পোশাক শিল্পের বর্তমান ভবিষ্যৎ
রবি রায়হান
🕐 ১০:২২ পূর্বাহ্ণ, নভেম্বর ২২, ২০২০
বেসরকারি উদ্যোগে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আস্তে আস্তে তৈরি পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠা লাভ করতে থাকে। ১৯৭৪ সাল হতেই হাঁটি হাঁটি পা পা করে যাত্রা শুরু করে, তৈরি পোশাক শিল্প নিজেদের গুছিয়ে নিয়ে, ১৯৭৭ সালের দিকে রপ্তানি শুরু করে। ১৯৮৩ সালের দিকে তৈরি পোশাক শিল্পের অবকাঠামো মোটামুটিভাবে দাঁড়িয়ে যায়।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক প্রায় ৪৫টি দেশে রপ্তানি হয়। বিশেষ করে রপ্তানি মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বাজার নির্ভর। যেটি তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য বড় বিড়ম্বনা ও উদ্বিগ্নতার কারণও বটে। রপ্তানি ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী মোট রপ্তানির প্রায় ৮৫ শতাংশ বেশি যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ বাজারে রপ্তানি হয়। এর মধ্যে এক যুক্তরাষ্ট্রেই রপ্তানি হয় ৪০ শতাংশ এবং পুরো ইউরোপে ৪৫ শতাংশ বাংলাদেশি তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়। তৈরি পোশাক শিল্প বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান ও সবচেয়ে বড় খাত। তৈরি পোশাক শিল্পে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক সরাসরি যুক্ত এবং অধিক সংখ্যক আমাদের দেশের অবহেলিত নারী শ্রমিক। যা প্রায় ৭৫ শতাংশ, তারা সর্বক্ষেত্রে সুবিধাবঞ্চিত। বিভিন্ন দেশের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি তুলনা করলে দেখা যায়, দেশ ও মাসিক মজুরি হিসাব ইউএস ডলারে: চীন- ১৭০, থাইল্যান্ড- ২৪০, ফিলিপাইন- ১৫৫, ইন্দোনেশিয়া- ৭৫, ইন্ডিয়া- ৭০ ও বাংলাদেশ ৬৮ ডলার। অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদশের একজন পোশাক শ্রমিকের জীবনধারণ দরিদ্র সীমার নিচে, জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনের মাত্র ১৫-১৬ শতাংশ মজুরি পান তারা।
১৯৮৩ সালের দিকে তৈরি পোশাক কারখানার সংখ্যা ছিল তিন শতাধিক যা ২০২০ সালে এসে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার অতিক্রম করেছে। বর্তমানে তৈরি পোশাক শিল্প আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান খাত হিসাবে শক্ত ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠিত।
বাংলাদেশ অ্যাকশন প্ল্যান-২০১৩-১৪ “সাসটেইন্যাবল কমপ্যাক্ট” এবং “জাতীয় ত্রিপক্ষীয় কর্মপরিকল্পনা” তৈরি করে তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে তৈরি পোশাক কারখানাগুলো কমপ্লায়েন্সে উন্নীত করা হচ্ছে। মুন্সীগঞ্জের বাউশিয়ায় ৫৫০ একর জমি অধিগ্রহণ করে “তৈরি পোশাক শিল্পপার্ক” বানানো হচ্ছে যা আধুনিক শিল্পপার্ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হবে।
তৈরি পোশাক শিল্পের সরবরাহ ব্যবস্থায় বিভিন্ন পর্যায়ে অন্তত ১২ থেকে ১৫টি ধাপে দুর্নীতি হচ্ছে। যা তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য অশনিসংকেত। তৈরি পোশাককে দুর্নীতির অভিশাপ মুক্ত করতে হলে দুর্নীতি সমূলে উৎপাটন করতে হবে।
পোশাক শিল্পের সব ধরনের সমস্যা সমাধানের জন্য কার্যকর ও অর্থবহ সামাজিক সংলাপ দরকার বলে মনে করেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের দায়িত্বরত রাষ্ট্রদূতগণ। তৈরি পোশাক কারখানাগুলোকে ‘সবুজ প্রযুক্তির’ আওতায় নিয়ে কর্ম পরিবেশ উন্নতি করার ওপর তাগিদ দিয়েছেন তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক সংগঠন (বিজিএমইএ)। তাতে অধিক হারে রপ্তানি আদেশ আসবে বলে তাদের ধারণা।
বছরওয়ারী কিছু রপ্তানি আয় নিম্নে ধারণার জন্য উল্লেখ করা হলো: ২০১১ সালে ১৭.৯১ বিলিয়ন; ২০১২ সালে ১৯.৯০ বিলিয়ন; ২০১৩ সালে ৩১.৫২ বিলিয়ন; ২০১৪ সালে ২৪.৪৯ বিলিয়ন; ২০১৫ সালে ২৫.৪৯ বিলিয়ন; ২০১৬ সালে ২৮.০৯ বিলিয়ন; ২০১৭ সালে ২৮.১৫ বিলিয়ন এবং ২০১৮ সালে ৩০.৬১ বিলিয়ন; ২০১৯ সালে ৩৪.১৩ বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে। করোনাকালীন সময়েও ১১ অক্টোবর’ ২০ পর্যন্ত ২৭.৯৫ বিলিয়ন তৈরি পোশাক রপ্তানি উল্লেখযোগ্য বলতেই হয়।
চীন তৈরি পোশাক রপ্তানিতে এককভাবে শীর্ষে অবস্থান করছে বহু বছর ধরে। বর্তমানে তৈরি পোশাক খাতকে কম গুরুত্ব দিচ্ছে। এই সুযোগ বাংলাদেশ অনায়াসে গ্রহণ করতে পারে। এই কারণে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ পরিলক্ষিত হচ্ছে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প ইতোমধ্যে দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছে।
তৈরি পোশাক খাতে বাংলাদেশের বিকল্প ইউরোপ আমেরিকা সহ অনেক ক্রেতার নিকট নাই। চীন বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত পোশাক আমদানিকারকদের আকর্ষণ হারিয়ে ফেলছে দিনকে দিন। অন্যদিকে গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহকারী হিসেবে বাংলাদেশ তার জায়গা দখল করে নিচ্ছে।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের ক্রমবিকাশ, সাম্প্রতিক সব পরিস্থিতি, সমস্যা ও সম্ভাবনার চিত্র ফুটে উঠেছে। তৈরি পোশাক রপ্তানিতে শীর্ষস্থানে উঠে আসার সুযোগ ভালোভাবে বাংলাদেশের আছে।
বিশ্বে তৈরি পোশাকের বাজার প্রায় ৪৫০ বিলিয়ন ডলারের। চীন সেখানে একাই ১৬০ বিলিয়ন ডলার বা ৩৫.৫ শতাংশের বাজার অংশীদার। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের হিস্যা মাত্র ৫.৫ শতাংশ প্রায়। আমাদের অংশীদারিত্ব কিছুটা বাড়িয়েছে ৭.৫ থেকে ৮.০০ শতাংশে নিতে পারলে ৫০-৫৫ বিলিয়ন ডলার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা অসম্ভব হবে না।
ইউরোপের প্রধান দেশগুলোতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের আয় স্থিতিস্থাপকতা ২.৫০ শতাংশের এর মতো হবে। ঐসব দেশে তৈরি পোশাক রপ্তানি আয় ১ শতাংশ বাড়লে, বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের রপ্তানি বাড়বে ২ থেকে ২.৫ শতাংশের মতো।
বিগত বছরগুলোতে বিশ্ব বাজারে তৈরি পোশাকের মূল্য উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। মোটা দাগে ওভেন পোশাকের কাটিং অ্যান্ড মেকিং (সিএম) চার্জ কমেছে ১৬ শতাংশের বেশি। এই খাতের উদ্যোক্তাগণ জানান আগে যেখানে প্রতি ডজন পোশাকে সিএম পাওয়া যেত ১০-১৩ ডলারে, বর্তমানে তা ৭-৮ ডলারে নেমে এসেছে।
বিশ্বের সব দেশ মিলে প্রায় ১২৫ ধরনের পোশাকের চাহিদা আছে, এর ভিতর ইউরোপিয়ান দেশসমূহের চাহিদা রয়েছে ৯০ ধরনের পোশাক। সেখানে বাংলাদেশ মাত্র ৩৮ ধরনের তৈরি পোশাক উৎপাদন করতে সক্ষম। অন্যদিকে চীন ৯৫ রকমের, হংকং ৭৫ রকমের, ভারত ৬৫ রকমের তৈরি পোশাক রপ্তানি করতে সক্ষম।
২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাংলাদশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮১.৬৮ শতাংশ (ওভেন ৪১.৮৬% এবং নীটওয়্যার ৩৯.৮২ শতাংশ) তৈরি পোশাক শিল্প থেকে আয় হয়।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে তৈরি পোশাক রপ্তানি করে আয়ের শতকরা হিসাব: ফ্রান্স থেকে ৫.৪৯ শতাংশ ; জার্মানি থেকে ১৪.৮৫ শতাংশ; যুক্তরাজ্য থেকে ১০.৬২ শতাংশ; যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২০.১৬ শতাংশে এবং অন্যান্য দেশসমূহ ৪৫.০২ শতাংশ। এছাড়া, অস্ট্রেলয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও জাপানে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ তৈরি পোশাক রপ্তানি করা হয়।
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228