ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

মা

এনাম রাজু
🕐 ৪:২৯ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ২৬, ২০২১

মা

দিনটা রাবাবের মতো লম্বা হচ্ছে। দিনের সূর্য যখন সকালের শৈশব পেরিয়ে কৈশোরী, তখন থেকে সাজুগুজু করছে নীলিমা। এখন ঘামঝরা দুপুর। নীলিমার বাবা আব্দুস সামাদ সাহেবও আজ বেশ স্বাস্থ্যসচেতন হয়ে উঠেছেন। চুল দাড়ির দিকে কোনোকালেই তার নজর রাখতে দেখেনি কেউ। লুঙ্গি আর হাফ হাতা স্যান্ডো গেঞ্জি পরেন। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় লুঙ্গির খুঁট গুজে নেন। তারপর হনহন করে ছোটেন কাজে। আজ তিনিই ঘরের বারান্দায় ছোট আয়না পাটের দড়িতে ঝুলিয়ে গোঁফ-দাড়ি ছাঁটছেন। মাঝে মাঝে কানের পাশের চুলগুলোর দিকে সচেতনভাবে বারবার চোখ রাখছেন। হাতের আঙুল দিয়ে মাথায় সিঁথি কাটছেন। আঙুল আটকে গেলেই চিরুনির অভিযান চালাচ্ছেন। বাবা-মেয়ের সাজগোজের এই রঙতামাশা চলছে তো চলছেই।

সামাদ সাহেব মুদি দোকানি। বড়সড় মুদি দোকানি না। বাজারের এক কোণায় ছোট্ট একটা ঝুপড়ি ঘর। সেখানেই তুলেছেন নানা পদের জিনিস। সেগুলো থেকেই চালান ব্যবসা। যা আসে তাই দিয়ে বেঁচে-বর্তে আছেন।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই সামাদ সাহেবের দৌড় থাকে দোকানের দিকে। একদিন দোকানে না গেলে শরীর জ¦ালাপোড়া করে। সেদিন থেকে থেকে একাই বলেন, ‘দোকানে না গিয়ে দিনটাই মাটি হলো। আজ নিশ্চয়ই অনেক খরিদদার আসত। কপাল মন্দ বলেই বাজারে যাওয়া হলো না।’ এসব শুনে নীলিমার মা অভ্যস্ত। বলে, ‘হুম। যেদিন তুমি বাজারে যাও না সেদিন তো বেশি বিক্রি হওয়ারই কথা থাকে। সেই বিয়ের পর থেকে ত্রিশ বসন্ত গেল, উন্নতি বলতে তো দোকানের ওই নতুন ঝাঁপ। তাও অকেজো হয়ে না পড়লে বোধহয় পাল্টাতে না।’ সেই মানুষটার আজ দোকান খোলার কোনো তাড়া নেই। বারবার মেয়েকে ডাকছেন আর এটা-সেটা বলছেন। আর বাপ-বেটি মিলে সাজছেন তো সাজছেন। এই যেমন একটু আগে বললেনÑ মা নীলিমা। আজ ভালো করে সাজতে হবে। ঠোঁটে কিন্তু কোনো রঙ লাগাতে পারবি না। কপালে টিপ দেওয়া যাবে না। চোখে কাজল পরবি। কাজল পরলে বদ মানুষের নজর লাগে না। কী যে দিনকাল পড়েছে। মানুষ শুধু খারাপ নজর দেয়। পত্রিকা টিভি খুললেই শুধু খারাপ খবর। পরক্ষণে আবার বলেন, ‘তবে একটা কথা জেনে রাখিস মা, মানুষকে ভালোবাসলেই পৃথিবী তোর হবে।’
মাথা নাড়িয়ে সায় দিল নীলিমা। নীলিমার মা সব শুনেও কিছুই বলছে না। মানুষটা আর যাই হোক, আজ সাজছে। মন খুলে সাধ্যমতো সাজছে। মাঝে মাঝে হাসছেও। এতেই শান্তি তার।
দেখতে দেখতে দুপুর হয়ে এলো। খাবার রেডি করে নীলিমা ও তার বাবাকে ডাকল মা। তাড়াহুড়ো করে দুজনেই খেতে বসল। খেয়েই রওনা দেবে তারা, যাবে নীলিমার ছোট চাচ্চুর বাড়ি। সেখানে অনুষ্ঠান হচ্ছে। বিয়ের অনুষ্ঠান। সকালেই শুরু হয়েছে।
নীলিমার বাবার অবশ্য বিয়ে, অনুষ্ঠান নিয়ে মাতামাতি নেই। সেখানে মজার মজার রান্না হচ্ছেÑ এটাই তাকে টানছে। অনেক দিন ভালোমন্দ খায়নি, মেয়েটাকে খাওয়াতে পারেনি। একটু কৃপণ প্রকৃতির। যদিও পকেট আর দুশ্চিন্তা তাকে কৃপণ বানিয়ে ছেড়েছে। তাই আগের থেকে উন্নতি হলেও স্বভাব যায়নি। ছোট ভাইয়ের বাড়িতে বিয়ের দাওয়াত বলে বাসায়ও তেমন বাজার আনেননি। সেজন্য নীলিমাদের বাড়িতে বিশেষ রান্না হয়নি। সকালেও না, দুপুরেও না। ছোট চাচ্চুর বাসায় গিয়েই হবে ভুরিভোজ- এটা নীলিমাও ভালোভাবে বুঝেছে।
তখনো খাওয়া শেষ হয়নি নীলিমাদের। এরই মধ্যে শুরু হলো বৃষ্টি। বৃষ্টি বললে ভুল হবে; আজব বৃষ্টি। আকাশ থেকে পানি ঝরছে। সেই পানির সঙ্গে পড়ছে ছোট-বড় মাছ। নানা প্রজাতির মাছ। সে হিসেবে মাছবৃষ্টি শুরু হয়েছে বলা চলে। মাছবৃষ্টির মধ্যে পড়ছে আজব শিলা। এমন বৃষ্টি আগে কখনো কেউ দেখেনি। আশপাশের দশ গ্রামের মানুষ অবাক। অবাক নীলিমার মা। ঘোর লেগে আছে চোখে। ঘোরের মধ্যেই নীলিমাকে ডাকে, ‘মা, বাইরে আয়। দেখ কী কাণ্ড! এই দুনিয়া আর দুনিয়া নেই রে মা। জীবনে এমন কাণ্ড দেখিনি।’ ঘর থেকে নীলিমার বের হতে দেরি হচ্ছে দেখে আবারও ডাকতে থাকে তার মা। মায়ের কথাবার্তায় অনেকটা ভয় নিয়েই বাইরে ছুটে আসে। এসে সব দেখে প্রথমে আরও ভয় পেয়ে যায়। তারপর অবাক হয়। এরপর খুশিতে আটখানা হয়ে যায়। মজার ব্যাপার। আকাশ থেকে বৃষ্টির সঙ্গে মাছ ঝরছে। মাছবৃষ্টি। আহা, মজার ব্যাপার বলতে মজার? সেই রকম মজার। কাল নিশ্চয়ই স্কুলেও এ নিয়ে মজার মজার গল্প হবে। ভাগ্যিস মা ডেকেছিল। না হলে বড্ড মিস হয়ে যেত। মিস হয়ে গেলে বন্ধুদের আলোচনায় মুখ লুকিয়ে বোকার মতো বসে থাকতে হতো।
নীলিমার বাবার এসবে তেমন কোনো আসে যায় না। তার চিন্তা ভালোমন্দ খাবারের দিকে। বারান্দায় পায়চারি করছেন আর থেকে থেকে বলছেন, মরণের বৃষ্টি নামার আর সময় পেল না। এমনিতে দোকান খোলা হয়নি। নিশ্চয়ই অনেক খরিদদার এসেছিল। ভেবেছিলাম ছোট ভাইয়ের বাসায় বিয়ের দাওয়াতে যাব, একটু আনন্দ-ফুর্তি করব। মজার মজার খাবার খাব। তা আর হলো না।
অবাক বৃষ্টি দেখতে দেখতেই বাবার কথাগুলো কানে ঢোকে নীলিমার। শুনে মন খারাপ হয়ে যায়- তাই তো! এভাবে বৃষ্টি ঝরলে চাচ্চুর বাসায় যেতে পারবে না। বিয়ে বাড়ির সব মজা থেকে বঞ্চিত হবে। বউ সেজে থাকা রীনা আপুর পাশে বসে দুষ্টুমি করতে পারবে না। কনে দেখতে আসা মানুষের হাতে পান-সুপারি তুলে দিতে পারবে না। অথচ গত কয়েক দিন ধরে কী কী করবে সব ভেবে রেখেছে নীলিমা।
বাপ-বেটি যখন বিয়েবাড়ির চিন্তায় মশগুল, তখন নীলিমার মা উঠোনে ছুটোছুটি করছে। শিলার মধ্যেই লাফিয়ে লাফিয়ে মাছ ধরার চেষ্টা করছে। কাদায় হাঁটু গেড়েও মাছ ধরতে চেষ্টা করছে। ছোট্ট মানুষের মতো খুশিতে উন্মাদ যেন সে। এ খুশি বৃষ্টিধোয়া ঠোঁটে গিয়ে লাগে। খুশিতে ঠোঁট দুটো কেঁপে ওঠে। যে নীলিমার মা বিজলির চমকে, বিজলির শব্দে দৌড়ে ছুটে ঘরের কোণায় আশ্রয় নিত, সে-ই আজ সব উপেক্ষা করে মাছ কুড়াতে, মাছ ধরতে ব্যস্ত। কীসের জন্য যেন এই দৌড়ঝাঁপ তার। কাকে যেন খুশি করতে চায় সে। নীলিমার দাদিমাও যোগ দেয় তার সঙ্গে। বয়স কোনো বাধা মানছে না। সেও যেন কাকে খুশি করতে চায়।
হঠাৎ নীলিমার দাদির হাতে ইলিশ মাছ ধরা পড়ে। খুব আনন্দে পাথর হয়ে যান তিনি। তার আনন্দ অশ্রুতে বৃষ্টির পানি বেড়ে যায় যেন। সেই সে কবেকার কথা। সামাদ সাহেব তখন ছোট। ইলিশ মাছ খেতে চেয়ে সেকি তার কান্না। তখন কিনে খাওয়াতে পারেননি। ইলিশের দাম সাধ্যের বাইরে ছিল। সেই ছেলেটা আজ নিজেই বাবা হয়েছে। এখনো অভাব লেগেই আছে। ইচ্ছে হলেই সব কেনা সম্ভব না। ছেলেটাও পারে না। তার সেই অক্ষমতাকে কৃপণের চাদরে ঢেকে রাখতে চায়। নীলিমার দাদিমা বোঝে, কিছু বলে না। নীলিমার মা মায়ের উথালপাথাল দৌড়াদৌড়ি, লাফালাফি, কাদা মেখে মাছ ধরার কারণ সে উপলব্ধি করে। আজ একবেলা অন্তত স্বামী-সন্তানকে মনের তৃপ্তি মিটিয়ে মাছ দিয়ে ভাত খাওয়াতে পারবে।
নীলিমার মা ঝুড়ি নিয়ে আসে। একটা মাছে ভরে যায় আরেকটা নিয়ে আসে। কোছড়ের মধ্যে রাখে। কতটা হলো। এতটা দিয়ে কী হবে- কোনো খেয়াল নেই তার। নীলিমার দাদি দেখে। দেখে কিছু বলে না। মুচকি হেসে তার সঙ্গে মাছ ধরতে লেগে যায়। এর কোনো কিছুই ধরা পড়ে না নীলিমা ও তার বাবার। কারণ, সংসারে তরকারির অভাব যে শুধু মা-ই জানে...।

 
Electronic Paper