ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

মহামারী ও আমাদের বিকল্প অর্থনীতি

গোলাম সরওয়ার
🕐 ১০:৫৪ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ২৫, ২০২০

যে কোনো দেশের মৌলিক ধননীতি একটি দেশকে বৈশ্বিক মহামারীর মধ্যেও আলাদা একটি সৌন্দর্য দান করতে পারে, যার প্রমাণ আমরা পেয়ে যাচ্ছি চলমান করোনা অতিমারির অর্থনীতিতে। আমাদের অনমনীয় জিডিপির হার আর দশটা দেশ থেকে আমাদের আলাদা করেছে তা নির্দ্বিধায় বলতে পারি। এর একটাই কারণ হলো এদেশের মমতাময়ী পারিবারিক ভোগনীতির উদার্য্যতা ও রাষ্ট্রীয় বণ্টন নীতি। সকল যুগের বিশ্লেষণ করলে আমরা আমাদের এই স্বতন্ত্র অর্থনীতির টিকে থাকার রহস্য পেয়ে থাকি।

একাত্তরে যেভাবে স্বাধীনতা পাগল মানুষেরা সর্বস্ব ত্যাগের মহিমায় আরেক জনকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছিল, অনুরূপভাবে নিধনকালে বাঙালি মনন নীতির সুচারু ও স্বয়ংক্রিয় সামাজিক বন্ধন ব্যবস্থা অন্য দেশ থেকে আমাদের কয়েকগুণ এগিয়ে রেখেছে। এখনো আমরা আমাদের পরিবারিক জীবনে দেখতে পাই, একজন ভাই আয় করে তিন বোন ও বৃদ্ধ পিতামাতাকে সানন্দে ভরণপোষণ দিচ্ছে, এতে একদিকে সামাজিক সমন্বয় ঠিক রাখছে অন্যদিকে দেশের সেবা করছে।

আন্তর্জাতিক মানিটারি ফান্ড (আইএমএফ) দ্বিধান্বিত চোখে তাকিয়ে থাকে জিডিপি রেট ৩.৪ তাও আবার বিশ্ব মহামারীর মাঝে! এর নিগূঢ় তত্ত্ব বিশ্লেষণ করতে হাজার হাজার দিস্তা কাগজ ব্যয় করবে, কিন্তু তার কিনারা করতে পারবে বলে মনে হয় না। যে জাতি সংকটে সাবলীল হওয়ার মন্ত্র শিখে বাঙালি মায়ের আঁতুড় ঘরেই, সে জাতির টিকে থাকার বিকল্প নিয়ে বেশি ভাবার দরকার পড়ে না।

সারা দুনিয়া যখন আয়-ব্যয়ের গাণিতিক সরলীকরণে কর্মহীন খেটে খাওয়া মানুষকে তুলে দেয় সরকারের কাঁধে। তখন আমাদের করপোরেটের কর্ণধাররা বুক চিতিয়ে আহবান করে বিকল্প কর্ম সৃষ্টি করে।

কৃষিবহুল পেশি আজ শিল্পের পেশিতে রূপান্তরিত হচ্ছে ঠিকই কিন্তু আমাদের ছাড় দেওয়ার মানসিকতা এখনো বহাল তবিয়তে টিকে আছে। আর এই মানসিকতার ওপর ভিত্তি করেই আমরা এ উপমহাদেশকে ছাড়িয়ে কোথায় যেন চলে যাচ্ছি। আমরা যখন উপলব্ধি করতে শিখেছি “লোভাতুর পুঁজিবাদ প্রকৃতি বোঝে না, দীর্ঘমেয়াদের বিবেচনা বোঝে না, ঐতিহ্য-সংস্কৃতি বোঝে না তখন আমাদের আর কোনো পিছুটান নেই। আমাদের বিকল্প চিন্তার পুঁজি আর পারিবারিক সমাজ ব্যবস্থার সাম্যের নীতি নিয়ে বিশ্বকে অবাক করে দিতে পারছি।

গ্রাম আমাদের খুব প্রিয় ঠিকানা, সময় পেলে আয়েশি আয়োজনের পাঁচ তারকা হোটেলে বসে সাগর না দেখে আজও আমরা গ্রামে মায়ের আঁচলের সন্ধান করি, আর সেখানে জীবনের বিচিত্র সব স্বাদ গ্রহণ করি। গ্রামে গেলে চোখে পড়ে দু-দিন আগেও যে মানুষটি রাজধানীর অলিগলি মাড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে ছুটে বেড়াত, সে আজ মাঠের সবলকর্মী। তার কোনো ক্লেশ নেই, অভিযোগ নেই, আছে সবার সঙ্গে সুখে থাকার অপরিসীম তৃপ্তি।

এ ধরনের এ্যাডাপশন ক্যাপাসিটি আমাদের অর্থনীতিকে স্বাতন্ত্রতা এনে দিয়েছে। আমাদের বাণিজ্যিক পরিসীমার তিনটি শাখাতেই এমন বিকল্পধারার অবস্থান লক্ষ করছি অন্ততকাল ধরে।

প্রাইম সেক্টরে এক সময় দেখতাম খরার কারণে কৃষক তার আউশ ধান বপন করতে পারত না। তখন তারা শুকনো জমিতে ধানের বীজ বপন করে দিত। এমন চাষের নাম ছিল কাঁকড়ি করা। কিছু দিন পরে প্রকৃতির নিয়মে যখন ব্যাপক বৃষ্টি হতো তখন ধানের বীজ থেকে কচি চারা উদীপ্ত হতো, তার সঙ্গে উদিত হতো আশার কচি শাখা-প্রশাখা কৃষকের মনে। আর এভাবেই আমাদের কৃষিনির্ভর অর্থনীতি সতেজ হয়ে উঠত গ্রামীণ জনপদে। সেকেন্ডারি সেক্টরেও আমরা বহুকাল থেকে বিকল্প উৎপাদন ব্যবস্থা দেখতে পাই, যা করোনাকালে আরও স্পষ্ট হয়েছে।

প্রায় সব শিল্প কলকারখানা এখন পিএলসির মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয় মেশিন দ্বারা পরিচালিত হয়। তাতে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিলে বাইপাস করেও তা চালিয়ে উৎপাদন ঠিক রাখছে। পশ্চিমা বিশ্বে এমনটি চিন্তা করার কোনো সুযোগই দেওয়া হয় না। থার্ড সেক্টরে ব্যক্তিক চিন্তার সঙ্গে সঙ্গে তার ব্যবসার ধরনের বিচিত্রতা এনে যেমনভাবে টিকে থাকছে তেমনিভাবে আমাদের সামগ্রিক অর্থনীতির সূচকেও তার পজিটিভ ইফেক্ট পড়ছে।

আমরা যুগের পর যুগ পার করেছি নানা প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে। কিন্তু তার কোনোটিই আমাদের দ্বারা সৃষ্ট নয়। পদ্মা-মেঘনা-যমুনার দেশ বাংলাদেশ।
স্বাধীন বাংলাদেশ হঠাৎ করেই মুখোমুখি হলো ভয়াবহ ফারাক্কা বাঁধের উপস্থিতি। এর বিরূপ প্রভাবে লক্ষ লক্ষ একর কৃষি জমি হারিয়ে কৃষক আজ সম্পদের মালিক থেকে শুরু করে ফুটপাতের ব্যবসায়ীতে রূপান্তরিত হয়ে টিকে আছে। জল প্রবাহ কনভেনশন লঙ্ঘন করে, ভাটির মানুষের দুঃখ হয়ে অনেকে অনেক কিছু করার চেষ্টা করছে তাতে আমাদের কিছু আসে যায় না। আমরা আজ বাইপাস করে চলতে জানি, হাত না ধুয়েও খেতে পারি, মরণাস্ত্র ছাড়াও লড়তে পারি। আমাদের দেশে জরিপের আন্ডার এমপ্লয়মেন্ট আশীর্বাদ হয়ে যায়।

করোনা সহ পৃথিবীর ইতিহাসে যত মহামারী ও মানব সৃষ্ট দুর্যোগ হানা দিয়েছে তার কোনোটিই বাঙালির দ্বারা সৃষ্টি হয়নি। তবুও আমরা মোকাবিলা করেছি নির্দ্বিধায়। চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ, রোগ, দুর্ভিক্ষ, বন্যা, মরুময়তা সবই আমরা মোকাবিলা করেছি হাসিমুখে। পরিণত হয়েছি আমরা আজ বিকল্প পথের সেরা যাত্রী হিসেবে। ধারণা করা হয়েছিল কোভিডের কারণে ২০২০ সালে বেকারত্বের হার ২০১৯ এর চেয়ে দ্বিগুণ হয়ে যাবে।

অনুমান করা হয়েছিল বাংলাদেশের বেকারত্ব বেড়ে ১১.৯ থেকে ২৪.৮-এ উঠে যাবে। অনুরূপভাবে ভারত ২৩.৩ থেকে ৩২.৫ এবং পাকিস্তান ৮.৯ থেকে ২১.৫ হবে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে জিডিপির গ্র্রোথের হার বেকারত্বের হার এর প্রাক্কলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আমাদের আশপাশের দেশগুলোতে এই পরিসংখ্যানের প্রতিফলন ঘটলেও আমাদের সহিষ্ণু অর্থনীতিকে স্পর্শ করতে পারেনি। এর অন্যতম কারণ আমরা সব ধরনের প্রতিকূলতায় টিকে থাকার মন্ত্র শিখে ফেলেছি।

লেখক : বহুজাতিক কোম্পানি ব্যবস্থাপক

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ


Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228
Electronic Paper