ঢাকা, বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪ | ৩ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

এতিম পরিবার ও উন্নয়ন ভাবনা

মনিরুজ্জামান
🕐 ৬:৪৯ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ১৪, ২০১৮

কেউ বাস করে আরামদায়ক বাড়িতে যেখানে তার প্রয়োজনের তুলনায় রয়েছে অতিরিক্ত খাদ্য, পোশাক-পরিচ্ছেদ, চিকিৎসা সুবিধা ও আর্থিক নিরাপত্তা। অন্যদিকে পৃথিবীর তিন-চতুর্থাংশ মানুষ এসব সুবিধা হতে বঞ্চিত। তাদের মাথা গোঁজার জন্য আছে ছোট ঘর কিংবা খোলা আকাশ; খাবারের অনিশ্চয়তা, দুর্বল স্বাস্থ্য, লেখাপড়া হতে সুবিধাবঞ্চিত এবং বেঁচে থাকার জন্য নেই কোনো ন্যূনতম জীবিকা। তাদের অনাগত সুন্দর জীবনের সম্ভাবনা বিবর্ণ ও অনিশ্চিত। উন্নত দেশের শিশুরা উন্নয়নশীল দেশের শিশুদের তুলনায় ১৬ গুণ বেশি সম্পদ ভোগ করে থাকে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের বেশিরভাগ শিশু মৌলিক চাহিদাপূরণের সামর্থ্যই নেই।

পৃথিবীতে প্রায় ১৫০ মিলিয়ন এতিম শিশু রয়েছে। প্রতিদিন গড়ে ৫ হাজার ৭৬০ জন শিশু নানা কারণে (যেমন-যুদ্ধবিগ্রহ, মহামারী, দুর্ঘটনা ও অসুস্থতা) এতিম হচ্ছে। এশিয়াতে প্রায় ৩৫০ মিলিয়ন শিশু দরিদ্র সীমার নিচে বাস করে; যার বেশিরভাগ হচ্ছে এতিম শিশু। ভারতে প্রায় ২৫ মিলিয়ন এতিম শিশু রয়েছে। যা পৃথিবীর মধ্যে সর্বোচ্চ। ইউনিসেফের হিসাব মতে, বাংলাদেশে ৪০ লাখ এতিম শিশু রয়েছে, যার অর্ধেক শিশু চরম দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করে। এসব শিশুর খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, বিনোদন, সুরক্ষা ও নিরাপত্তা সুবিধা অপ্রতুল।
পারিবারিক আয়ের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশে এতিম পরিবারকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। ১, উচ্চ আয় সম্পন্ন এতিম পরিবার, যেখানে শিশুরা তাদের উত্তরাধিকার সম্পত্তি, আর্থিক সচ্ছলতা ও মায়ের ভালোবাসার ওপর ভিত্তি করে বেড়ে উঠে এবং বেঁচে থাকা, সুরক্ষা ও বিকাশের পূর্ণ সুযোগ পায়। ২, মধ্যম আয় সম্পন্ন এতিম পরিবার, উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তি, আত্মীয়স্বজনের সহযোগিতা ইত্যাদির মাধ্যমে জীবনযাপন করে থাকে। এসব পরিবার তাদের শিশুদের শিক্ষা, সুরক্ষা ও বিকাশের সুযোগ তৈরি করতে পারে। ৩, নিম্নআয় সম্পন্ন এতিম পরিবার, যারা আত্মীয়স্বজন ও সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতার ওপর নির্ভরশীল। এ ছাড়া জাকাত, অনুদান ও অন্যের বাড়িতে থেকে জীবনযাপন করে। এসব পরিবারের বেশিরভাগ শিশু শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকে। ফলে এসব শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে যুক্ত কিংবা অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হয়, যা বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য অন্তরায়।
আমাদের দেশে এতিম পরিবারকে সহযোগিতার জন্য দুই ধরনের পন্থা রয়েছে। এক হচ্ছে সামাজিক বা অপ্রাতিষ্ঠানিক পন্থা। যেখানে শিশুকে মা অথবা পরিবারের সঙ্গে রেখে বিভিন্ন সহযোগিতার মাধ্যমে শিশুর শিক্ষা, সুরক্ষা ও সুষ্ঠু বিকাশের পথ তৈরি করা হয়। অপরদিকে আছে, প্রাতিষ্ঠানিক পন্থা যেখানে শিশুকে সরকারি-বেসরকারি এমিতখানা কিংবা শিশু নিবাসে রেখে তার শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা নিশ্চয়তা দেওয়া হয়। এখানে শিশু, তার মা ও পরিবারের স্নেহ ও ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়, যা তার সুষ্ঠু বিকাশের জন্য সহায়ক নয়।
এতিম পরিবারের উন্নয়নের জন্য সরকারের রয়েছে বিশেষ সহায়তা, যেমন বিধবা ভাতা, নিঃসঙ্গ ও স্বামী পরিত্যক্ত ভাতা, এতিমখানার জন্য সরকারি অনুদান, বেসরকারি এতিমখানার ছাত্রদের জন্য রয়েছে সরকার আর্থিক সুবিধা। আমাদের দেশে বেশিরভাগ এতিম শিশু সরকারি-বেসরকারি প্রাতিষ্ঠানিক এতিমখানার মধ্য দিয়ে বড় হয়ে থাকে। যেখানে শিশুর সুরক্ষা ও নিরাপত্তা বিশেষভাবে বিঘ্নিত হয়। মা ও পরিবারের আদর, স্নেহ ও ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়।
গবেষণা মতে, এতিমখানাভিত্তিক সহযোগিতা শিশুদের বিকাশ ও সুরক্ষার জন্য খুব বেশি সহায়ক নয়। দরিদ্র এতিম শিশুদের লেখাপড়া, শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য গ্রহণযোগ্য পন্থা হলো শিশুকে তার পরিবারে রেখে মা ও পরিবারের স্নেহ ও ভালোবাসায় সিক্ত করে শিশুকে বড় করা। এর পাশাপাশি দক্ষতা বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণ দেওয়া, আর্থিক সহায়তা প্রদান করা, উৎপাদনমুখী সম্পদ প্রদান, সচেতনতা বৃদ্ধি করা যা এতিম পরিবারকে উন্নয়নের মূল স্রোত ধারায় সম্পৃক্ত করতে পারে।
এতিম পরিবারকে উন্নয়নের মূল স্রোত ধারায় সম্পৃক্ত করার জন্য নিম্নলিখিত সুপারিশমালা দেওয়া যেতে পারে।
১, সরকারি বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা এবং সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনিতে এতিম পরিবারে সাহায্যের সংখ্যা বাড়ানো যাতে শিশুদের শিক্ষাসহ পরিবারের মৌলিক চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয়। ২, এতিম পরিবারের টেকসই উন্নয়নের জন্য কার্যকরী মডেল অনুসন্ধান ও অনুসরণ করা। ৩, সমাজভিত্তিক পন্থায় এতিম পরিবারকে সাহায্য করা যাতে তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে বিকাশ ঘটাতে পারে। ৪, সরকারি-বেসরকারি সংস্থার মধ্যে সমন্বয় বৃদ্ধি করা। ৫, প্রশিক্ষণসহ আয় বৃদ্ধিমূলক সম্পদ প্রদান করা যাতে পরিবারের টেকসই উন্নয়ন করতে পারে। ৬, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি এতিমখানার শিক্ষকদের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করা এবং ৭, এতিম পরিবারদের জাতীয় তথ্য ভাণ্ডার তৈরি করা যা পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে সহায়তা করবে।
শিশুরা যে দেশে জন্মগ্রহণ করুক, যেখানেই বেড়ে উঠুক, মৌলিক চাহিদা পূরণসহ সুরক্ষা, অংশগ্রহণ ও সুষ্ঠুভাবে বিকাশের পূর্ণ অধিকার তাদের রয়েছে। সুবিধাবঞ্চিত প্রতিটি শিশুর সুরক্ষা ও সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার লক্ষ্যে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে একযোগে ভূমিকা রাখতে হবে। আগামী দিনে প্রতিটি শিশুর বিচরণ ক্ষেত্র হোক নিরাপদ, সুরক্ষিত ও আনন্দপূর্ণ এ হোক আমাদের সবার প্রত্যাশা।

মনিরুজ্জামান, উন্নয়ন কর্মী।

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ


Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228
Electronic Paper