অপরাহ্ণের কান্না
মাহবুব আলী
🕐 ১২:৫০ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ২৪, ২০২১

আজকেও কাজ হয়নি। অশ্বিনী ঘুরিয়ে দিল। কতদিন আর আসা-যাওয়া করতে হবে কে জানে। নিলুর দু-চোখ বিমর্ষ। আকাশের তাপদাহ ভবনের বাইরে সবকিছু অসহনীয় করে তুলেছে। সে কিছু বলে না। কী বলবে? বললেই বা শোনে কে? অবশেষে একটুকরো হালকা হাসি ছড়িয়ে মিথ্যে সান্ত¡না খুঁজে নেয়।
‘বড় সাহেবের কাজ তো এক মিনিটের, কিন্তু লোকটি বসছেনই না। আজ এখানে-কাল ওখানে করে বেড়াচ্ছেন। আপনি না হয় আগামী রবি-সোমের দিকে আরেকবার খোঁজ করেন।’
‘অনেক দূর থেকে আসতে হয় দাদা; তা ছাড়া স্কুলে ছুটি পাওয়া যায় না। হেডমিস্ট্রেস খুব কড়া।’
‘আচ্ছা এবার দেখে রাখব।’
‘এক কাজ করলে হয় না... আমি কল করে খোঁজ নিয়ে আসতাম? আসতে-যেতেও বেশ খরচ।’
‘হ্যাঁ-হ্যাঁ মোবাইল করে আসেন।’
‘আজকে কল দিয়েছিলাম দাদা... আপনি হয়তো ব্যস্ত ছিলেন।’
‘ওহ্ হো... মোবাইল ফোন সাইলেন্ট করে রেখেছিলাম, টের পাইনি।’
অশ্বিনী প্যান্টের পকেট থেকে অ্যান্ড্রয়েড বের করে আনে। চোখের দৃষ্টি সরু করে নম্বর সার্চ চলে কিছুক্ষণ। আলোর ঝলকানিতে বাই-ফোকাল চশমার স্বচ্ছ কাচে প্রতিবিম্বিত হাজার নম্বর।
‘আপনার নম্বরের শেষে কি তের?’
নিলু মাথা কাত করে সম্মতি জানায়। সে নিশ্চিত ছিল, অশ্বিনী মোবাইল ফোন ধরবে না; তারপরও কল দিয়েছিল। ডিপার্টমেন্টের ক্ষমতাধর করণিক। ছোট পোস্ট, কিন্তু বড় সাহেবের খাস মানুষ। প্রায় অফিসেই বড় সাহেবের দু-একজন পেয়ারের মানুষ থাকে। এরা ডানহাত, বাঁ-হাতের যত এদিক-ওদিক সব সামাল দেওয়া আসল কাজ। অশ্বিনী সারাদিন ডজন ডজন কল রিসিভ করে। নিলুর নম্বরও অচেনা। মানুষজন অপরিচিত নম্বরের কল প্রায়শ রিজেক্ট করে। নিলু সেই বোধ সত্ত্বেও অফিসের নোটিস বোর্ড থেকে নম্বর তুলে রেখেছিল। কখন কোন প্রয়োজন পড়ে কল দেবে। সেই কল সত্যি সত্যি রিসিভ হবে কি হবে না আশা-নিরাশার দোলাচলে থেকে থেকে অবশেষে সবুজ বাটনে চাপ দেয়। প্রত্যুত্তরে কিছুক্ষণ বি-ই-প্ বি-ই-প্ শব্দ হয় মাত্র। টামি আউট। আসলে সময় কোথায়? এসবই যদি করবে তো গান শুনবে কখন? নিলু এর আগেরবার এসে দেখে, অশ্বিনী সামনে খবরের কাগজ মেলে ধরে ভিডিও দেখছে। সম্ভবত টিকটক ফানি ভিডিও। আজকাল এসবই সৃজনশীল কাজ। নিলু আজ টেবিলের সামনে দাঁড়ালে, একটি কথাও বলে না লোকটি; অথচ এই নিয়ে সাত-আটবার আসা হলো। এদের হাতেই ক্ষমতা। নিলু বেশ অস্থির হতাশ, আশ্চর্য তবু মুখছবিতে হাসি ধরে রেখেছে; মোলায়েম স্বরে জবাব দেয়।
‘হ্যাঁ দাদা তের... আনলাকি থার্টিন।’
‘কী যে বলেন, আনলাকি কেন? সরকারি চাকরি পেয়েছেন; লাক তো খুলে গেছে।’
নিলু আবার একটু হাসে। বুকের সকল কান্না হাসিতে ভুলিয়ে দেওয়া যায় না। নিজের প্রতি খুব করুণা জাগে তার। কত দিন কত মাস, না না কত বছর ধরে চেষ্টা। একটি চাকরি দরকার। রাত আর দিন দু-চোখের কোল কালি করে প্রস্তুতি। তিন তিনবার পরীক্ষা দেওয়া হয়। ভাইভা-বোর্ডে তিনবার মুখোমুখি। বিবিধ প্রশ্নের জবাব। বোর্ড সদস্যের কেউ কাগজ-কলম এগিয়ে দেয়। একটি-দুটি অঙ্ক করার নির্দেশ। কখনো বাংলা চার-চারটি বাক্য ইংরেজিতে অনুবাদ করার পরীক্ষা। নিলু তাই করে।
‘কো-কারিকুলাম অ্যাকটিভিটিজ জানেন? দেশাত্মবোধক একটি গান করুন তো?’
‘ওহ্ হো, দিনাজপুরের আদিবাসী সাঁওতালি নৃত্যের দু-একটি পদক্ষেপ ডেমো দেখান।’
নিলু আঁচল কোমরে জড়িয়ে নেয়। জীবনে কোনোদিন নাচের স্টেপ দেয়নি, তেমনভাবে গানও নয়; তার তবু চাকরি হয় না। আসলে তখন অনার্স থার্ড ইয়ার। ভাইভায় প্রথম জিজ্ঞাসা, ‘কী করো?’ নিলু মিথ্যে বলে না... বলতে পারে না। জগৎ এখন অন্যরকম, মিথ্যে প্রহসনের মধ্যে সত্য-মিথ্যে বোঝা মুশকিল; তাই সত্যের দাম নেই। তার সকল প্রস্তুতি আর প্রত্যাশা দপ করে নিভে যায়। একইসঙ্গে আসা অন্য মেয়েছেলের মধ্যে কারও কারও চাকরি হয়। তারা নিশ্চয়ই অনেক মেধাবী। কেউ অর্থশালী পরিবারের সন্তান। কত টাকা লাগে দেওয়া যাবে। দশ-পনের লাখ কোনো ব্যাপারই না। আনিসা সে-কথাই বলেছিল। তার চাকরি হয়েছে। এ দেশে টাকায় কী না হয়! এরপর মুক্তিযোদ্ধা কোটা, পোষ্য কোটা, প্রতিবন্ধী কোটা; নিলুর কোনো কোটা নেই। নিম্নবিত্ত পরিবারের কোনো কোটা থাকে না। সাধারণভাবে শুধু মহিলা কোটা দশ পার্সেন্ট। সে-সব পুরনো দিনের তিক্ত স্মৃতি মন থেকে ঝেড়ে মুছে ফেলে দিয়েছে অথবা দেয়নি, মুছে ফেলা সম্ভব নয়, বুকের গোপন কুঠরিতে জমা থাকে সারাজীবন। সেই স্মৃতি-অভিজ্ঞতা কেন আর জাগিয়ে তোলা? এই ভেবে ভেবে কয়েকদিন ভালোই ছিল, কিন্তু আবার ফিরে আসতে হয়েছে; আবেদনের খবর কী? অথচ ফলোআপ নিতে নিতে ক্লান্তি আর হীনম্মন্যতার বিবর গ্রাস করে ফেলতে চায়। কী করবে সে?
সে আর একবার রুমের চারপাশে অলস তাকিয়ে নেয়। তিনটি টেবিল। একটির উপর কম্পিউটার, সেটির সামনে ধুলোয় ম্লান কী-বোর্ড; এটির অজুহাত দিয়েছে অশ্বিনী। কম্পিউটার নষ্ট। কাজ করতে পারেনি। ফরওয়ার্ডিং চিঠি কম্পোজ হয়ে গেলে বড় সাহেবের স্বাক্ষর নিতে এক-দু-মিনিটের ব্যাপার। পশ্চিমে টেবিলের ওপাশে বসে থাকা এক বয়সী মানুষ, গালভরতি দাড়ি, কয়েকবার নিলুর দিকে চোখ রাখে। সেইদিন বলেছিলেন, ‘মা-মনি এদিকে একটু শুনে যাও তো।’
‘জি।’
‘তোমার নাম কী? নতুন অ্যাপয়নমেন্ট?’
‘আমার নাম নিলুফা আকতার, স্যার। নতুন জয়েন করেছি।’
তিনি কাগজপত্র বের করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন। তার হাতে কে কোথায় পোস্টিং তালিকা। অফিসে অনেক ভিড়। নতুন নিয়োগের কাজ সাজ-সাজ ব্যস্ততায় এগিয়ে চলে। সকলের চোখে-মুখে অসম্ভব কোনোকিছু প্রাপ্তির আনন্দধারা। কারও সঙ্গে অভিভাবক এসেছে। নিলুর সঙ্গে কেউ আসেনি। কে আসবে? বাবা বিছানায় পড়ে গেছে বছর পেরিয়ে গেল। মা কিছু বোঝে না। ছোট দুই ভাইবোন মুখপানে তাকিয়ে থাকে। নিলুর টিউশনির দিন বুঝি শেষ হয় হয়। আর কি কোনো শুভদিন আছে? সে-সব তো স্বপ্ন। সে বোধকরি তেমন স্বপ্নের ঘোরে ভেসে যায় তখন।
‘তোমার তো বিএড আছে মা। প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের স্কেল পাবে।’
নিলু আরও এগিয়ে সামনে দাঁড়ায়। পৃথিবীতে সব মানুষ খারাপ নয়, ভালো মানুষও আছে; তার পরামর্শেই আবেদন করেছিল। যেহেতু বিএড আছে... সুতরাং পিটিআই গ্রেড পাওয়ার উপযুক্ত। বেতন স্কেলে দু-তিন শত টাকা সংযোজন হয়। অশ্বিনী বলেছিল, ‘এ তো ন্যায্য পাওনা, আপনি পাবেন; আবেদন করুন।’
নিলু যথারীতি আবেদন করে বসে রইল এক মাস। তার ধারণা ছিল না, কোথাও কোনো আবেদন করে সেখানে ধাক্কা দিতে হয়; নইলে গাড়ি চলে না। একদিন সেই কথা জানিয়ে দেয় আনিসা। জীবনযাপনের কঠিন এই দিনকালে দু-তিন শত টাকা তেমনকিছু নয়, কিন্তু সিনিয়রিটি আর মর্যাদার কথা। তার উপর হেড করণিক যখন পরামর্শ দিলেন, নিলু থেমে থাকেনি; সেই আবেদন পড়ে আছে তিন-চার মাস। এখানে সই-স্বাক্ষর হলে উপজেলায় নিয়ে যেতে হবে, কম্পিউটার ডাটায় ইনপুট ইত্যাদি; এই করতে করতে হয়তো অর্থবছর শেষ। অশ্বিনী এদিক-ওদিক তাকিয়ে ফিসফিস করে, ‘ম্যাডাম, এত কাজ করা হলো, স্কেল তো চেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে, মিষ্টি খাওয়ান।’
‘ঠিক আছে দাদা, আগামীবারে এক কিলো চমচম এনে দেব। চমচম খান তো?’
‘খাই খাই।’
নাঈম এইসব বিবিধ আলোচনার ফাঁকে একবার ঘুরে যায়, অফিস পিয়ন, নোটিশ বোর্ডে কোনো বিজ্ঞপ্তি সেঁটে দেবে, কম্পিউটার প্রিন্ট সেই কাগজ হাতে তুলে নিতে নিতে নিলুর দিকে অদ্ভুত চোখে তাকায়। নিলু সপ্রতিভ। তাকে কি খুব এলোমেলো দেখায়? কে জানে। তারপর সে যখন অফিস থেকে খুব শ্লথ ধীরপায়ে বের হতে থাকে, সেই মানুষ আকস্মিক সামনে এসে দাঁড়ায়। একগাল নিশ্চুপ হেসে মন্তব্য করে বসে, ‘আপা, চমচমের সাথে যদি দই আনেন তো বেশ মজা হয়।’
‘আচ্ছা ভাই।’
‘শোনেন আপা, একটা কথা বলি, আপনার কাজ হয়নি না? ওই শালাকে কিছু দেন। ব্যাটা চমচম না... গু খায়।’
নিলু সেই কথার অর্থ বোঝে না তা নয়, সবকিছুই এই সিস্টেমে চলছে। কোথায় নেই গু-খোর? তারপর দিন চার-পাঁচ পেরিয়ে গেলে সত্যি সত্যি চমচম আর দই নিয়ে হাজির হয় নিলু। অশ্বিনী বেশ যত্ন নিয়ে নিজের টেবিলের পাশে প্যাকেট দুটো রেখে দেয়। নিলু কী ভেবে হাজার টাকার একটি নোটও আলগোছে এগিয়ে ধরে। অশ্বিনীর চোখে-মুখে আনন্দের ফোয়ারা। জগতের সবাই খুশি থাক।
নিলু তখন নিজের মধ্যে এই স্বগতোক্তি করে নেয়, সিস্টেম এমনই, এতে দোষ নেই তার; যারা এর জনক দায়ভার তাদের। সে শুকনো মুখে ভবিষ্যৎ সুখবর হাতে নিয়ে বের হয়ে আসে। আনন্দ নাকি কান্না? তার নিজের ভেতর কেবলই একটি আক্ষেপ হৃৎস্পন্দনের মতো দপদপ করতে থাকে, ‘এও আমাকে করতে হলো আল্লাহ্... এও করতে হলো।’ তারপর পায়ে পায়ে মানুষজনের ভিড় এড়িয়ে রাস্তায় একপাশে দাঁড়ায়। শেষ লোকাল বাসের অপেক্ষা।
তখন ধূপছায়া বিকেল সন্ধ্যের আঁধারে ডুবে যেতে শুরু করে।
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
