, সেসব রাস্তায় চলার মতো জুতসই মানুষ তৈরি হচ্ছে না।
আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য রাস্তা উপযোগী এখনো হয়নি। এখনো আমরা রাস্তা নোংরা করি। ব্যাটারিচালিত অটো নিয়ে আমরা দ্রুতগতির গাড়িকে চ্যলেঞ্জ করি। ড্রেনে বর্জ্য ফেলে যেমন জীবাণুকে ঘরে নিয়ে আসি, তেমনি সরকারি অর্থ লোপাট করি। কোম্পানি টাকার নয়-ছয় করি। আমাদের বিবেকের উন্নতি করার জন্য দোয়া চাই না। চাই সোনার মানুষ তৈরির দোয়া।
নিজের সম্পদের সুরক্ষা দেওয়ার মানুষের প্রয়োজন নেই; আজ বড়ই দরকার অন্যের সম্পদ রক্ষা করার মানুষের। ধর্ম নিয়ে নিজের স্বার্থসিদ্ধির মানুষে ভরে গেছে দেশটা। আমাদের বদলানোর এখনই সবচেয়ে উপযুক্ত এবং দামি সময়। মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেকেরও বেশি তরুণ, এই স্বার্থপর মানুষগুলো কেবল নিজের স্বার্থের কথা না ভেবে যদি তরুণদের কথা একটিবারের জন্য ভাবে, তাহলে আগামীতে আমরাই হব ইউরোপ-আমেরিকার মতো উন্নত রাষ্ট্র।
লেখক : বহুজাতিক কোম্পানির
সহ-মহাব্যবস্থাপক।
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228