ভাইরাস
মহুয়া ফেরদৌসী
🕐 ৩:১৫ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ০১, ২০২১
মৃধা বাড়ির নতুন বউ করোনা হয়ে মরেছে। হাশেম মৃধা পুত্রবধূর সৎকারে কোনো ত্রুটি রাখতে চান না। মালেকাকে ডেকে আনা হয়েছে মৃতের গোসল এবং দাফনের কাজে। করোনা বড্ড ছোঁয়াচে, দাদা-পরদাদাদের যুগের প্লেগের মতো। মালেকা ছাড়া তাই আর কেউ নেই। উঠোনের একপাশে ইটের তোলা চুলাতে বরই পাতা সহকারে পানি গরম হচ্ছে। বউয়ের লাশ বাইরে আনা হয়নি। মালেকাকে বলা হয়েছে কলঘরেই গোসল দেওয়াতে হবে। ওখানে চৌকির ওপর লাশ এনে রাখা হয়েছে। বাড়িতে বাইরের কোনো লোক সমাগম নেই। বউটার বাপের বাড়ির কেউ এখনো এসে পৌঁছেনি। মালেকাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যত জলদি করা যায় কাফনের কাজ শেষ করতে হবে। জোহরের ওয়াক্তেই দাফনের কাজ শেষ করার কথা। জানাজায় কেবল বড় হুজুর আর বাড়ির পুরুষরা থাকবেন।
একা একা সবটা করতে মালেকার একটু কষ্টই হয়ে যায়। নিয়ম অনুযায়ী হাতে গ্লাভস, মুখে মাস্ক পরে মালেকা লাশের গোসল দিতে এসেছিল। কিন্তু লাশের গায়ের কাপড় খোলার পর মালেকা সেসব নিয়ম মানার আর কোনো প্রয়োজন দেখল না। কলঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে সে খুব সাবধানে গোসলের কাজ সারতে লাগল। সময় বোধহয় বেশি লাগছিল। বাইরে থেকে মৃধা গিন্নির উঁচু গলার আওয়াজ পাওয়া যায়, ‘কী রে, দিন কাবার করে দিবি নাকি? এত সময় লাগে ক্যান?’ মালেকা ঝাঁজের সঙ্গে ভিতর থেকে উত্তর দেয়, ‘সময়ের এত টান লাগলি পরে বউয়ের শরীরের ভাইরাসের দাগ আগে মুইছে রাখতেন বড় আম্মা। ভালো করে পরিষ্কার না করলি কাফন কি আর সাদা থাকপি?’ ও পাশে আর কোনো আওয়াজ শোনা যায় না।
মালেকা অনেক মমতা নিয়ে মেয়েটার শরীরের ক্ষতের দাগ পরিষ্কার করে। ভিতর থেকে ঠেলে আসা কান্নাটা গিলে ফেলে চট করে। পোয়াতি ছিল কি? দুপায়ের মাঝে রক্তের ধারা সেরকমই নির্দেশ করে। আঁচড়, কামড়, বেল্টের বাড়ির দগদগে ঘা এখনো টাটকা।
লাশের গোসল দিয়ে মালেকা কখনো টাকা নেয় না। তবে আজ হাশেম মৃধা তার হাতে হাজার টাকার চকচকে নোট দুটো তুলে দিলে আপত্তি করে না।
বাড়ি ফেরার পথে মালেকার প্রতিবেশী এসে চোখ রাঙিয়ে যায়, ‘করুণার লাশ ধইরে আইছ। চৌদ্দ দিন বাড়ির আর বাইর হইয়ো না। হইলে কিন্তুক পুলিশে খবর দিবানে।’
মালেকা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঘরের ভিতর ঢুকে যায়। সরকার নাকি দেশের সবাইকে করোনার টিকা দেবে। টিকা দিলে এই রোগে আর কেউ মরবে না। মৃধা বাড়িতে যে ভাইরাসটা আছে সেইটার টিকা কি কোনোদিন বের হবে? যদি হয় মালেকা না হয় আঁচলে বান্ধা এই দুই হাজার টাকা দিয়েই মৃধার ছোট ছেলের জন্য এক ডোজ টিকা কিনে দেবে। তাহলে নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে ও বাড়িতে আর কোনো বউ করোনা হয়ে মরবে না। নাকি মরবে?