শিক্ষাসফর
মিলন রহমান
🕐 ২:০৯ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২১
জমজমাট আড্ডা চলছে। গিট্টু কিশোর ক্লাবের আড্ডা বলে কথা। জমতেই হবে। ক্লাবের ‘অল ইন অল’ সভাপতি গিট্টুদা ওরফে গোলাম আলী আড্ডার মধ্যমনি। তাকে ঘিরেই আড্ডা জমিয়ে তুলেছে গিট্টু ক্লাবে সদস্য আকাশ, তুষার, অমিত, শান্তি ও আল আমিন। আড্ডা-আলোচনায় দেশ-জাতি-সমাজ কোনো কিছুই বাদ যাচ্ছে না।
যদিও শুক্রবার। দিনটিতে সাপ্তাহিক মিটিং হয়। কিন্তু গিট্টুদা ঘোষণা করলো, ‘আজ কোনো আনুষ্ঠানিক মিটিং হবে না। মিটিংয়ে অনেক কথা বলা যায় না। আড্ডায় বলা যায়। আজ হবে আড্ডা-মিটিং। যার যা মনে আসে, মিটিংয়ে সব বলা যাবে।’
আড্ডা-মিটিং এগিয়ে চলেছে। মিটিংয়ে ইটিংয়ের সময় ঘনিয়ে এসেছে। তুষারই বিষয়টি তুললো, ‘দাদা, আজকের নাস্তা ঝাল হবে, না মিষ্টি?’
গিট্টুদা বলল, ‘আহা, মিষ্টির কথা তুললি। তবে শোন, তোরা কি জানিস, কলকাতার রসগোল্লা কী তুলতুলে নরম, আর কী মিষ্টি...!’
গিট্টুদার মুখের কথা কেড়ে নিয়েই তুষার বলে বসল, ‘তুমি তো কখনও বেনাপোল বর্ডারই পার হওনি; এতসব কী করে জানো?’
তুষার এভাবে মুখ খুলতেই বাকিদের মুখ চুপসে গেল। গিট্টুদা বুঝি এবার ক্ষেপে গিয়ে নাস্তাই বাতিল করে দেয়। কিন্তু না, তেমন কিছুই ঘটল না। সবাই দেখল, দাদা হাসছে!
গিট্টুদা বলল, ‘আমি আগেই জানতাম, তুই একথা বলবি। তবে শোন; আমার দাদা কলকাতায় গিয়েছিল, সে একজনকে এই রসগোল্লা খেতে দেখেছে!’
এবার সবাই হো হো করে হেসে উঠল। হাসি থামিয়ে মুখ খুলল আকাশ। বলল, ‘দাদা, তোমার মাথা ঠিক আছে তো! তোমার দাদা কলকাতায় গিয়েছিল, সে একজনকে রসগোল্লা খেতে দেখেছে। সেই বর্ণনা শুনে তুমি বুঝেছ, কলকাতার রসগোল্লা নরম আর মিষ্টি!’
এবার বেশ আয়েশ করে নড়েচড়ে বসে গিট্টুদা। সবার মুখের দিকে তাকিয়ে নেয়। বাকি সবাইও গিট্টুদার আয়েশি ভঙ্গি দেখে বুঝতে পারে রহস্য একটা আছে। ফের মুখ খুলল গিট্টুদা, ‘কেন, একটু আগে অমিত যে বলছিল, কাল স্কুলে সুন্দরবন ভ্রমণকাহিনীর রচনা লিখতে হবে; তখন তো তোরা কিছু বললি না? অমিত তো জীবনে সুন্দরবনের ধারে কাছেও যায়নি। তাহলে ও ভ্রমণকাহিনী লিখবে কীভাবে?’
গিট্টুদা বলতে থাকে, ‘তোরা সুন্দরবনে না গিয়েও বিশাল ভ্রমণকাহিনী লিখে ফেলতে পারবি; আর আমি কলকাতা না গিয়ে শুধু বললাম, রসগোল্লা তুলতুলে আর মিষ্টি। তাতে দোষ হয়ে গেল!’
গিট্টুদার কথার মারপ্যাঁচে সবাই এবার ধরাশায়ী। বুঝতে পারে রহস্য। আল আমিন জানায়, শুধু অমিত না, তাদের সবারই কাল স্কুলে সুন্দরবন ভ্রমণকাহিনীর রচনা লিখতে হবে।
গিট্টুদা জানতে চায়, ‘তোরা তো কেউই সুন্দরবন ভ্রমণ করিসনি। তাহলে ভ্রমণকাহিনীটা আসবে কোত্থেকে?’
জবাব দেয় শান্তি, ‘কেন, রচনা বইয়ে রচনা তো আছে!’
গিট্টু আক্ষেপ নিয়ে বলে, ‘এটাই তো হলো সমস্যা! বইয়ে তো লেখা আছে লেখকের ভ্রমণকাহিনী। তোরা তাই গিলবি, মানে মুখস্ত করবি; আর খাতায় উগরে দিবি। এটা কী ধরনের শিক্ষা হলো!’
‘তাহলে উপায় কী?’ জানতে চায় অমিত।
আকাশ যুক্ত করে, ‘এভাবেই তো হয়ে আসছে দাদা। তুমি আবার কী পাল্টে দেবে?’
গিট্টুদা এবার ক্ষেপে যায়, ‘এই তোদের আরেক দোষ! গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিবি। যা হয়ে আসছে, ভুল হলেও তা হতেই থাকবে! ভুলটাকে ঠিক পথে আনতে উদ্যোগ নিবি না। তাহলে পরিবর্তনটা হবে কী করে?’
এবার মুখ খোলে তুষার, ‘তুমিই একটা উপায় বলো না দাদা!’
গিট্টুদাও তুষারের অনুকরণে ভেঙচি কেটে বলে, ‘তুমিই একটা উপায় বলো না দাদা!’ তারপর বলে, ‘সব উপায় যদি দাদাকেই বের করতে হয়, তোরা কি তবে ঘোড়ার ঘাস কাটবি? মাথা ঘামাবি না?’
একটু দম নিয়ে গিট্টুদা ফের বলে, ‘মেজাজটা বিগড়ে গেছে। আজ আড্ডা-মিটিং শেষ। যা, কাল স্কুলে গিয়ে মুখস্থ ভ্রমণকাহিনী উগড়ে দিয়ে আয়। তারপর দেখি তোদের জন্য কী করতে পারি।’
নাস্তা প- হচ্ছে দেখে মিনমিন করে শান্তি বলল, ‘দাদা, তাহলে কি মিষ্টি খাওয়া হবে না?’
গিট্টুদা জবাব দেয়, ‘কেন হবে না; এই সমস্যার সমাধান করে আয়, ডাবল মিষ্টি খাওয়াব।’
সেদিনের মতো মিটিং শেষ হয়ে গেল। পরদিন স্কুল থেকে ফেরার পথেই শান্তি, আল আমিন ক্লাবে ঢু মারল। গিট্টুদার কাছে জানতে চাইল, ‘দাদা কোনো উপায় হলো?’
অন্যমনস্ক গিট্টুদা বলল, ‘না রে, তোদের বিষয়টা ভাবছি, দেখি কী করা যায়।’
নিরাশ হয়ে আল আমিন, শান্তি বাড়ির পথ ধরল।
দু’দিন পর গিট্টুদা স্কুলের ভর্তি ও বেতন প্রদানের বই চেয়ে পাঠাল। আকাশ নিজেই তা গিট্টুদার কাছে পৌঁছে দিল। এরপর আবার দু’দিন কোনো খোঁজ-খবর নেই।’
বৃহস্পতিবার স্কুল থেকে ফিরেই তুষার ‘ইউরেকা! ইউরেকা!’ বলে ছুটল ক্লাবের দিকে। তুষারের এই ইউরেকা’র খবর পেয়ে বাকিরাও পৌঁছে গেল ক্লাবে। ক্লাবঘরে নির্লিপ্ত গিট্টুদা একমনে বই পড়ছে।
গিট্টুদাকে সামনে পেয়ে তুষার এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলল, ‘দাদা, তোমার আর কিছু করা লাগবে না। এই দেখো পত্রিকায় কী লিখেছে!’ বলেই পত্রিকা এগিয়ে দেয়। গিট্টুদা বাদে সবাই হুমড়ি খেয়ে পত্রিকার ওপরে পড়ে।
বড় বড় হরফে পত্রিকায় হেডিং ছাপা হয়েছে, ‘ফি দিয়েও ভ্রমণবঞ্চিত শিক্ষার্থীরা, ফান্ডে জমছে লাখ লাখ টাকা’।
বিস্তারিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, জেলার শীর্ষ কয়েকটি স্কুলে শিক্ষা সফরের জন্য ভর্তি ও সেশন চার্জের সঙ্গে বেশ ভালো টাকা ফি নিয়ে নেওয়া হয়। কিন্তু শিক্ষাসফর বা ভ্রমণ আর হয় না। বরং ওই টাকা শুধু ফান্ডেই জমা হয়ে যাচ্ছে।’ নিউজে স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার বক্তব্যও আছে। তারা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে দ্রুতই শিক্ষা সফর চালুর ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
সবাই হুমড়ি খেয়ে খবরটা পড়লেও গিট্টুদার কোনো তাপ-উত্তাপ নেই। সে একমনে বই পড়েই চলেছে।
সেদিকে চোখ পড়তেই আকাশ বলল, ‘কী পড়ছ গিট্টুদা। এই দেখো পত্রিকা তো ফাটিয়ে দিয়েছে। আমাদের শিক্ষাসফর না হওয়া নিয়ে কত বড় নিউজ করেছে।’ এবার বই থেকে মুখ তুলল গিট্টুদা। ‘তাই নাকি? কই দেখি?’ বললেও গিট্টুদা’র মধ্যে তেমন উৎসাহ দেখা গেল না।
ফোড়ন কাটল তুষার, ‘শিক্ষাসফর বিষয়ে গিট্টুদা কিছু করতে পারল না বলে হতাশ হয়েছে। তাই...।’
কথা শেষ করতে পারে না তুষার। তাকে থামিয়ে দেয় আকাশ। বলে, ‘তুই থাম তো, শুধু দাদার পিছনে লাগিস। কাজ এখনো শেষ হয়ে যায়নি। তার আগে পুরো ঘটনাও বুঝতে হবে।’
‘ঘটনা বোঝাবুঝির কিছু নেই। সমস্যা যখন মিটেছে, তখন আজকের মিটিং বাতিল।’ নিরাসক্ত কণ্ঠে ঘোষণা করে গিট্টুদা ফের বইয়ে মুখ গুঁজল। অগত্যা সবাই বাড়ি ফিরল।
সংবাদপত্রে স্কুলগুলোর শিক্ষাসফর নিয়ে খবর প্রকাশিত হওয়ায় বেশ তোলপাড় সৃষ্টি হলো। পরের সপ্তাহে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে গেল। প্রশাসন থেকে একটি কমিটি ঘটনার তদন্ত করল। তারা এ নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গেও কথা বলল। তদন্ত কমিটির কাছে আকাশ-তুষাররা দাবি জানাল, তারা শিক্ষা সফর শেষেই রচনা লিখতে চায়।
তদন্ত কমিটি জেলা প্রশাসকের কাছে তাদের রিপোর্ট দিল। তাতে শিক্ষাসফর চালু করার সুপারিশ করা হলো। সেই সুপারিশের ভিত্তিতে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা সফরের বিষয়টি চূড়ান্ত হলো।
দু’সপ্তাহ পরের বৃহস্পতিবার। আকাশদের শিক্ষা সফরের দিন। সুন্দরবন যাচ্ছে তারা। সকাল ৮টায় স্কুলের সামনে থেকে গাড়ি ছাড়বে। পৌনে ৮টায় স্কুলের সামনে পৌঁছে গেছে আকাশ, তুষার, অমিত, শান্তি ও আল আমিন। পাঁচ মিনিট পর সেখানে হাজির হলো গিট্টুদা। সঙ্গে অপরিচিত এক লোক।
গিট্টুদাকে দেখে সবাই অবাক। ‘কী ব্যাপার গিট্টুদা? এত সকালে তো তোমার ঘুম ভাঙে না, কেসটা কী?’ বলে অমিত।
গিট্টুদা তার ট্রেডমার্ক হাসি দিয়ে বলল, ‘তোদের সি-অফ করতে এলাম। আর পরিচিত হ্, এ আমার বন্ধু আরিফুজ্জামান। যে তোদের শিক্ষাসফর নিয়ে নিউজ করেছিল।’
এরপর আরিফুজ্জামানের কাছ থেকে বেতন প্রদানের বই নিয়ে আকাশকে ফেরত দিল গিট্টুদা।
চমক ভাঙল সবার। মুখ খুলল তুষার, ‘গিট্টুদা, তাহলে তুমিই...!’
তুষারকে থামিয়ে দিয়ে গিট্টুদা বলে, ‘এখন আর কথা নয়। শিক্ষাসফরে যাচ্ছিস, ফিরে এসে জম্পেশ একটা রচনা লিখবি।’
কথা শেষ করেই আরিফুজ্জামানকে নিয়ে বিদায় নিল গিট্টুদা।