ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বাংলাদেশ ব্যাংককে কঠিন হতে হবে

জাফর আহমদ
🕐 ৩:১৬ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২০

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ দেশের একজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ। বাংলাদেশ ব্যাংকের নবম গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে বেসরকারি একটি বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। চালিয়ে যাচ্ছেন অর্থনীতি, বিশেষ করে ব্যাংকিং বিষয়ে লেখালেখি। তিনি খোলা কাগজের সঙ্গে দেশের ব্যাংকিং বিষয়ে কথা বলেছেন। তার বক্তব্যে উঠে এসেছে ব্যাংকিং খাতের নানা বিষয়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন খোলা কাগজের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক জাফর আহমদ

টিআইবি বলছে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। সাবেক গভর্নর হিসেবে বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
এমনিতেই ব্যাংকিং খাত নানা রকম সমস্যায় আছে। তারপর নতুন সব ব্যাংক এসেছে। কাজ বেড়েছে। তবে আমরা যেটা বলছি বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও শক্ত হতে হবে। আরও শক্ত অবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। কোনো রকম ইনফ্লুয়েন্স, যেমন রাজনৈতিক, আমলাতান্ত্রিক বা বড় বড় যে সব গ্রাহক (বোরোওয়ার) আছে, বিশেষ করে বড় বড় অ্যাসোসিয়েশন, বিএবি, এবিবি ও বিভিন্ন গ্রুপ আছে। তারা বিভিন্ন সময় প্রেসার দেওয়ার চেষ্টা করে। সেখান থেকে যতটা সম্ভব নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে কাজটা করতে হবে। প্রুডেনশিয়াল নর্মসগুলো আছে, নীতিগুলো আছে, ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাক্ট আছে যতদূর সম্ভব পরিপালন করে। বাংলাদেশ ব্যাংককে শক্ত অবস্থানে থাকতে হবে। 

কেস বাই কেস, এক একটি কেস ধরে মনিটারিং করতে হবে। ঢালাওভাবে আদেশ দিয়ে-এই কর, ওই কর এভাবে করলে চলবে না। যারা খারাপ তাদের শক্তভাবে ধরতে হবে। যারা মোটামুটি ভালো তাদের ট্রিটমেন্ট করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রাজনৈতিক ইস্যু আছে। সব সরকারের সময় এটা সবাই করে। তার মধ্যে থেকেই আমরা কাজ করেছি। আর সমস্যা হলো ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে একটু ঝামেলা করেছে। একই পরিবারের একাধিক সদস্যকে একই ব্যাংকে থাকার ব্যবস্থা করেছে। ব্যাংক কোম্পানি আইনকে আরও পেছন দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

বলা হচ্ছে যত আইন পরিবর্তন করা হচ্ছে, যত নতুন নতুন বিধি-বিধান হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে আরও দুর্বল করা হয়ে যাচ্ছে। আপনি বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?
এটা সত্য। কতগুলো ধারা সংশোধন (অ্যামেন্ডমেন্ট) করা হয়েছে, এগুলো সব খারাপ সংশোধনী। এগুলো না করে যদি আগে যেটা ছিল (অ্যাজ ইট ইজ) সেটাও রাখতো তাহলো এত খারাপ হতো না। কোন বিবেচনায় ব্যাংক কোম্পানি আইনের এই সংশোধন তা বোধোগম্য নয়। আমরা বলেছিলাম, এখন যেটা দরকার একটি এক্সপার্ট মতামত নিয়ে একটি স্বতন্ত্র কমিশন করতে হবে। সেটা বোধ হয় সরকার করবে না। যা হোক, এ খাতের দক্ষ মানুষের মতামত নিয়ে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আলাপ করে ব্যাংক কোম্পানি আইনের কিছু ধারা দ্রুততার সঙ্গে (ইমিডিয়েটলি) সংশোধন করতে হবে। প্রয়োজনে অধ্যাদেশ জারি করুক, তারপর এগুলো সেসন চললে সেখানে পুট-আপ করুক। এটা এখন দ্রুততার সঙ্গে দরকার। তা না হলে ব্যাংকিং খাতকে ঠিক করা যাবে না।

আমার মনে হয় হয়, সেন্ট্রাল ব্যাংকের এখনো যে ক্যাপাসিটি আছে যতদূর সম্ভব পরিবীক্ষণ জোরদার করুক, নিয়মিত করুক। যাতে একজন ব্যাংকার বুঝতে পারেন যে, বাংলাদেশ ব্যাংক আছে। আরও একটি জিনিস আমি লক্ষ্য করেছি কর্মকর্তারা পরিদর্শনে যান। তারা রিপোর্ট তৈরি করেন। সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। অনেক ব্যুরোক্রেসি সমস্যা আছে, অনেক উপরের দিকে নাকি সেই রিপোর্ট যায়। আমার সময় সেগুলো ছিল না। জেনারেল ম্যানেজারকে বলে দেওয়া হতো- তোমরা যা করার করো। নীতিগত বিষয় হলে সেগুলো ডেপুটি গভর্নররা দেখবেন। বা ইডিরা দেখবে বা আমার কাছে নিয়ে আসা হতো। এখন শুনছি এগুলো উপরের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। এগুলো করলে কঠিন হয়ে যাবে। অর্থাৎ প্রশাসনকে বিকেন্দ্রীয়করণ করতে হবে। দায়িত্ব বণ্টন করে দিতে হবে। তারা যদি ভুল করে ওই ভুলের জন্য তাদের জবাবদিহি করতে হবে। এটা যদি না করে তাহলে খুব কঠিন হবে।

অভিযোগ উঠেছে ব্যাংকের যত শাখা বাড়ছে, ব্যাংক পরিদর্শনে বাংলাদেশ ব্যাংকের তত সক্ষমতা কমছে- বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
প্রথম যে অসুবিধা হয়েছে তাহলো এতগুলো ব্যাংকের অনুমোদন দরকার ছিল না। অপ্রয়োজনীয়ভাবে, অহেতুকভাবে কতগুলো ব্যাংক অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আমার সময়ে তো এতগুলো ব্যাংকের দেইনি। দিয়েছি মাত্র একটি। আমার পরে ১২টি ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। লিজিং কোম্পানি অনুমোদন দেওয়া হলো। ব্যাংকের সংখ্যাধিক্য বিবেচনায় যে লোকবল প্রয়োজন ছিল বাংলাদেশ ব্যাংক লোকবল সেভাবে বাড়াতে পারেনি। দ্বিতীয়ত হলো- নতুন ব্যাংক, সঙ্গে পুরনো ব্যাংকের কয়েকটিতেও নানা রকম সমস্যা বাসা বেঁধেছে। বিশেষ করে সুশাসনের অভাব। অর্থাৎ সমস্যা বেড়েছে ব্যাংকও বেড়েছে। এরপরে বাংলাদেশ ব্যাংকের সুপারভিশন-অফ সাইড সুপারভিশন, অনসাইড সুপারভিশন যেগুলো করে সেগুলো একটু দুর্বল হয়ে গেছে।

কথা উঠেছে ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর নিয়োগে শিল্পগোষ্ঠীর হাত থাকছে। যারা এ দায়িত্বে যাবে আগে তারা কেউ কেউ সরকারের লোকজনের কাছে আশীর্বাদ নিতো, এখন শিল্প গোষ্ঠীর কর্ণধাররা যুক্ত হয়েছেন। এ অবস্থা আর্থিক খাতের জন্য কতটা সহায়ক হবে?
এটা যদি হয়ে থাকে খুবই খারাপ। ডেপুটি গভর্নর একটি গুরুত্বপূর্ণ পোস্ট। ডেপুটি গভর্নর সার্বিকভাবে গভর্নরকে অ্যাডভাইস করে থাকেন, সহযোগিতা করে থাকেন। সেটা তাদের দায়িত্ব। ডেপুটি গভর্নর নিয়োগের ক্ষেত্রে তথাকথিত একটি সার্চ কমিটি হয়ে থাকে। আমার মনে হয় না সার্চ কমিটি দক্ষ (ইফিশিয়েন্ট)। তবে সার্চ কমিটিতে যদি ভালো যোগ্য ও সৎ লোকজনদের নাম দেওয়া হয় এবং সার্চ কমিটি যদি শতভাগ ফলো করে তবে এটা কার্যকর হবে। এটা সরকার করে। আবার সরকারকে চাপ সৃষ্টি করবে স্বার্থসংশ্লিষ্ট গ্রুপ। রাজনীতিতে আবার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট গ্রুপ প্রভাব বিস্তার করে। রাজনীতিকরা আবার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, ব্যাংকের সঙ্গে জড়িত। উচিত এগুলো আলাদা আলাদা রাখা। কিন্তু সেগুলো করা হয়নি। করেও না, এ কারণে এতে সুবিধা পায়। সুবিধা রেখে কেউ কাউকে চ্যালেঞ্জ করে না। যে কারণে অকাজ করেও কেউ শাস্তি পায় না। শাস্তি না হলে, প্রতিকার না হলে এগুলো চলতেই থাকবে। এটাই একটি দুঃখজনক ব্যাপার। গভর্নরের বেলায় দরকার সৎ, যোগ্য ও নির্লোভ ব্যক্তিদের নাম উল্লেখ করা। দেখতে হবে কারা তাকে সাপোর্ট করে। সেগুলো দেখতে পারলে মঙ্গলজনক হয়। কিন্তু আমার মনে হয়, আজকাল এটা হচ্ছে না। আমার বেলায় ডেপুটি গভর্নর চারজন ছিল। তখন সিনিয়টির বিষয়টিকে দেখা হতো। আমিও কমিটিতে থাকতাম, সবাই মিলে মতামতের ভিত্তিতে এটা করা হোত। একজন লোক ভাল সেটা নিশ্চিত করা হোত। এখন সেই অনুশীলনটি বোধ করি নেই। সার্চ কমিটি থাকে তাও বিভিন্ন বিবেচনায় করা হয়।

বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারী চলছে। বাংলাদেশও করোনা মোকাবিলা করছে। করোনার অভিঘাত মোকাবিলায় সরকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। এ অবস্থায় ব্যাংকিং খাত কতটা সক্ষমতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে পারছে ?
করোনা আমাদের সব খাতকেই ক্ষতি করেছে। ব্যাংকিং খাতে আরও বেশি সমস্যা করেছে। ব্যাংকিং খাত আগে থেকেই নানা সমস্যায় জর্জরিত ছিল। সুশাসনের সমস্যা, দুর্নীতির সমস্যা। করোনার কারণে এসব সমস্যা আরও প্রকট হয়েছে। নতুন সমস্যা যোগ হয়েছে; ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে ব্যাংকিং খাতে। এই সমস্যা থেকে উত্তরণে সরকার যে প্যাকেজ (প্রণোদনা) ঘোষণা করেছে তা খুবই কমপ্রিহেনসিভ ছিল। কিন্তু তা বাস্তবায়নে ত্রুটি ছিল। এ প্যাকেজ ঋণনির্ভর ছিল এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেশি দায়িত্ব ছিল। কিন্তু বাস্তবায়নে গতি খুবই ধীর; দ্রুতগতিতে করতে পারেনি। আমার ধারণা ছিল, আমি বলেছিলামও ব্যাংকাররা এটাকে রুটিন কাজ হিসাবে না নিয়ে ব্যাংকার বিশেষ দায়িত্বের কাজ হিসাবে নেবে। কিন্তু এটা হয়েছে গতানুগতিক। ব্যাংকাররা এই নিয়ে ব্যস্ত- ঋণ দেব, কতটা রিটার্ন থাকবে, মুনাফা কতটা থাকবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। এই গতানুগতিক মনোভাব নিয়ে এই করোনাভাইরাস কোভিড-১৯ মোকাবিলা করা অসম্ভব। তারপর তা বাস্তবায়নে অনেক দেরি হয়ে গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছিল আগস্টের মধ্যে করতে হবে। তারপর বললো সেপ্টেম্বরের মধ্যে করতে হবে। আমার মনে হয় সেপ্টেম্বরের মধ্যেও এটা করতে পারবে না। যারা বেশি বেশি ঋণ নেয় তারা টাকা নিয়ে ঠিকই চলে গেছে। যারা ছোট ছোট উদ্যোক্তা, যারা অসহায় লোক তারা ঋণ পায়নি। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার। যেমন, কৃষি খাত খুবই নাজুক অবস্থা। এগুলো যদি চিহ্নিত করে সমস্যার সমাধান না করা যায় করোনা মোকাবিলা খুব কার্যকর হবে না।

কিছু কিছু খাত ঘুরে দাঁড়াচ্ছে-
কেউ কেউ বলছে কিছু কিছু খাত ঘুরে দাঁড়িয়েছে, রপ্তানি আয় বাড়ছে, রেমিট্যান্সে বড় ধরনের উন্নতি হয়েছে। এগুলো ছিটেফোঁটা। আমি মনে করি এটা ইতিবাচক লক্ষণ। যে কোনো বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবিলার করার বাংলাদেশের ভিতরের একটি শক্তি (রেজিলিয়ান) আছে। এ কারণে ঘুরে দাঁড়ানোর দৃশ্য দৃশ্যমান। কিন্তু তা কতটা টেকসই এখনই বলা যাবে না। ডিসেম্বরের আগে বোঝাই যাবে না রেমিট্যান্স বাড়বে কি না, তৈরি পোশাক রপ্তানির ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকবে কিনা? এটা বুঝতে আরও কিছুটা সময় লাগবে। ডিসেম্বরের পরের বোঝা যাবে আমাদের অর্থনীতি সঠিক ধারাতে আছে কিনা। এশিয়ান ডেভলপমেন্ট ব্যাংক ৭ এর উপরে প্রবৃদ্ধি প্রজেকশন করেছে বা কোন কোন কোন গণমাধ্যম কর্মচাঞ্চল্য ফিরে এসেছে বললেও তা সঠিক নয়, এগুলো সরকারকে খুশি করার জন্য। হ

 
Electronic Paper