ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

মানুষ ও প্রকৃতি হোক উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু

মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান
🕐 ১:৩৫ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ০৪, ২০২০

মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অনেক ত্যাগ ও লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, শোষণ ও বঞ্চনামুক্ত সমাজ গড়ার স্বপ্নে কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, মেহনতি মানুষ জীবনবাজি রেখে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে এনেছিল। এ মুক্তিযুদ্ধের লালিত স্বপ্নের সাম্পান অচিরেই ভেঙে পড়ে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা হত্যার মধ্য দিয়ে।

এ দেশে এখন নেই কোনো জমিদারের উৎপীড়ন, ইংরেজদের শোষণ-শাসন, পর্তুগিজ, ঠক কিংবা বর্গীর হানা। তবুও হাহাকার থেমে নেই বাংলার মাটিতে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের পঞ্চাশ ভাগ মানুষ ছিল দরিদ্র। সে হিসেবে সাড়ে তিন কোটি মানুষ দরিদ্র ছিল। আজ আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, শিক্ষার হার বেড়েছে, জাতীয় আয় বেড়েছে, আর সেই সঙ্গে বেড়েছে বিদেশি ঋণের বোঝা। এ কথা আমরা স্বীকার করব, অনেক কিছুতেই আমাদের উন্নতি হয়েছে। তারপরেও বর্তমানে ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে চব্বিশ ভাগ মানুষ দরিদ্র। শতকরা হিসাবে দারিদ্র্যের মাত্রা কমলেও দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমে নাই। শুধু বাংলাদেশেই নয় পৃথিবীজুড়ে এ প্রবণতা একই রকম লক্ষ করা যায়। 

আধুনিক প্রযুক্তি ও উন্নত সভ্যতার শিখরে থাকা এ পৃথিবীতে প্রায় একশ’ বিশ কোটি মানুষ প্রতিদিন অর্ধাহারে কিংবা অনাহারে রাত্রি যাপন করে। যেকোনো দুর্যোগ, অতিমারী, এ ক্ষুধাকে বহুমাত্রায় বাড়িয়ে তোলে। দেশে শতকরা আশিভাগ মানুষ দরিদ্র না হলেও দারিদ্র্যসীমার খুব কাছাকাছি বাস করে। তাই যে কোনো দুর্যোগ (অতিবৃষ্টি, বন্যা, সাইক্লোন) ও অতিমারীর কবলে পড়ে নতুন করে দরিদ্র্যের খাতায় নাম লেখাতে হয় বা হচ্ছে।

১৯৫০ সাল থেকে এ পর্যন্ত পৃথিবীতে উন্নয়ন হয়েছে কয়েকশ’গুণ। নতুন নতুন প্রযুক্তি ও প্রাকৃতিক সম্পদের অবাধ ব্যবহারের ফলে মাথাপিছু আয় ও বৈষম্য বেড়েছে সমানতালে। সেই সঙ্গে পুঁজি গিলে খেয়েছে খাল-বিল, নদ-নদী, সাগর, পাহাড়-পর্বত, বন-জঙ্গল, গাছপালা, পশুপাখি ও মনুষ্যত্ব। বিগত দুই দশকে মানুষের লালসার শিকার হয়ে, প্রকৃতি থেকে ৬৮ ভাগ বন্যপ্রাণী হ্রাস পেয়েছে। গুটিকয়েক মানুষ এমনভাবে পৃথিবীটাকে ব্যবহার করছে যেন একমাত্র তাদেরই টিকে থাকার অধিকার রয়েছে। এ নিষ্ঠুরতা বিবেকবান ও প্রকৃতিপ্রেমী মানুষদের ভাবিয়ে তোলে এবং আতঙ্কিত করে। শুধু মানুষের নয়, পৃথিবী হোক সবার। প্রতিটি প্রাণী নিরাপদে বসবাস করার অধিকার পাক। যদি আমরা এ অধিকার ফিরিয়ে না দিতে পারি, প্রকৃতি তার হিসাব কড়ায়-ক-ায় আদায় করে ছাড়বে। ছাড়ছেও। কারণ প্রকৃতি কোনো জাতির সামষ্টিক অন্যায়কে কখনো ক্ষমা করে না।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ প্রায় পঞ্চাশ বছর সময় পেয়েছে, যা মহাকালের বিবর্তনে যথেষ্ট না হলেও উন্নত দেশ ও জাতি গড়ার জন্য যথেষ্ট ছিল বলে বিশ্বাস। আমরা যদি দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনৈতিক ইতিহাসকে বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখব মাত্র ত্রিশ বছরের ব্যবধানে একটা অনুন্নত দেশকে কীভাবে উন্নত দেশ ও জাতিতে পরিণত করতে সমর্থ হয়েছে। পঞ্চাশের দশকে দক্ষিণ কোরিয়া ছিল অনুন্নত, জনবহুল, অনুর্বর ও অপ্রতুল প্রাকৃতিক সম্পদ ও কৃষিপ্রধান দেশ। কিন্তু তারা গুণগত শিক্ষা, দক্ষ জনশক্তি তৈরি, শ্রম-নিবিড় শিল্প, উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার, গবেষণা ও উদ্ভাবন খাতে বিনিয়োগ এবং ধীরে ধীরে ভারী শিল্প, ইলেকট্রনিক পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানির মধ্য দিয়ে দেশকে উচ্চ আয়, পরিশ্রমী, সৎ ও উন্নত জাতিতে পরিণত করেছে।

অপর দিকে পাঁচ দশকে আমাদের মাথাপিছু আয় বাড়লেও আমরা নিম্নআয়ের দেশের কোটাতে রয়েছি। সঙ্গে বেড়েছে ধনী দরিদ্রের মধ্যে আয় বৈষম্য। বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশে কোটিপতির সংখ্যা বাড়ছে দ্রুত গতিতে। এ থেকে আমরা সহজেই বুঝতে পারি, দেশের এ আয় বৃদ্ধির সুফল ভোগ করছে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ।

দেশকে উন্নত করার অনেক সুযোগ রয়েছে। প্রথমত গুণগত ও মানসম্মত শিক্ষার বিস্তার ঘটাতে হবে যাতে দক্ষ জনবল সৃষ্টি করা যায়। পোশাক শিল্পসহ অন্যান্য শিল্পে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি ও ব্যবস্থাপক সৃষ্টি করতে হবে। যাতে অন্য দেশ থেকে জনবল আমদানি ধীরে ধীরে কমাতে পারি। গবেষণা ও উদ্ভাবনী শক্তির বিকাশ ও বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। সমাজে এ ধরনের মানুষের মূল্যায়ন বাড়াতে হবে। ব্লু অর্থনীতিতে আমাদের বিনিয়োগ ও গবেষণা বাড়াতে হবে। গভীর সমুদ্র থেকে মাছ ও অন্যান্য সম্পদ আহরণের দক্ষতা অর্জন করে কাজে লাগাতে হবে। সর্বোপরি দুর্নীতির লাগাম শক্ত হাতে টেনে ধরতে হবে যাতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী উন্নয়নের সুফল পায়।

বিশ্বাস করি এ দেশ একদিন বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। দূর হবে ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও বৈষম্য। ভয়হীন ও নিরাপদ থাকবে প্রতিটি শিশু ও নারী। মানুষ ও প্রকৃতির সমন্বয়ের মাধ্যমে ভারসাম্য উন্নয়ন হবে। যার সুফল পাবে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। প্রতিটি পরিকল্পনা ও উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু হোক মানুষ ও প্রকৃতি। আমাদের চলার পথ হোক প্রিয় কবির স্বপ্নের মতো। আমরা যেন ভুলে না যাই শেকড়ের কথা। আমি বাংলায় কথা বলি, ‘চোখে নীল আকাশ, বুকে বিশ্বাস, পায়ে উর্বর পলি’।

মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান : উন্নয়নকর্মী, আন্তর্জাতিক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ


Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228
Electronic Paper