অস্তিত্ব সংকটে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা
জাফর আহমদ
🕐 ৫:৫১ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ২৯, ২০২০
বড় প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমরা প্রতি বছর রিক্যাপিটাইজেশনের জন্য ব্যাংকগুলোতে টাকা দিই। বড় প্রতিষ্ঠানকে যদি আমরা এভাবে টাকা দিতে পারি তাহলে ছোট যেসব প্রতিষ্ঠান সংকটে আছে সেগুলোকে এককালীন গ্রান্টের মাধ্যমে সহায়তা দিয়ে আর্থিক সংকট থেকে বের করে আনা সম্ভব। এক্ষেত্রে যাদের প্রয়োজন তাদের সঠিক তালিকা করা। আর প্রণোদনা বিতরণের ক্ষেত্রে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের যে অভিজ্ঞতা ও সাফল্য অর্জন করলাম সেটা এক্ষেত্রে কাজে লাগানো যেতে পারে
করোনার অভিঘাত মোকাবেলায় প্রচলিত ঋণভিত্তিক প্রণোদনা স্মল এন্টারপ্রাইজ, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প খাতে দেওয়া সম্ভব নয়। ব্যাংকগুলোর যে কাঠামো তা এ খাতে নেই। যে কারণে ইচ্ছা করলেও ব্যাংকগুলো কাক্সিক্ষত গন্তব্যে পৌঁছাতে পারছে না বলে মনে করেন বিশ^ব্যাংকের অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। খোলা কাগজের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে তিনি অর্থনীতির নানা বিষয় ব্যক্ত করেন।
ড. জাহিদ হোসেন বলেন, করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের পর মার্চ-এপ্রিল মাসে যে করুণ অবস্থা বিরাজ করছিল পরবর্তী সময়ে তার থেকে বের হয়ে আসার অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল। নভেম্বরে এসে করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যু যে হারে বাড়ছে সেটা একটা ধাক্কা খাবে। এ ধাক্কা দুইদিক থেকেই আসবে। প্রথমত, করোনা আক্রান্ত।
দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক থাক্কা। একটি বড় ধরনের আঘাত লাগলে তা অন্যান্য খাতেও ছড়িয়ে পড়ে। তিনি বলেন, ব্যক্তি খাতে কিছু জিডিপির ২২ থেকে ২৩ শতাংশ বিনিয়োগ ছিল। গত বছর সেটা থেমে গিয়েছিল। সেখান থেকে বের হয়ে আসার আগেই, অনিশ্চয়তা আরও গভীর হলো। কাজেই আমাদের বিনিয়োগে আঘাত আসবে, আঘাত আসবে ভোক্তা ব্যয়ে ও ব্যক্তিখাতের ব্যয়-ভোগে।
করোনায় মানুষ একটি অনিশ্চয়তায় ভুগছিল। যাদের সক্ষমতা আছে তারাও খরচ করতে চাচ্ছিল না, নিত্যপণ্যে ছাড়া অন্য খরচ করছিল না। খরচের সামাজিক অনুষ্ঠানগুলো পুরোটাই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এটা আবার চালু হয়েছিল। শীতকাল বিয়ে মৌসুম আসছিল, কমিউনিটি সেন্টারগুলোর ব্যবসা জন্য এটা একটি ভরা মৌসুম হওয়ার কথা ছিল। রেস্তোরাঁগুলোর এ সময়ে ব্যবসা বৃদ্ধি করে। কিন্তু নতুন করে আক্রান্ত ও মৃত্যুহার বেড়ে যাওয়ার কারণে সেটাও থেমে যাবে।
আমাদের দেশে মৃত্যুহার ১০-এর নিচে কখনো নামেনি। এগুলো আবার ৩০-৩৫ উঠে গেছে। দেশে তো বেশি করোনার বেশি টেস্ট হয় না। প্রতিবেশি ভুটান, নেপালের চেয়েও কম। এখানে কম টেস্ট করলেও সংক্রমণের হার বেশি। বেশি টেস্ট করলে তো আর বেশি হতো। এই আক্রান্ত বাড়তে থাকলে ভোক্তা ব্যয় আর বাড়বে না। এ হোটেল, রেস্তোরাঁ, কমিউনিটি সেন্টার, চায়ের দোকান, রিকশাওয়ালার আয় বন্ধ হয়ে যাবে। স্কুল বন্ধ হওয়ায় স্কুলকেন্দ্রিক যে সব ছোট্ট ব্যবসা-চায়ের দোকানের ব্যবসা সেগুলো বন্ধ আছে। আক্রান্তের হার বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে ওই সব ব্যবসা ফিরে আসার সম্ভাবনা কমে যাচ্ছে।
মার্চ-এপ্রিলের শহরাঞ্চলের জরিপের তথ্য তুলে ধরে জাহিদ হোসেন বলেন, শহরের অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কাজেই খাদের মধ্যে পড়েছিল অর্থনীতি সেখানে থেকে বের হয়ে আসার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল নতুন করে আক্রান্ত বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে তা বাধাগ্রস্ত হলো।
আমার মনে হয় এখানে থেকে আমাদের যে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। তা হলো, আমরা অনেকগুলো সহায়তা কর্মসূচি ঘোষণা করেছি।
প্রথমবার যেগুলো ঘোষণা করা হয়েছিল সেগুলো সিংহভাগই ব্যাংকভিত্তিক, ঋণভিত্তিক আর্থিক সহায়তা কর্মসূচি। সেখানে বাজেটের মাধ্যমে ভর্তুকি চালু করা হয়েছে। বাজেটের মাধ্যমে এ সহায়তা কর্মসূচি আকার তেমন একটা বাড়েনি, ভর্তুকি বাদে। সেই সহায়তা কিছুদিন আগে জরিপ বেরিয়েছিল, সেখানে স্মল ইন্টারপ্রাইজ, ক্ষুদ্র, কুটির উদ্যোগগুলো মাত্র দুই শতাংশ সহায়তা পেয়েছে।
এটা জুলাই মাসে, তারপর হয়ত কিছুটা বেড়েছে। অথচ এ জায়গাতে আমাদের কর্মসংস্থান সবচেয়ে বেশি। সে জায়গাটাতে সহায়তা পৌঁছাতে পারিনি। না পারার কারণ কাঠামোগত সমস্যা। যে সব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এ সহায়তা পৌঁছানোর চেষ্টা করেছি এ প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কাছে সহায়তা পৌঁছানোর মতো সক্ষমতা রাখে না। তাদের ব্যবসা মডেলের সঙ্গে এদের সম্পৃক্ত করা খুবই কঠিন। সে জন্য সহায়তা ঘোষণা করলেই শুধু হবে না, জায়গামতো পৌঁছাতে পারবে কিনা, কারা নিয়ে যেতে পারবে, সেটা বিবেচনায় আনতে হবে।
ক্ষুুদ্র ও কুটির শিল্পে সহায়তা পৌঁছাতে পারলে দুইদিক থেকে লাভ ছিল, প্রথমত ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর টিকে থাকা। আর ওইখানে ক্রয়ক্ষমতা তৈরি করলে এখন যে চাহিদা ঘাটতি আছে, সেই চাহিদার ঘাটতিও মেটানো সম্ভব। তাদের যে প্রয়োজনীয় ব্যয় তা যদি তারা করতে পারত তা এই ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানগুলো সহায়তা নিয়ে বসে থাকত না- বলেন জাহিদ হোসেন।
পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে এসব মানুষ অস্তিত্ব সংকটে আছে। এসএমই খাতের একজন উদ্যোক্তার উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, ‘ঋণ পাচ্ছি না, তা নয়। ব্যাংক আমাদের কল করে বলছে তারা ঋণ দিতে চায়। তারা যেভাবে ঋণ দিতে চায়, সেভাবে আমাদের প্রয়োজনের সঙ্গে মেলে না। ধরুন, আমার দরকার পাঁচ লাখ টাকা। আর ব্যংক দিতে চায় ১০ লাখ টাকা। ব্যাংক বলছে, তুমি নিলে নাও দশ লাখ টাকা। না নিলে আমি কম দিতে পারব না, আমার পোষাবে না।’
ড. জাহিদ প্রস্তাব করে বলেন, এ ক্ষেত্রে যেটা প্রয়োজন তা হলো, একেবারে ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান যেমন কুটির শিল্প ও স্বনিয়োজিত প্রতিষ্ঠান নিয়ে যারা কাজ করে এসএমই ফাউন্ডেশন, পিকেএসএফ ও এনজিও-র মতো প্রতিষ্ঠানকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করাতে হবে। মাইক্রো, স্মল, কটেজ- এ তিনটা ক্যাটাগরিতে আমাদের ভাবতে হবে। এগুলোকে যাচাই-বাছাই করে এককালীন একটি অনুদানের ব্যবস্থা করতে হবে, ঋণ নয়।
তিনি বলেন, বড় প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমরা প্রতি বছর রিক্যাপিটাইজেশনের জন্য ব্যাংকগুলোতে টাকা দিই। বড় বড় প্রতিষ্ঠানকে যদি আমরা এভাবে টাকা দিতে পারি তাহলে ছোট্ট ছোট্ট যে সব প্রতিষ্ঠান সংকটে আছে সেগুলোকে এককালীন গ্রান্টের মাধ্যমে সহায়তা দেওয়া যায় তাহলে আর্থিক সংকট থেকে বের করে আনা সম্ভব।
এক্ষেত্রে যে কাজটি করতে হবে তাহলো যাদের প্রয়োজন তাদের সঠিক তালিকা করা। এ জন্য এনজিও, পিকেএসএফ-এর মতো সংস্থার সহায়তা নিয়ে তালিকা করা। আর প্রণোদনা বিতরণের ক্ষেত্রে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের যে অভিজ্ঞতা ও সাফল্য অর্জন করলাম সেটা অন্যদের ক্ষেত্রে কাজে লাগানো যেতে পারে। গার্মেন্ট শ্রমিক কাছে সহায়তা পৌঁছানোর মধ্য দিয়ে আমরা একটি উদাহরণ সৃষ্টি করতে পেরেছি। ইনফরমাল অন্য সবার ক্ষেত্রে কেনো এটা করা যাবে না!
ভ্যাকসিনের মাধ্যমেই আমাদের নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। আর ৭৫ শতাংশ মানুষের কাছে ভ্যাকসিনের না পৌঁছানো পর্যন্ত তো ইমিনিটি আসবে না। কিন্তু ওইটাতে অনেক সময় লাগবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আগামী এক বছরের মধ্যে কাজটা করা খুবই অপটিমিসটিক কাজ হবে। এ পর্যন্ত আমি যে পরিকল্পনা দেখেছি, সে হিসেবে তো দুই তিন বছর লেগে যাওয়ার কথা। তার আগে আমাদের অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধির যে কথাগুলো বলা হয় তা অনেকটা বুলির মতো হয়ে গেছে। তা কার্যকর করা যাচ্ছে না। মাস্কের ব্যবহারের ব্যাপারে যে কথাগুলো বলা হচ্ছে, সাজা বাড়ানো হচ্ছে- এটা চালিয়ে নিতে হবে।
মাস্ক পরা, হাত ধোয়া, যথাসম্ভব স্বাভাবিক দূরত্ব বজায় রাখা, জনসমাগম পরিত্যাগ করতে হবে। এগুলো বাস্তবায়ন করতে প্রয়োজ ধারাবাহিকভাবে প্রচার দরকার এবং অ্যানফোর্সমেন্ট দরকার।
তিনি বলেন, ইস্ট এশিয়া যদি পারে তাহলে আমরা কেন পারব না। সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম, চায়না এরা সব সময় মাস্ক পরছে। আর এরা জনসংখ্যা যে কম তাও কিন্তু নয়। নিউজিল্যান্ডে মানুষ কম আছে তাদের কথা আলাদা। কিন্তু বেশি জনসংখ্যার দেশ ইন্দোনেশিয়া, কোরিয়া করে দেখিয়েছে। আর আমাদের দেশে ইদানিং কিছু বিয়ের অনুষ্ঠানে দেখি তারা কিছুই মনে করছে না, ন্যূনতম সামাজিক নিরাপদ দূরত্বের ধার ধারছে না। নিজের ভালো লাগছে না তাই পারছে না। কিন্তু অন্যের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। জনসচেতনা ও অ্যানফোর্সমেন্টের কাজটি জরুরিভাবে করতে হবে। এক্ষেত্রে সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমকেও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হবে।
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228