ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

অমাবস্যায় পূর্ণিমার ছায়া

অঞ্জন আচার্য
🕐 ২:৫৮ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২৮, ২০২২

অমাবস্যায় পূর্ণিমার ছায়া

আনন্দপুরের নামটি কে কবে কখন দিয়েছেন, তা ইতিহাসে নেই। তবে নামের সঙ্গে এই গ্রামের খুব কমই মিল আছে। কারণ, গ্রামের সবাই যে খুব সুখে-শান্তিতে বাস করে, এমনটা নয়। আর দশটা গ্রামের সঙ্গে এর খুব বেশি তফাতও নেই। কল্পনায় গ্রাম যেমন থাকে। খোলা মাঠ, ধানখেত, কাঁচা-পাকা রাস্তা, একপাশে সরু নদী, নদীতে নৌকা চলা, ন্যাংটা ন্যাংটা ছেলেরা নদীর জলে ঝাঁপাঝাঁপি করে, চিত সাঁতার কাটে। সেই আনন্দপুরের আজ বেজায় নিরানন্দের দিন। মোহন রায়ের আমবাগানের সবচেয়ে বুড়ো গাছটি কাটা হচ্ছে। সেই গাছকাটা দেখতে পুরো আনন্দপুরে যেন কৌতূহলের শেষ নেই। তবে ভজন পাগলা অন্য সব দিনের মতোই আজও আনন্দে আটখানা। গাছকাটা দেখে ভজনের নাচ কে দেখে!

আবোলতাবোল মুখে যা আসে, বলতে থাকে : আম খাস, গাম পাস। গাছকাটা, মাছবাটা। হাহহা, হাহহা!
ভিড়ের এক পাশে গামছা পেতে বসা ছিল পাঁচুগোপাল। বয়স ষাটের কম হবে না। আক্ষেপের স্বরে হঠাৎ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, আহা রে! সেই ছোটবেলার আমগাছ! এই গাছের আম আর খাওয়া হবে না! কত কত স্মৃতি। আহা রে!
পাশেই বিড়ি ফুঁকছিল হারিছ মিয়া। তার আক্ষেপটা আরেকটু বেশি। তার বউ ময়না বিবি এই গাছের আম খেতে খুব ভালোবাসত। সুন্দরবনের চাক ভাঙা মধুর মতো আম। গত বছর করোনায় মারা পড়ল ময়না। আমগাছটি দেখে দেখে ময়নাকে মাঝে মধ্যে মনে করত হারিছ। এখন তা-ও গেল।
-আজ কী বার রে হারিছ? উদাস কণ্ঠে জানতে চায় পাঁচুগোপাল।
-শনিবার। কেন কাকা? হারিছ জিজ্ঞেস করে।
-আজকাল সব গেছে। কোনো শনি-মঙ্গলবার আর মানা হয় না। এমন একটা কাজ করা হচ্ছে, তা-ও আবার এই শনিবারে। মোহন কি ধম্মকম্ম সব ছেড়ে দিয়েছে? বার-লগ্নও আর মানে না!
-শনিবারে কাটলে কী হয় কাকা? হারিছ রসিকতার সুরে প্রশ্নটি করে।
-তোরা বুঝবি না। তোরা হচ্ছিস এই কালের পোলাপান। তোদের কাছে শনিবারই কী শুক্কুরবারই কী! সব এক।
পাঁচু কাকার দুঃখ বুঝতে পেরেছে, এমন ভান ধরে হারিছ বলে, কী আর করবে? মোহন কাকা যা ভালো মেনেছেন, তাই করেছেন।
-ধম্মে সইবে না রে! ধম্মে সইবে না। শনিবারে এমন অমঙ্গলের কাজটা মোহন না করলেও পারত?
এমন সময় এক বাচ্চা ছেলে, সম্ভবত পঙ্কজ নাপিতের ছেলেটিই হবে, চেঁচিয়ে উঠল, সাপ, সাপ!
সবার নজর গাছকাটা থেকে একপলকের জন্য বাচ্চাটার কণ্ঠের দিকে চলে যায়। হারিছ দৌড়ে যায় বাচ্চাটার কাছে।
-কই সাপ?
-ওই যে দেখো হারিছ কাকা। কত্ত বড় সাপ। হাঁ-করা মুখের ছেলেটির যেন বিস্ময়ের অন্ত নেই।
হারিছ একটা বাচ্চা ঢোঁড়া সাপ দেখে বড় হতাশ হয়ে সন্তুর মাথায় একটা গাট্টা মেরে বলল, এই কলিজা নিয়া ঘুমাস কী করে? যা ভাগ!
সন্তু যেন হাঁপ ছেড়ে পালায়, গাছ কাটার ভিড়ে নিজেকে মিলিয়ে বাঁচে।
সাপটি পিলপিল করে রাস্তার পাশের বাঁশঝাড়ের ডোবার পাশ দিয়ে বেয়ে অদৃশ্য হয়।
হারিছ এসে আবার পাঁচুগোপালের পাশে বসে গাছকাটা দেখে। দূরে একটা জানালা ফাঁক করে গাছকাটা দেখে নিত্যানন্দ মাস্টারের নতুন বউটি। নিত্যর দ্বিতীয় বউটির নাম শতরূপা। নামটা বড় সুন্দর। তবে দেখতে হাতির পাছার মতো। চোখ-মুখ সবই আছে, তারপরেও কীসে যেন খামতি আছে। গায়ের রং পোড়া কড়াইয়ের মতো, গড়নটা বাঁধানো। দেখলে পড়ে দুবার তাকাতে ইচ্ছে করে না। হারিছ বুঝল, দিনটা আজ খারাপই যাবে। একে তো মোহন কাকার আমগাছটা কাটা হচ্ছে, তার ওপর সেই নতুন বউ, যাকে দেখলেই হারিছের দিনটাই মাটি হয়ে যায়।

বাজটা সম্ভবত সাতলার মাঠেই পড়েছে। কিন্তু কেউ এই বাজ পড়ার কারণ খুঁজে পায় না। এই গনগনে রোদের ভরদুপুরে বাজ পড়তে যাবে কোন দুঃখে? এমন বিকট শব্দ আনন্দপুরের কেউ আগে কখনো শোনেনি। গুলির শব্দ শুনেছে, বোমার শব্দও শুনেছে ইলেকশনের সময়। কিন্তু এ কীসের শব্দ? সবার ঘোরদোর কেঁপে ওঠে। এমনকি টেবিলের ওপরে রাখা কাচের গ্লাসটা পর্যন্ত পড়ে ভেঙে পড়ে লুৎফাদের বাড়িতে। কে যেন প্রথমে বলল কথাটা : আকাশ থেকে রকেট পড়ছে!
রকেট? আকাশ থেকে? কোথায়? কোথায় পড়েছে?
একে একে সবার কৌতূহল জড়ো হতে থাকে। রকেট পড়ছে। রকেট পড়ছে।
আরে ধুর, রকেট কি পড়ে নাকি? ওটা তো চাঁদে যায়। ওইটা চাঁদে গিয়া পড়ে। বল, বিমান পড়ছে।
শব্দের সন্ধানে সাতলার মাঠের দিকে ছুট লাগায় সবাই। হারিছকে আর পায় কে? এক দৌড়ে মাঠে পৌঁছায় সে। গিয়ে দেখে আজব কাণ্ড! ইয়া মস্ত বড় একটা হেলিকপ্টার উপুড় হয়ে পড়ে আছে। ভেতর থেকে আগুন আর ধোঁয়া বের হচ্ছে। দাবানলের মতো সেই খবর পৌঁছে যায় আনন্দপুরের প্রতিটি ঘরে। দলবেঁধে সব ছুটতে শুরু করে সাতলার মাঠের দিকে। এর মধ্যেই কে কার আগে যাবে, এ নিয়ে হুড়োহুড়ি লেগে যায়।
মোবাইল ফোনে ভিডিও করার হিড়িক পড়ে যায় রোনালদো ছাঁটে চুলকাটা পোলাপানদের মধ্যে। কেউ কেউ সেলফি তুলে সঙ্গে সঙ্গে ফেসবুকে পোস্ট দিচ্ছে। বেশির ভাগই ফেসবুকে লাইভ করছে। জ¦লন্ত হেলিকপ্টার দেখে আনন্দপুরের আনন্দ যেন ধরে না! মোহন রায়ের আমগাছ কাটার শোক কখন উবে যায়! আকাশের ওপর দিয়ে চলে যাওয়া হেলিকপ্টার আজ তাদের চোখের সামনে।
-ভেতরে মানুষ আছে। কেউ একজন বলল।
-হ হ, আছে, ভেতরে মানুষ আছে।
-আহা রে, পানি নিয়া আয় কেউ।
কেউ পানি নিয়ে আসে না। সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত থাকে। দাউদাউ করে আগুন জ¦লতে থাকে। নেভানোর কারও কোনো দায় নেই, বালাইও নেই। পুড়ে মানুষগুলো কয়লা হয়ে যাচ্ছে। আণ্ডাবাচ্চা ছেলেমেয়ে, বুড়োবুড়ি, বাড়ির বউ- কেউ বাদ যায় না! সবাই এসে ভিড় জমায় মাঠের চারপাশে। এ যেন বিরাট প্যান্ডেল টাঙিয়ে সার্কাস খেলা দেখানো হচ্ছে। সবার চোখই ছানাবড়া। কেউ কেউ শাড়ির আঁচল চেপে হাপিত্যেস করছে। ভজন পাগলাও এসে সেখানে হাজির। আগুন দেখে তার মাথা বিগড়ে যায়। নেভানোর জন্য উতলা হয়ে পড়ে। কোথাও কিছু না পেয়ে লুঙ্গি তুলে পেচ্ছাব করতে শুরু করে হেলিকপ্টারটাকে লক্ষ করে। ভাবখানা এমন, তার পেচ্ছাবে এত বড় আগুন নিভে যাবে।
ভজন পাগলার এমন কাণ্ড দেখে হাসির রোল ওঠে। বাড়ির বউ-ঝিরাও মুখ টিপে টিপে লজ্জায় হাসে।

টাউন থেকে দমকল বাহিনী যখন আসে, তখন সাতলার মাঠ আর মাঠ থাকে না। হাজারো মানুষের জমায়েত। পাশেই ঝালমুড়ির দোকান বসে গেছে। একজন তো টেবিল পেতে পান-বিড়ির দোকান বসিয়ে দিব্যি বেচাবিক্রি করছে। সাতলার মাঠ আজ যেন মেলার মাঠ। চুড়ি-ফিতা-বালা-খেলনার দোকান বসলেও কেউ কিছু মনে করত না। হুইসেল বাজিয়ে দমকল বাহিনী এসে হাজির হয় মাঠের এক পাশে। সঙ্গে এক গাড়ি পুলিশ। পুলিশ এসেই বাঁশি বাজাতে থাকে। রাস্তা খালি করতে বলে। রাস্তা খালি করবে কী? আশপাশের বাড়ির টিনের চাল, গাছের ডাল কোত্থাও তিল ধরার ঠাঁই নেই। নিত্য মাস্টারের বউটিও সেখানে উপস্থিত। ভিড়ের মধ্যে ঠিকই হারিছের চোখে পড়ে যায় সেটা। মনে মনে সে ভাবে, ওই খানকি মাগির জন্যই আজকে অমঙ্গল লাগছে। ওটারে একবার বাগে পাইলে পোয়াতি করে ছেড়ে দিত হারিছ। মনের ইচ্ছা মনেই থাকে।
অনেক চেষ্টায় একসময় আগুন নেভে। খবর পেয়ে একটা অ্যাম্বুলেন্স হাজির হয় সেখানে হুইসেল বাজিয়ে। পুলিশ পুরো এলাকা ঘিরে রাখে। হেলিকপ্টারের কাছে কাউকে ঘেঁষতে দেয় না। ভেতর থেকে কয়লার মতো ডেডবডি বের করা হয়। এর মধ্যে একটা মেয়ে, আরেকটা ছেলের লাশ। লাশ দুটিকে সাদা অ্যাপ্রনে ঢেকে অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হয়। লাশ পোড়ার উৎকট গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। গন্ধটা হারিছের নাকে গেলে বগবগ করে বমি করে ফেলে। হারিছের বমি দেখে কোত্থেকে যেন দৌড়ে এসে সামনে দাঁড়ায় শতরূপা।
-শরীর খারাপ লাগছে? আসেন আমার সঙ্গে। ওই কলের পাড়ে আসেন। বলে হাত ধরে টেনে তোলে হারিছকে। এই দৃশ্য দেখে কে কী ভাবল, তাতে তার কোনো তোয়াক্কাই নেই।
টিউবকলের পাশে ‘দ’ হয়ে বসে থাকে হারিছ। কল চেপে চেপে শতরূপা পানি ছিটিয়ে দেয় হারিছের চোখে-মুখে।
-জল খান হারিছ ভাই। ভালো লাগবে।
বিস্মিত হওয়ারও শক্তি পায় না হারিছ। আবারও বমি আসে। সকালে খাওয়া ডালভাত বমি হয়ে বের হয়।
-একটু জল খান আপনে। ভালো লাগবে। শতরূপার কণ্ঠে আকুতি।
শতরূপার হাতের তালুতে বন্দি এক আঁজলা পানি। সেটি ধরা আছে হারিছের মুখের সামনে। কিন্তু মাথা তুলে তাকাতে পারে না হারিছ। আঁজলায় রাখা পানিতে একটি মুখ দেখতে পায় সে। লক্ষ্মীপূর্ণিমার রাতে পচা ডোবার জলে চাঁদের এমন ছায়া পড়ে।

 
Electronic Paper