ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

খেলাপিরা নির্বাচনে অ্যাকাউন্টিংয়ের খেলা খেলে

জাফর আহমদ
🕐 ৯:৩২ পূর্বাহ্ণ, ডিসেম্বর ১২, ২০১৮

ড. জাহিদ হোসেন বিশ্বব্যাংকের মুখ্য অর্থনীতিবিদ। কর্মরত ঢাকা অফিসে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রয়েছে তার বিস্তর অভিজ্ঞতা। সম্প্রতি ব্যাংকিং খাত নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক জাফর আহমদ

নির্বাচনকে সামনে রেখে খেলাপি ঋণ কমে আসার কথা। কিন্তু সর্বশেষ প্রকাশিত খেলাপি ঋণের হিসাবে সে কথা বলে না। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
কথা হচ্ছে যারা নির্বাচন করবেন তারা খেলাপি ঋণ শোধ করবেন। তার মানে এই নয় যে নির্বাচনের আগে যে তারা টাকা ফেরত দিয়ে দিচ্ছেন। তারা শুধু খাতা কলমে এদিক-ওদিক করছেন। কিন্তু নির্বাচন করার আগে খেলাপি ঋণ ফেরত দেখানোর সুযোগগুলো বন্ধু হওয়া প্রয়োজন।

গত সেপ্টেম্বরে খেলাপি ঋণ ১০ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে...
এ সেপ্টেম্বরে যেটা বেড়েছে ডিসেম্বরে এটা আবার কমে যাবে। কমে যাবে এ কারণে, নমিনেশন সাবমিট করার সময় পুনঃতফসিলিকরণ করা ও ঋণ পুনর্গঠন ইত্যাদিভাবে যেটা খেলাপি ছিল সেটা নিয়মিত করে ফেলেছে। সেখানে অ্যাকাউন্টিংয়ের খেলা হয়। সেপ্টেম্বর মাসে এ ধরনের খেলা হয়নি। এখন দেখা যায় এগুলো হচ্ছে। সে জন্য ডিসেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ কমবে এবং কৃত্রিমভাবে কমবে। ব্যাংকাররা বছর শেষে ব্যালেন্স শিট পরিষ্কার করে। মার্চে এসে আবার বেড়ে যাবে। কিন্তু আমি মনে করি মৌলিক সমস্যা চিহ্নিত ও সমাধান না করা গেলে তো এটা থামবে না। নির্বাচন হলে সাময়িকভাবে কমবে। কিন্তু পরে আবার আগের অবস্থাতেই ফিরে যাবে। এর পেছনে মৌলক যে কারণে হয় সেগুলো আগে চিহ্নিত করতে হবে।

সেই কারণ ও তার প্রতিকারের ব্যাপারে যদি বলতেন...
প্রিভেন্টিভ কিছু মেজারস নেওয়ার প্রয়োজন। যেটা অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, কোনো কাস্টমার ঋণ দিচ্ছে না তা ক্ষতিয়ে দেখা, জামানত হিসেবে যা নেওয়া হচ্ছে যদি খেলাপি হয় তাহলে তা ব্যবহার করতে পারবেন কিনা তা দেখা। এগুলো হলো তার প্রতিরোধক ব্যবস্থা। কিন্তু শুধু প্রতিরোধক ব্যবস্থা দিয়ে কাজ হয় না। কারণ একবার খেলাপি হয়ে গেলে সে যদি অনিচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি হয় তাহলে তা আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সমাধান হয়। যদি কারও লোকসান হয় তাহলে পরে দেবে বা আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাবে। কিন্তু যারা ইচ্ছাকৃত খেলাপি তাদের একটি বিচারিক প্রক্রিয়ার মধ্যে আনতে হবে। সে রকম একটা ব্যবস্থা আমরা দেখেছি খেলাপিদের নাম প্রকাশ করা। একটি সামাজিক লজ্জার মধ্যে পড়বে। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হয়নি।

আগের এফআইডি সচিব যাওয়ার আগে কিছু খেলাপির নাম প্রকাশের পাশাপাশি কিছু সুপারিশ করে গিয়েছেন। কিন্তু অনেক রাঘব-বোয়ালের নাম আসেনি। তারপর কিছু নাম এসেছিল। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এসব খেলাপির যদি একটি জবাবদিহি, একটা বিচারিক ব্যবস্থার মধ্যে আনা হতো, তাদের বিচার হলে, দোষী সাব্যস্ত হলে, এর যোগ্য শাস্তি হলে, জরিমানা হলে, ওই খেলাপি ঋণের বিপরীতে জামানতগুলো সংগ্রহ করা হতো এবং যদি এমন ব্যবস্থা নেওয়া হতো তাহলে কাজ হতো।

নাম প্রকাশ করেও তো কাজ হচ্ছে না, তাছাড়া সবার নাম প্রকাশ করাও হচ্ছে না...
শুধু ঋণ খেলাপি নয়; তারা আরও লজ্জাজনক কাজ অনেকে করে যায়। সে ক্ষেত্রে যার সে বোধ নেই তার তো কাজ করবে না। অবশ্য শত কোটি টাকার ব্যাপার। এ জন্য একটু লজ্জা হলেও সে লজ্জা সহ্য করছে।

এ ব্যাপারে চীনের ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে নেওয়া ব্যবস্থা অনুসরণ করা যায়। সেখানে খেলাপিদের বুলেট ট্রেনে উঠতে দেওয়া হয় না, খেলাপিদের সন্তানদের ভালো স্কুলে ভর্তি হতে দেওয়া হয় না, প্লেনে উঠার ক্ষেত্রে বাধা নিষেধ আছে। বাংলাদেশেও খেলাপিদের বিদেশ ভ্রমণ ও রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া যেতে পারে।

যেসব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান খেলাপি ঋণে জর্জরিত তাদেরও একটা জবাবদিহির ব্যবস্থা করতে হবে। তোমরা এসব ঋণ দিতে গেলে কেন? যারা দিচ্ছে না তাদের বিচারের ব্যবস্থা করো। বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের মূলধন ঘাটতি হলে তা বাজেটের মাধ্যমে পূরণ করা হচ্ছে। তাদের চাপ নেই যে, খারাপ করলে শাস্তি পেতে হবে; বা আমার প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে গেলে আমার চাকরি থাকবে না, আয় বন্ধ হয়ে যাবে এ ধরনের শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা নেই। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি স্বয়ংক্রিয়ভাবে পড়ছে গিয়ে সরকারের ঘাড়ে। তথা করদাতাদের ঘাড়ে। এখানে জবাবদিহি ঘাটতি রয়েছে।

আবার প্রাইভেট ব্যাংকের ক্ষেত্রে আমরা কি দেখলাম? ফারমার্স ব্যাংক তাদের সব মূলধন হারিয়ে ফেললো। তাদের আবার মূলধন দিলো রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক, যারা নিজেরাই মূলধন ঘাটতিতে আছে। প্রাইভেট ব্যাংকেরও যদি এ অবস্থা হয় তাহলে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার পথে খুবই সমস্যা হবে। হলমার্কের একজনকে জেলে ঢোকানো হলো, কিন্তু পুরোপুরি আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে জেলে ঢোকানো হয়নি। তারপরও অনেক নামি-দামি আছে তারা নির্বিকার ঘুরে বেড়াচ্ছে। বেসিক ব্যাংক বলেন, ফারমার্স ব্যাংক বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পরিচালক বলেন, আবার ঋণ গ্রহিতার কথা বলেন, সবাই নির্বিকার ঘুরে বেড়াচ্ছে। এগুলো তো সব চিহ্নিত। এগুলোই তো হলো মৌলিক। এগুলোকে হাত না দিতে পারলে কিছু হবে না।

কোনো বড় ঋণ অনুমোদন ও পুনঃতফসিলিকরণ করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরে আনা হয়। শোনা যায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আইন-কানুনের মধ্যে পড়ে না তাকেও ঋণ দেওয়া হয়, এসব তো সরকারের ইশারা ছাড়া হয় না।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক যদি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারত এবং পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করতে পারত তাহলে এমন হওয়ার কথা নয়। তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে কেন এমন হচ্ছে, প্রশ্ন উঠতে পারে দক্ষতা নিয়ে। তাদের যদি দক্ষতা কম থাকত তাহলে তা পূরণ করা যেত। কিন্তু এখানে দক্ষতার অভাবেই এমন হচ্ছে এমন বলা যাবে? ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণমূলক কাজগুলো কি স্বাধীনভাবে কাজ করছে? যারা আইন ভায়োলেট করছে তাদের পরিচয় ইগনোর করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই কর্মকর্তাকে কিছু প্রভাব সইতে হচ্ছে, আমলে নিতে হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে তার যে পরিচালন ব্যবস্থা আছে সেটি তো অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে।

দেশের সব দিকে উন্নয়ন হচ্ছে কিন্তু ব্যাংকের কারণে সরকারের এ উন্নয়নের সফলতা ঢেকে যাচ্ছে। সরকার তাহলে যেনেশুনে এমনটা করছে কেন?
এতে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। ব্যাংকিং খাত একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত ছিল। ৯০-এ প্রাইভেট ব্যাংকিং এলো, ব্যাংকের নতুন সেবা এলো, ব্যাংকিং খাতে বিদেশি বিনিয়োগ এলো, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের উওপর নির্ভরতা কমলো, গ্রামগঞ্জে ঋণ দেওয়া শুরু হলো, মাইক্রো ক্রেডিট এলো, ইদানীং মোবাইল ফিন্যান্সিং ও এজেন্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সব মিলে ব্যাংকিং খাতে আমাদের বড় অর্জন আছে। কিছু উদ্ভাবনী মডেল এলো, বহির্বিশ্ব আমাদের ফলো করা শুরু করল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকিং খাত আমাদের হতাশ করেছে। এর জন্য দায়ীর কথা চিন্তা করলে, সরকার তো অত সহজ সরল ব্যাপার না। আমি আরও একটু সুনির্দিষ্ট করে বলতে চাই, ব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত সরকারের লোকজন সার্বিক ভাবমূর্তির চেয়ে নিজের স্বার্থের দিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। সম্পদ, ব্যবসা এসবই প্রাধান্য পাচ্ছে।

এক কথায় ব্যাংকের সঙ্গে যারা যুক্ত আছেন তাদের আল্টিমেটাম দিতে হবে। বলতে হবে এ তোমার কাজ, এর বাইরে যাওয়া যাবে না, সঠিকটা করতে হবে। কাজ করতে গিয়ে কোনো ব্যত্যয় হলে শাস্তি পেতে হবে। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনিয়ম দেখলে ওই ব্যক্তি কে, কি তার পরিচয়, এসব দেখা যাবে না। এটা না করতে পারলে সমস্যা সমস্যাই থেকে যাবে। আর এ সমস্যা নিয়েই চলতে হবে।

 

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ


Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228
Electronic Paper