ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ভিন্ন গভীরে কতগুলো মাছ

জোবায়ের মিলন
🕐 ১১:৫৪ পূর্বাহ্ণ, ডিসেম্বর ৩১, ২০২১

ভিন্ন গভীরে কতগুলো মাছ

আমিত্ব আমিত্ব করে যখন জাপানের হিরোশিমা আর নাগাসাকির মতো পুড়ছে পুরো জাহান তখন এক কবি ‘আমি’কে খুঁজছেন তন্নতন্ন করে। আমির ভেতরের যে আমি, তাকে সন্ধান করছেন আমির দেয়াল ভেঙে। কিন্তু, আমি কে? আমি কেন? আমি কী? আমি কার? এসব চিরজিজ্ঞাসার সন্ধান কি মেলে সহজে? কঠিন যতই হোক কেউ কেউ ‘আমি’টাকে ধরতে চান, ছুঁতে চান আমির ভেতরে থেকেই বা আমিত্বকে চিরদিনের জন্য ছুড়ে ফেলে।

ফিরোজ আলম সেই আমির ভেতরের ‘আমি’কে দেখতে চেয়েছেন তার কবিতাগ্রন্থ ‘প্রতিবিম্বের প্রতিবিম্ব’ এর তত্ত্ব-কথার কথালাপেÑ কবিতা কাঠামোর মধ্য দিয়ে। তিনি লিখেছেন, ‘ঝর্ণা ঝরি বৃষ্টি পড়ি কিংবা একটা বাঁশের পাতা/ চৈত্র মাসের হঠাৎ বায়ে উড়ে এসে আরেক গাঁয়/ খসে পড়ি এক গেরস্থের আঙিনায়!/ কিংবা একটু শিমুল তুলো ডালা ছেড়ে আত্মভোলা/ উড়ছি উড়ছি পশ্চিম থেকে দখিন বায়!/ কিংবা একটু পথের ধুলো নির্জনা এক পথের ধারে/ পড়ে আছি ঘাসের ছায়,/ অন্য কোথাও ছড়িয়ে পড়ি জড়িয়ে কোনো পথিক পায়।/ একটা পাখির ওড়ন কালে খসে পড়া একটি পালক/ কিংবা আমি ঝুপড়ি ঘরের বেড়ার ফাঁকে/ ঠিকরে পড়া কয়েক টুকরো কুপির আলোক।/ কী জানি গো কে গো আমি দুর্বোধ্য এ জীবন এক/ আঁকতে গেলে পাই না কিছু, পাই শুধু এক অ্যাবস্ট্রাক্ট।’ ( অ্যাবস্ট্রাক্ট)। এই পাই আর পাই না’র ভেতর ফিরোজ আলম পাওয়ার জন্যই হাহাকার করেছেন। এর ভেতর যে কী অদ্ভুত পাওয়া আছে তা এই কবি বুঝাতে চেয়েছেন কখনো পাওয়া, কখনো না-পাওয়ার কথা বলে। কিন্তু দিনশেষে ‘আমি’টার পেছনে ছুটে চলা। আমি’টা কি আসলে ধরা দেয়? এই আমি’টা কত দূরেই-বা থাকে, কত কাছেই-বা ঘুরে বেড়ায়? মারফত কিংবা শরিয়ত কিংবা হকিকত, মানব-তত্ত্ব কিংবা তরিকত কোথায় ‘আমি’র বসবাস, কোথায় গেলে ‘আমি’কে পরমে পাওয়া যায় তা কি আজও নির্ণিত হয়েছে? হবে? নাকি এই ‘আমি’র পেছনে কাল-মহাকাল ধরে ‘আমি’ সন্ধানীরা খুঁড়ে যাবেন আপনসত্তার আত্মভূগোল? ‘আমি’কে হয়তো ধরা যায়, হয়তো ধরা যায় না কিন্তু ‘আমি’র জন্য অনেক সত্তা ফানাফিল্লা, বাকাবিল্লায় অস্থির! তারা ‘আমি’টাকে অদূর থেকে না হোক দূর থেকে হলেও দেখতে চান, নিজেকে বিলিয়ে দিতে চান ‘আমি’র সঙ্গে। তাই তো বড় ঘোর, বড় বিস্ময়, বড় প্রশ্ন জেগে থাকে বিমূর্ত মনে। ‘সাধ্য কি তা বীজের দানার ফলের বুকে থেকে জানার/ কোন পাখিটি খাবে তারে পড়বে গিয়ে কোনখানে?/ কোন আঁধারের জলের কণা মেঘ হয়ে সে বৃষ্টি কনা/ সাধ্য কি সে জানতে পারে ঝরবে গিয়ে কোনখানে?/ ...কোথা থেকে আসে তারা জানি না. কোথায় ভেসে যাচ্ছে তারা জানি না. কেউ কি জানো আমি ভেসে যাচ্ছি আবার কোনখানে?/ কালের হাতে কী লেখা তা কে জানে!’ ( কালের খাতা)। ‘জন্ম এবং মৃত্যু’ এর কিছুই জানি না আমরা। তবু জন্মায়, তবু মৃত্যু হয় অমোঘ সত্যকে স্বীকার করে। কবি সে সত্যকে আঁকতে চেয়েছেন। কবিতার মাধ্যমে নানান প্রশ্ন আর জানতে চাওয়ার মধ্য দিয়ে কবি আদতে নিজেকেই জানতে চেয়েছেন। নিজের ভেতরে যে আরেকটা ‘নিজ’ তাকে বুঝতে চেয়েছেন। ফুল-পাখি-লতা-পাতা, জাগতিক প্রেম-ভালোবাসা, হত্যা-রাজনীতি নিয়ে সবাই যখন রচে চলেছেন সময় তখন কবি ফিরোজ আলম লিখছেন পরমের সন্ধান; যেন তা ভিন্ন গভীরে কতগুলো জীবন্ত মাছ। ‘তারে দেখে কাব্য লিখি/ সেও কি তবে আমায় দেখে কাব্য লেখে?/ আমিও তো তারই মতো গেঁয়ে নদী/ চলছি বয়ে কয়েক দশক সঙ্গে নিয়ে কালের স্রোত/ দিন রাত্রির বাঁকে বাঁকে সঙ্গে নিয়ে নদীর মতো কত কথা!/ নদী আমি মুখোমুখি/ ...নদী ভাবে আমি নদী, আমি ভাবি নদী নদী/ নদী নদীর নাম জানে না/ আমিও আমার নাম জানি না।’ (আমি আমার নাম জানি না)। ধ্যানী এই কবির উপলব্ধিতে ‘আমি’ প্রায় অস্তিত্বহীন। অথচ এই ‘আমি’ই হয়ে আছে মহাকাল ও মহাজীবনের কেন্দ্রবিন্দু। কবি এই ‘আমি’র খেলায় কখনো নিজেই জড়িয়ে পড়েছেন আবার কখনো তা অবলোকন করেছেন উদাসীনতার সঙ্গে দূরে থেকে। ‘প্রতিবিম্বের প্রতিবিম্ব’ কাব্যগ্রন্থটির প্রায় সমগ্রজুড়ে ‘আমি’র সঙ্গে বোঝাপড়া করে পাঠককে জীবনবোধের আরও একধাপ গভীরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন গভীরভাবে। গ্রন্থস্থ ৭২টি কবিতার মধ্যে বেশ কয়েকটি কবিতায় দু’চারটি বানান ভুল, ছন্দের তালহীনতা ও অনাহুত শব্দের ব্যবহার মাঝে মধ্যে বিভ্রাট সৃষ্টি করলেও অন্তর্নিহিত তাৎপর্যের কারণে এগুলো পাশ কাটিয়ে যেতে অসুবিধা হয়নি।


প্রতিবিম্বের প্রতিবিম্ব
ফিরোজ আলম
প্রচ্ছদ : চারু পিন্টু
প্রকাশক : শব্দনীড় প্রকাশন
প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি, ২০২১
মূল্য : ২৫০ টাকা

 
Electronic Paper