টিটু ও তার বোকা ডায়েরি
দীলতাজ রহমান
🕐 ৩:৫৭ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৬, ২০২১
কথাসাহিত্যিক মোস্তাফিজুর রহমান টিটুর নাম অস্ট্রেলিয়ায় আসার আগেই শুনেছিলাম। শুনেছিলাম মানে ছোট পত্রিকা ‘ঢলভাঙা’র সম্পাদক সোহাইল মুশফিক টিটুর গল্পের দারুণ ভক্ত! তিনিই বলেছিলেন- আপা, অস্ট্রেলিয়ায় যাচ্ছেন যখন, সেখানকার প্রবাসী এক লেখকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই...।
বলেই ফোনটা আমার কানে তুলে দিলেন। কথা হলো টিটুর সঙ্গে। জানলাম, টিটু থাকেন কুইন্সল্যান্ড। আর আমি সে-বার এসেছিলাম মেলবোর্নে। মেলবোর্ন যে অস্ট্রেলিয়ার অংশ তখনো জানা ছিল না। তার ওপর মেলবোর্ন থেকে কুইন্সল্যান্ড প্লেনেই ঢাকা থেকে দিল্লির দূরত্ব। তাই টিটুর সঙ্গের সে পরিচয় নতুন রুমালের মতো ভাঁজ করাই রইল। আমাদের এইসব সরল প্যাঁচের কথাবার্তার সেদিন সোহাইল মুশফিকের সঙ্গে ছিল তার বন্ধু লেখালেখির আরেক মানুষ কাজী দীন মোহাম্মদ।
কিন্তু তৃতীয় বা চতুর্থবারে মতো যখন অস্ট্রেলিয়ায় এলাম, তখন কুইন্সল্যান্ডেই এলাম। কারণ যার কাছে আসি, সে আমার বড় কন্যা ড. ফারহানা। তাই জামাতা ড. মাহফুজ চৌধুরী মেলবোর্ন থেকে বদলি হয়ে ততদিনে কুইন্সল্যান্ডে চলে এসেছিলেন। তো কুইন্সল্যান্ডেই এক বিলম্বিত বৈশাখী মেলায় একজন এগিয়ে এসে বললেন, আপনি বোধহয় দীলতাজ আপা!
আমি বললাম, চিনলেন কী করে? আগন্তুক জানালেন, তার মন বলছিল! তিনি নিজে মোস্তাফিজুর রহমান টিটু। কাকতালীয় বিষয়টা মনে বেশ কলরব তুলল, পৃথিবী আমাদের জন্য কত আয়োজন সাজিয়ে লুকিয়ে রাখে আর ধীরে পুষ্পের বিকশিত হওয়ার মতো প্রকাশ করে! গল্পকার টিটুর গল্পের সঙ্গে ‘ঢলভাঙা’ পরিচয় করালেও পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন পত্রিকায়ও তার গল্প দেখলেই পড়ি। পরিচিত মানুষের লেখা পড়ার একটা দায় থাকে। আর তা এ জন্য, যার সঙ্গে কথা বলছি, তিনি যদি একজন সৃজনশীল মানুষ হন, তা হোন তিনি কুমোর বা বাঁশের মোথার কারিগরও, তার বন্ধুতে সম্মান জানাতে হলে তার সৃষ্টি ধরেই অগ্রসর হতে হবে। সেটাই একমাত্র উত্তম মাধ্যম।
তার ওপর আবার বিদেশে এসে বাঙালি দেখলেই আরেক বাঙালির আত্মীয় মনে হয়, এ তো পুরনো প্রবাদ। কিন্তু আসলেই তো তাই। তার ওপর একজন লেখকের প্রতি অন্য লেখকের আগ্রহ এমনিতেই থাকে। তাও অল্প পরিসরে হাতেগোনা ক’জনকে পেয়ে আমার খুব ইচ্ছে ছিল এখানে যে জন লেখক আছেন, তাদের সঙ্গে পরিচিত হই। কথাসাহিত্যিক মহিবুল আলম আছেন। নতুন পরিচয় হলো ড. এম. আল-মামুনের সঙ্গে। আরও কেউ কেউ নিশ্চয়ই আছেন। পরিচয়টা আসলে এত বিস্তৃত হয়ে ওঠেনি এখানে। লেখালেখির মানুষরা শেকড় ছেড়ে বিদেশে এলে লেখার রস ফুরিয়ে আসে বলে আমার মনে হয়। মানে যে রসে ওই মাটির সোঁদা গন্ধ ভাসে। তাই একটা এলাকায় কুড়িয়ে-কাছিয়ে যে ক’জন স্বদেশি পাওয়া যায়!
ভুবনজুড়েই লেখক কি আর বেশি জন্মেছে? তাই যেখানে যে ক’জন থাকে তারা যদি সবাই লেখার জন্য, লেখাকে জীবনঘনিষ্ঠ করতে সেই নিজেদের স্মৃতি- নতুন পড়াশোনা সব নিয়ে নিয়ম বেঁধে আড্ডা দেয়, তাতে লেখালেখির শক্তিটা বেগবান থাকে বলে মনে হয়। কারণ বিদেশের ব্যস্ততা ভিন্ন কিছু এবং চাকচিক্যময় জীবন দিলেও দেশীয় রূপ-রঙ-রস প্রাণ থেকে শুষে নেয়। শুরু করেছিলাম গল্পকার টিটুকে নিয়ে। টিটু আগেও তার একটি উপন্যাস আমাকে দিয়েছিলেন- ‘মগ্ন অপরাহ্ন’। বইটি পড়া শেষ করে মেলবোর্নে অবস্থানকারী সাহিত্যিক-চিকিৎসক আহমেদ শরীফ শুভকে পড়তে দিয়েছি।
‘জীবন আধেকলীন’ নামে টিটু আরও একটা উপন্যাস আছে। আছে গল্প সংকলন- ‘প্রথম কুঁড়ি’। সম্প্রতি হাতে এসেছে নতুন গল্পগ্রন্থ ‘বোকা কিশোরীর বোকা ডায়েরি’ নামটি আমার কাছে যুৎসই মনে হয়নি। নামটি দেখলে বা শুনলেই মন ঝলমল করে ওঠে না! কিন্তু এক সরল-সিধা কিশোরীকে দিয়ে সত্য কথাটি কোনো না কোনোভাবে বলিয়ে নিয়েছেন লেখক। সত্য বলাকেই এ বইয়ে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। নাম ‘বোকা কিশোরীর বোকা ডায়েরি’ হলেও কিশোরী আসলে বোকা নয়। সে সত্য বলার তাড়নায় ভোগে। যে কিশোরীর নামে ডায়েরি লিখে কথাসাহিত্যিক টিটু ১৩০ পৃষ্ঠার বইটি প্রকাশ করেছেন, কিশোরীর নাম রেখেছেন আরিয়ানা শামস তরু।
পাঠক যেন চমৎকার নামের মেয়েটির লেখা ডায়েরিটি উৎসাহ নিয়ে কেনেন এবং সত্য কথা বলাকেই জীবনে সার করে তোলেন। বইটির প্রকাশক ‘চৈতন্য’। মূল্য ৩০০ টাকা। প্রচ্ছদ করেছেন নির্ঝর নৈঃশব্দ্য।