হাড়ের লড়াই
টুটুল রহমান
🕐 ৩:১১ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ০৩, ২০২১
ডাস্টবিনের একটা হাড় মুখে তুলে কামড়াকামড়ি করে, চেটেপুড়ে রাস্তায় রেখে পাছায় সুখের দুলুনি দিতে দিতে একটা কুকুর গলির মুখটা পেরিয়ে গেল। প্রায় বিনা বাধায়। পাশে একটা ছিল ভাঙাচোরা নেড়ি টাইপের ছিল। ব্যালকনি থেকে ঘুমের ঝাপটা কিছুটা কেটে গেল সকাল সকাল এই দৃশ্যই তার চোখে পড়ে। কত দৃশ্যই তো ছবির মতো পার হয়ে যাচ্ছে। ওইদিকে গলিতে রাস্তায় ইটভাঙা যন্ত্রটার একঘেঁয়ে ঘড়ঘড় শব্দ, শ্রমিকদের ক্ষণে ক্ষণে চিৎকার, মুরগিওয়ালার ‘এই মুরগি এই মুরগি’ কর্কশ চেঁচামেচি এত সুন্দর একটা রোমান্টিক আর সুবোধ সকালকে দিল মাটি করে।
অবশ্য এর মধ্যে একটা আঠালো দৃশ্যও গেছে। টিশার্ট পরা, বুক উঁচা, থ্রি-কোয়ার্টার পরা থুলথুলে ঊরুর একটা মেয়ে, হেডফোন কানে গুঁজে রকফক শুনতে শুনতে গলি পার হয়ে গেল। কিংবা এমনও হতে পারে বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে গতরাতের ঝগড়া মিটিয়ে নিচ্ছে মেয়েটি। ভীষণ তাড়া। ব্যস্ততা। দূর ব্যালকনিতে বসেও বোঝা গেল মেয়েটা ভীষণ রকমের ফর্সা। ডানা খোলা। হাঁটুর নিচে ফর্সা মাংসল লাবণ্যময় ঠ্যাং দেখা যাচ্ছে। এস এম সুলতানের আঁকা নারীদের মাংসল শরীর যেন। থলথলে গোলাকার পাছা তো ঢাকতে পারেনি টিশার্ট। শাহাদাতের শরীরটায় সুখের দুলুনি খায়। গলির কুকুরটার মতো। সে উঠে দাঁড়ায়। একটু পানি খাওয়া দরকার। সকালে একঢোক পানি আর দুধ চা খেয়ে ঘুমের ঝামটা কাটিয়ে তারপর কিছুক্ষণ ল্যাপটপ ঘাটাঘাটি করে, নাস্তা করে অফিসে ছুট। পিসিতে কী আর ঘাটাঘাটি করে। মেয়েদের খোলামেলা ছবি আর কি! সে ভাবে, শালার বিয়ের বয়স হয়ে গেল পাঁচ বছর ওই এক জিনিস মাথার ভেতর থেকে নামাতে পারলাম না। সুযোগ পেলেই মেয়েদের ন্যাংটো ছবি দেখা। ছোটখাটো আর টাইট পোশাকে কোনো মেয়ে চোখের সামনে দিয়ে গেল তো মুছে না যাওয়া পর্যন্ত শান্তি নেই।
অক্ষিগোলকে তাকে নাচাতে হবে। ওই মেয়েটার পাছাও নাচতে থাকত কিছুক্ষণ। রাজ্যের সেক্সবিষয়ক ভাবনা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকল এই সাত সকালে। আচ্ছা মেয়েদের পাছার রং কেমন? নাভির গোল বৃত্তটার গর্তটা কতখানি গভীর হয়? তার তো দেখা হলো না। বিয়ে করেছে কিন্তু বউ তো যা করার লাইট অফ করে। কিছু দেখতে দেয় না। কম্পিউটারে স্ক্রিনে এসব কেন যেন শুষ্ক শুষ্ক লাগে।
দুই রুমের ছোট্ট বাসা তার। বাসাটা পুরনো কিন্তু একজন ব্যাংকার থাকবে এই ভেবে বাড়িওয়ালা টাইলস করে দিয়েছে। বাথরুমে চকচকে সব ফিটিংস। ডবল বাথ। শোবার ঘরের সাথের টায় নতুন হাইকমোড। শোবার ঘর থেকে বসার ঘরে যাওয়ার পথে ছোট্ট ডাইনিং স্পেসটার পাশে আরেকটা ওয়াশরুম। বেসিনে আয়না। সেখানেই শেভিং ক্রিম, ব্রাশ, টুথ পেস্ট। অহনা যখন সবে গোসল করে, শাড়িটা কোনো রকমে শরীরে জড়িয়ে রুটি ভাজায় মনোনিবেশ করেছে। শাহাদত অহনাকে রান্না ঘরের ভেতর হঠাৎ আসা বৃষ্টির মতো ঝাপটে ধরে। তারপর চুমো খায়। এই সাত সকালে তার পাগলামিটা আবার বাড়ল কেন অহনা বুঝতে পারে না।
‘ছাড়ো ছাড়ো। মাত্র গোসল করে এসেছি। এসব কী করছ? রাতেই তো হলো। আবার কী?’ শাহাদত ছাড়তে চায় না। জড়িয়ে থাকে। তারপর বেশ কয়েকবার শাড়ির পেছন দিকটা ওঠানো চেষ্টা করে। অহনার লাল পেটিকোটের নিচের কিছু অংশ দেখা যায়। এ যেন স্বামী-স্ত্রীর দুর্দান্ত এক ক্রিকেট ম্যাচ। দর্শকশূন্য। রানশূন্য শাহাদত অল্পতেই স্বাভাবিক হয়ে যায়। সত্যিই তো সাত সকালে এসব কী করছে সে। অন্য কাজ-কাম আছে না। মাথার ভেতর থেকে দৃশ্যটাকে নামানোর চেষ্টা করে। আজ তো প্রমোশন হওয়ার কথা রয়েছে। গোসল সেরে দু’রাকাত নফল নামাজ পড়বে নাকি? মনটা ভাবালু হয়ে ওঠে। আল্লাহর কত শানশওকত। সেখান থেকে ছিঁটেফোটা হিসেবে একটা প্রমোশন তো হতেই পারে।
অফিসার থেকে সিনিয়র অফিসার। শাহাদত গোসলে ঢোকে। নফল নামাজ ততক্ষণে তার মাথার ভেতর থেকে বেরিয়ে গেছে। গোসল সেরে বুটের ডালে রুটি চুবিয়ে খেল। ল্যাপটপের ব্যাগে কিছু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ভরে বেরিয়ে পড়ল। শীত আসি আসি করছে। হামাগুড়ি দেওয়া শিশুরোদের উষ্ণতা মাখা মচমচে একটা সকাল তাকে ঘিরে আছে। সকালের আঠালো দৃশ্যটা আবার মাথার ভেতর ফিরে এলে সেটাকে ওলটপালট করতে করতে সে রাস্তায় নামে।
মুগদা বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়াতেই মহা হুল্লোড়। বিরোধী দলের ঢাকা অবরোধের কারণে বাস নেই কোনো। লেগুনা আসছে দু’একটা। ডবল ভাড়ায় ঝাঁপিয়ে পড়ছে অফিসগামীরা। লেগুনার চাকায় পিষ্ট হতেও কারও ভয় নেই যেন।
শাহাদত এসব ঝাঁপাঝাঁপির মধ্যে যায় না। রিকশার অপেক্ষা করে। আগাতে থাকে। রিকশাও মহাসড়কে পাতলা হয়ে এসেছে। অন্যদিন হলে রিকশাওয়ালাই জিজ্ঞেস করে। আজ তাদের রা নেই। বাপের জমিদারি ছিল এমন ভাব করে মুখ বাঁকিয়ে তারা সাপের মতো হিসহিস করে সামনে দিয়ে ছুটে যাচ্ছে। যাত্রীদের চিৎকার চেঁচামেচি তাদের কানে যাচ্ছে না। ঘোলাটে রঙের প্যান্ট আর লাল শার্ট গায়ে দেওয়া একটা কম বয়সী রিকশাওয়ালা আসে। মাথায় নায়ক শাকিব খানের মতো একটা রুমালও বেঁধেছে। শাহাদত ডাক দেয়। ভাড়া জিজ্ঞেস করে। প্রচণ্ড অনিচ্ছায় রিকশাওয়ালা ছোকরাটি জানায় মুগদা থেকে আজ মতিঝিলের ভাড়া ৮০ টাকা।
শাহাতদের প্রচণ্ড রাগ হয়। ৪০ টাকার ভাড়া ৮০ টাকা? এটা কি মগের মুল্লুগ। শাহাদত রাগ নিয়ে হাঁটতে থাকে। তার মাথায় ঘুরতে থাকেÑ না এই শালাদের বেশি টাকা দেব না। শালা ফকিন্নির জাতদের জন্যই এই অবস্থা দেশের। কুত্তার বাচ্চারা প্রতি পাঁচ বছর পর পর খারাপ লোকদের ভোট দিয়ে ঠিক ক্ষমতায় বসাবে। না! এই শালাদের একটা টাকাও বেশি দেব না। সে পায়ে জোর লাগায়।
ভোটের কথা মাথায় আসতেই শাহাদত ভাবে, ভোট আমি কি দিয়েছি। না তো? গ্রামের বাড়িতে যারা দাঁড়িয়েছিল তারা তো ভালো লোক না। সৎ লোক না। ভালো যে লোকটি দাঁড়িয়েছিল সে তো আড়াই লাখ ভোটের মধ্যে ভোট পেয়েছে ৯৭টা। এদেশে ভালো লোকেরা ভোট পায় না।
এই ভোট ভাবনার মধ্যে টিটিপাড়া পেরুতেই একটা বিআরটিসির বাস এসে দাঁড়ায়। হুড়মুড় করে ওঠে সবাই। চর দখলের মতো যে যার সিটে বসে। তারপর বাসের ভেতরকার অস্থিরতা কেটে গেলে মানুষ কথা শুরু করে। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, ধর্ম-কর্ম, ইন্ডিয়া-পাকিস্তান। যেন এক চ্যানেল চালু থাকা এক বিরাট টিভি রুম। তবে আজকের আলোচনায় জোর পাচ্ছে অবরোধ, কেয়ারটেকার সরকার, বাসের আগুন, মানুষ পোড়ার গল্প, ক্ষমতার হাড্ডি নিয়ে কামড়া-কামড়ি। আলোচনা মুখ থেকে প্রায় কখনো কখনো হাতাহাতির দিকে এগিয়ে যেতে চায়। কেউ কেউ নিবৃত করে।
শাহাদত এসব আলোচনার মধ্যে ঢোকে না। মনোযোগ দেয় না। ক্ষমতা বদলে তার কোনো লাভ নেই। কারওই কোনো লাভ নেই ভেবে সে কয়েকবার বলে ওঠে, ভাই থামেন তো? থামেন। এটা তো জাতীয় সংসদ না। বা পল্টনের মাঠ না। ওইখানে যান।
শাহাদতের কথায় চেতে ওঠে একজন, আরে মিয়া জিনিসপত্রের কী দাম দেখছেন, শেয়ারবাজারটা ধ্বংস হয়ে গেছে। ব্যাংক থাইকা চার হাজার কোটি টাকা নিয়া গেল। আর আপনে কইতাছেন থামেন? আপনে কোন দ্যাশের নাগরিক? মিয়া দ্যাশ প্রেম নাই বুকের মইধ্যে? আপনের মতো তরুণরা জাইগা উঠলেই তো দ্যাশের কিছু একটা হয়। আপনারা মিয়া পড়ছেন ন্যাতায়া। শাহাদতের মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়ে- আমার অতো সেক্স নাই ভাই। পারলে আপনি রাস্তায় নামেন। এই সব তর্কবিতর্কের মধ্যে মতিঝিল এসে বাস দাঁড়ায়। মানুষ কাজে নামে। দেশের পরিস্থিতি ভুলে যায়। তাদের মাথায় তখন চাকরি আর সংসার ঢুকে পড়ে। শাহাদত অফিসে ঢোকে।
অফিসে এমডির জুতা পরিষ্কারের কোনো প্রতিযোগিতা হলে যে লোকটি প্রথম স্থান অধিকার করত তার প্রমোশন হয়েছে। আরও কয়েকজনের হয়েছে। তারা মিষ্টি খাওয়ানোর গল্পে মশগুল। কিন্তু অবরোধে মিষ্টির দোকান খোলা পাওয়া যাবে কি না এ নিয়ে তাদের মধ্যে একটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব হচ্ছে। একজন বলেই বসলÑ হালার রাজনৈতিক দলগুলা আর অবরোধ ডাকার সময় পাইল না। আরেকজন বলল, ডাকবে না ক্যান ভাই? আপনে কেয়ারটেকার সরকারের মাধ্যমে ক্ষমতায় আইসা এখন হেইডা বাতিল করলেন। যুদ্ধাপরাধীর মামলায় কাদের মোল্লারে ঝুলাই দিলেন। মিয়া আপনার দলে কি যুদ্ধাপরাধী নাই? তাদের বিচার করেন না ক্যান? প্রমোশনে তার নামটা না থাকায় আর এই রাজনৈতিক প্যাঁচালে শাহাদতের মেজাজ বিগড়ে যায়। তার মনে হচ্ছে সে এই কুত্তার বাচ্চাদের পাছায় লাত্থি লাগিয়ে দেয়। তারপর একটু হালকা উঠে যায়। এর মধ্যেই ডাস্টবিনের মধ্যে হাড় পাওয়া কুকুরটার মতো পাছায় সুখের দুলুনি দিতে দিতে প্রমোশন পাওয়া ছেলেটা এসে পড়ে কয়েক প্যাকেট মিষ্টি হাতে করে। মুহূর্তেই মিষ্টিগুলো সবার গলা দিয়ে নামতে থাকে। শাহাদত রসালো একটা মিষ্টিতে ভীষণ রাগে কামড় বসায়। মিষ্টি তার কাছে তেতো লাগে। সে এক নারী সহকর্মীর দিকে থাকায়। ভীষণ খারাপ মেজাজটা ঠা-া করার জন্য তার স্তনের দিকে তাকায়। লিপস্টিক মাখা রক্তিম ঠোঁটে কামড় বসায়। দূর থেকেই পাছায় হাত বোলাতে থাকে। নরম তুলতুলে পাছা টেপার অভাবনীয় স্বাদ সে জিহ্বা দিয়ে শাহাদত চাটতে থাকে। মাথা থেকে বেরিয়ে যায় রাস্তার হাঙ্গামা, বাড়তি রিকশার ভাড়ার রাগ, রাজনৈতিক প্যাঁচাল, প্রমোশন। সমস্ত কিছু অতিক্রম করে, সমস্ত না পাওয়া, দেশের রাজনৈতিক হাঙ্গামা অতিক্রম করে সে সহকর্মীর শরীরটাকে নিজ হাতে ডলতে থাকে। ভাবেÑ বাথরুমে একবার যাবে নাকি? নামতে থাকা দুপুরে এডনলের বেলিফুলের সৌরভ ছড়ানো, এসির বাতাস ঢোকা হিমহিম বাথরুমটায় একজন নারীকে চিত করে শুইয়ে সঙ্গমে যে সুখ পাওয়া যাবে তা এই জাগতিক প্যাঁচালের মধ্যে নেই।
বাসায় ফেরার পথেই শাহাদতের বাসে আগুন দিল তারা। তার কিছু মনে পড়ে না। ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে স্বল্প আহত মানুষ হিসেবে সাংবাদিকরা প্রকৃত ঘটনা জানার জন্য মাইক্রোফোন এগিয়ে ধরে। শাহাদতের কিছু মনে পড়ে না। সে কেবল বিড়বিড় করে বলতে থাকে, ডাস্টবিনের একটা হাড় নিয়ে দুটো কুকুর... হ্যাঁ তিনটে... না কুকুরের সংখ্যা আরও বেশি...। আগুনের মধ্যে কুকুর-হাড় ডাস্টবিন কোথা থেকে এলো। সাংবাদিকরা সেটা মেলাতে পারে না। শাহাদতকে প্রশ্ন করে বারবার। পোড়া হাত-পা নিয়ে সে কেবল কঁকাতে থাকে।