ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

মাস্টারমশাই

মূল : রাস্কিন বন্ড, ভাষান্তর : মিরন মহিউদ্দীন

জীবনানন্দ ডেস্ক
🕐 ৪:০৩ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৬, ২০২১

মাস্টারমশাই

স্টেশনে পায়চারী করছিলাম। অমৃতসর মেলের অপেক্ষায়। একটু অন্যমনস্ক ছিলাম। তবুও হঠাৎ চোখে পড়ল- পুলিশ মাস্টারমশাইকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। তার হাতে হাতকড়া।

প্রথমে তো তাকে চিনতেই পারিনি। বিশাল ভুঁড়ি, মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি, মাথায় এলোমেলো চুল। পরনের পোশাক ময়লা, কোঁচকানো। তাকে মুখোমুখি দেখে চমকে উঠলাম- আরে! উনি তো আমাদের স্কুলে হিন্দি পড়াতেন।
নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। ভুল দেখছি না তো! হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। ওনার চোখ দেখে মনে হলো- উনি আমায় চিনতে পেরেছেন। শেষ ওকে দেখেছিলাম বিশ বছর আগে। আমাদের হিন্দি ক্লাসে চক হাতে ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে পড়াচ্ছেন। আর আজ আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন হাতকড়া পরা অবস্থায়। কিন্তু আজও তিনি সেদিনের মতোই হাসিখুশি...। তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম- শুভ সন্ধ্যা, মাস্টারমশাই। রীতিমতো তোতলাচ্ছিলাম। কী আর করা যাবে, ছোটবেলার শিক্ষা তো আর ভুলতে পারিনি- যে কোনো পরিস্থিতিতে সবসময় শিক্ষককে সম্মান জানাতে হবে। খুশিতে ঝলমল করে উঠল মাস্টারমশাইয়ের মুখ। বললেন- ‘আমাকে তাহলে চিনতে পেরেছ! খুব খুশি হলাম। ভালো আছ তো?’
খেয়াল ছিল না যে ওনার ডান হাতে হাতকড়া পরানো। আর পুলিশ বাঁ-হাত দিয়ে ধরে আছে সেটা। হ্যান্ডশেক করার জন্যে আমি ডান হাতটা বাড়িয়ে দিতেই, উনি বাঁ-হাত দিয়ে আমার হাতটা ধরে জোরে ঝাঁকুনি দিলেন। আর তখনই তার শরীর থেকে ভেসে এলো দারুচিনি ও লবঙ্গের বহু পরিচিতি পুরনো সুবাস। মনে পড়ে গেল, ক্লাসে ইংরেজি থেকে হিন্দি অনুবাদ করার সময় ঝুঁকে পড়ে যখন আমার খাতা দেখতেন, তখন তার শরীর থেকে এমন সুরভিই ভেসে আসত বাতাসে।
১৯৪৮ সালে দেশভাগের পরই উনি আমাদের স্কুলে এলেন হিন্দি পড়াতে। এতদিন আমরা শুধু উর্দু ও ফার্সিই শিখতাম। আইন জারি হলো- অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে এখন থেকে হিন্দিও পড়তে হবে। হিন্দি শিখতে গিয়ে তো আমার নাজেহাল অবস্থা। এমন সময় কুশল মাস্টারমশাই স্থানীয় এক সরকারি কর্মকর্তার সুপারিশে আমাদের স্কুলে যোগ দিলেন হিন্দি শিক্ষক হিসেবে। আমাদের স্কুলে হিন্দি পড়াতে পারেন এমন কেউ ছিলেন না। তাই কুশল মাস্টারমশাইয়ের হিন্দি ভাষার ওপর কতটা দখল, সেটা পরিমাপ করার কেউ ছিল না।

আজ সেই মানুষটি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন আইনের নাগপাশে বন্দি হয়ে। এই অবস্থায় মাস্টারমশাইকে দেখে আমার ঘোর তখনো কাটেনি। ইতোমধ্যে ট্রেন এসে গেছে। মানুষজন উদ্ভ্রান্তের মতো প্লাটফর্মে ছোটাছুটি করছে ট্রেনে উঠতে...। এই জনস্রোতের মধ্যে দিয়েই পুলিশ মাস্টারমশাইকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে চলেছে ট্রেনের তৃতীয় শ্রেণির কামরার দিকে। বহু কষ্টে আমিও কোনোক্রমে তাদের পিছু পিছু দিয়ে সেই তৃতীয় কামরায় উঠে ঠেলেঠুলে মাস্টারমশাইয়ের ঠিক সামনেই একটা সিটে চুপ করে বসে পড়লাম। হাতকড়া পরা অবস্থায়ও মাস্টারমশাইকে এতটুকু বিচলিত দেখাচ্ছে না। আশপাশের লোকজন যে তার দিকে কৌতূহলের দৃষ্টি নিয়ে দেখছে, এ ব্যাপারে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। উল্টো বরং পুলিশদেরই বিরক্ত দেখাচ্ছে। ভাবখানা মাস্টারমশাইকে ধরতে এসে যেন, তারাই চুরির দায়ে ধরা পড়েছে।
ফিরোজপুরে যে বাড়িতে ভাড়া থাকি- সেই বাড়ির গৃহকর্ত্রী পথে খাবার জন্যে কয়েকটা পরোটা ভেজে দিয়েছিলেন। টিফিন কৌটো খুলে তারই একটা নিয়ে মাস্টারমশাইকে দিতেই তিনি বিনা দ্বিধায় খুশি হয়ে খেতে শুরু করলেন। আর একটা পরোটা পুলিশিটিকে দিতে গেলে সে তো এমন ভাব দেখাল যেন অদ্ভুত কিছু একটা দেখছে। আসলে সে তো তখন ডিউটিতে রয়েছে- তাই হয়তো।
সামনে বসে জানতে চাইলাম- মাস্টারমশাই, আপনাকে এরা ধরেছে কেন?
আরে, তেমন কিছু না। আজকালের মধ্যেই ছেড়ে দেবে। এ নিয়ে ভেবো না, তা, তুমি আজকাল কী করছ?
ওসব কথা পরে হবে। আগে বলুন পুলিশ আপনাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে কেন?
এবারে আমার দিকে একটু ঝুঁকে পড়ে বললেন, লজ্জা পাওয়ার মতো কিছু না। তার গলার স্বরে পূর্ণ আত্মবিশ^াস তখনো।
বুঝলে, সক্রেটিসের মতো পণ্ডিত লোককেও আইনের চোখে দোষী সাব্যস্ত হতে হয়েছিল।
তাহলে কি কোনো ছাত্র নালিশ করেছে আপনার নামে!
না, না, আমার ছাত্ররা কেন অকারণে নালিশ করবে, শুনি! এ কথায় মাস্টারমশাই রীতিমতো অসন্তুষ্ট হয়েছেন বোঝা গেল।
আসলে অভিযোগ জানিয়েছে আমার সহকর্মীরাই।
আমার চোখে বোধহয় অবিশ্বাসের ছায়া দেখতে পেলেন তিনি। তাই আর কথা না বাড়িয়ে নিজেই চলে এলেন মূল বিষয়ে- বিষয়টা হচ্ছে মিথ্যে সার্টিফিকেট দাখিল করা নিয়ে।
ও!
আমার উৎসাহে কেউ যেন ঠাণ্ডা জল ঢেলে দিল। জানেন তো সরকারি স্কুলে পড়া ছাত্রদের এই এক বিদঘুটে স্বভাব- সবসময় পুরোটা না শুনে, না বুঝে চট করে একটা ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাওয়া।
আপনার সার্টিফিকেট, স্যার?
আমার কেন হবে? কী যে বলো না তুমি! আমার সার্টিফিকেটে কোনো ভুল নেই। ১৯৪৬ সালে লাহোর থেকে এটা প্রিন্ট করা হয়েছিল।
কিছু মনে করবেন না স্যার, আপনাকে খুব সম্মান করি বলেই জানতে চাইছি। ঠিক বুঝতে পারছি না ঝামেলাটা কোথায়, কী নিয়ে? তাহলে কি এতদিন আপনার...!
হাঁদারাম কোথাকার। গাধাগুলোকে তো এত বছর ধরে আমি আমার সার্টিফিকেট দিয়েই ম্যাট্রিকুলেশন পাস করিয়ে আসছি। নইলে ওই নিরেটগুলোর কোনো যোগ্যতা আছে পাস করার? বিস্ময়ে আমি হতবাক। কোনোরকমে তোতলাতে তোতলাতে জানতে চাইলাম, আপনার সার্টিফিকেট দিয়ে পাস করিয়েছেন?
ঠিক তাই, নইলে আর চিন্তা কী? যদি মূল সার্টিফিকেটে এত প্রিন্টিং মিস্টেক না থাকত, তাহলে কোন ব্যাটার সাধ্য ছিল ধরার! কিন্তু কী আর করা... এখনকার মতো তো এত উন্নতমানের প্রেস ছিল না তখনকার দিনে। অগত্যা ওই লজঝড়ে সরকারি প্রেসই ভরসা। যাই হোক, তুমি নিশ্চয়ই সমর্থন করবে ব্যাপারটা। এক-আধটা বিষয়ে কম নম্বর পাওয়ার জন্যে কোনো ছাত্রকে ফেল করিয়ে তার সারাটা জীবন বরবাদ করে দেওয়ার কোনো যুক্তি আছে? তাই বলে যাকে-তাকে তো সার্টিফিকেটের কপি ঢালাওভাবে দিইনি। দু’তিনবার লাগাতার ফেল করার পরে, তবেই না ওদের পাস করানোর জন্য...।
আপনার সার্টিফিকেট দিয়েছেন, স্যার?
তাহলে ওরাও নিশ্চয়ই এর জন্যে আপনাকে কিছু না কিছু দিয়েছে বিনিময়ে।
তা দিয়েছে কখনো-সখনো। কোনো জোর করিনি কোনোদিন। যার যেমন সঙ্গতি তেমন দিয়েছে। টাকার লোভ আমার ছিল না। আর তুমি তো জানো ভালো করেই। দয়ামায়াহীন শিক্ষক ছিলাম না কোনোকালেই। সবসময় ছাত্রদের ভালো কথাই ভেবেছি।
কুশল মাস্টারমশাই ঠিকই বলেছেন। চলন্ত ট্রেনের জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছি বাইরের দিকে। দ্রুত সরে যাচ্ছে ঘন সবুজ ধানখেত। দেখতে দেখতে মনে পড়ে যাচ্ছিল স্কুল জীবনের কথা। একবার হাফ ইয়ারলি পরীক্ষার সময় হিন্দি প্রশ্নপত্র হাতে নিয়ে সামনে তাকিয়ে বসে আছি ভূতের মতো। পাস নম্বর তোলা দূরের থাকুক- একটা প্রশ্নেরও উত্তর জানা নেই আমার। পরীক্ষার হলে সেদিন গার্ড দিচ্ছিলেন কুশল মাস্টারমশাই। হঠাৎ এসে চুপটি করে দাঁড়ালেন আমার পাশে। তার শরীর থেকে ভুরভুর করে আসছে লবঙ্গের সুবাস।
কী হলো, চুপ করে হাত গুটিয়ে বসে আছ? এখনো তো শুরুই করোনি। শেষ করবে কী করে? মাস্টারমশাই জানতে চাইলেন।
পারছি না, স্যার। কিচ্ছু পারছি না। হিন্দি আমার জন্য বড্ড কঠিন। একটা উত্তরও জানা নেই। কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম।
ঘাবড়ানোর কিচ্ছু নেই। প্রায় ফিসফিস করে কানের কাছে মুখ এনে বললেন, কিছু না পারলে, প্রশ্নগুলোই কপি করো...।
যাতে ফেল না করতে হয়, তাই প্রাণপণে মাস্টারমশাইয়ের কথা মতো অবিকল পুরো প্রশ্নপত্রটাই কপি করে দিলাম পরীক্ষার খাতায়। কী আশ্চর্য! দিন পনের পর রেজাল্ট বের হলে দেখি পাস করে গেছি!
এরপর একদিন স্যারকে ফাঁক পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম- স্যার, আমি তো একটা উত্তরও লিখতে পারিনি। এমনকি হিন্দি থেকে ইংরেজি ট্রান্সলেশনও করতে পারিনি। শুধু আপনি যেমন বলেছিলেন, হুবহু কপি করে দিয়েছি প্রশ্নপত্রটা। তাহলে পাস করলাম কীভাবে?
নিখুঁতভাবে কপি করতে পেরেছিলে বলেই তো পাস করিয়ে দিয়েছিলাম। মৃদু হেসে বললেন কুশল স্যার, তোমার অমন মুক্তোর মতো হাতের লেখা, ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন খাতা দেখেই বুঝেছিলাম, কখনো যদি সুযোগ পাও হিন্দি শেখার, খুব ভালো হিন্দি লিখতে পারবে...।
সেই দিনের কথা মনে করে আমার পুরনো মাস্টারমশাইয়ের প্রতি সহানুভূতিতে মনটা ভরে গেল। মন কেমন করে উঠল তার জন্যে। ওনার দিকে একটু ঝুঁকে বসে ওনার হাঁটুতে হাত রেখে সান্তনার স্বরে বললাম- স্যার, আপনাকে যদি ওরা দোষী সাব্যস্তও করে, তবুও বেশিদিন আটকে রাখতে পারবে না। জেল থেকে বের হওয়ার পর দিল্লি বা পিরোজপুর যেখানেই থাকুন না কেন, আমাকে একবার খবর দেবেন শুধু। জানেন তো স্যার, এখনো হিন্দিতে আমি আগের মতোই কাঁচা। দয়া করে যদি একটু পড়ান, দেখিয়ে দেন... দক্ষিণাও দেব স্যার।
মাস্টারমশাই এবার পেছন দিকে মাথা হেলিয়ে টান টান হয়ে বসলেন। তারপর আচমকা এমন জোরে হেসে উঠলেন যে ট্রেনের কামরায় প্রতিটি মানুষ কেঁপে উঠল হাসির আওয়াজে।
হিন্দি শেখাব... তো-মা-কে! রীতিমতো চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি। ওহে, কে তোমাকে এমন অদ্ভুতুড়ে ধারণা দিল যে আমি হিন্দি জানি বা কখনো জানতাম...?
তাহলে স্যার, হিন্দি যদি না-ই জানবেন, এতদিন ধরে স্কুলের ক্লাসে কী পড়াচ্ছিলেন?
পা-ঞ্জা-বি...। এত জোরে কর্কশভাবে চেঁচিয়ে উঠলেন মাস্টারমশাই, এবার আশপাশের প্রত্যেকেই ভয় পেয়ে নড়েচড়ে বসল নিজেদের সিটে। মাস্টারমশাই আবারো বললেন, আদি ও অকৃত্রিম পাঞ্জাবি। কিন্তু তোমাদের মতো আকাঠ মুখ্যুরা কী করে জানবে এ দুটো ভাষার মধ্যে কী পার্থক্য...!

 
Electronic Paper