ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

না বলা কথা

এস আর শাহ্ আলম
🕐 ৩:৪৫ অপরাহ্ণ, জুলাই ০২, ২০২১

না বলা কথা

ঘড়ির কাঁটায় রাত দশটা বাজতে এখনো দশ মিনিট বাকি। বিকেল থেকেই রুমঝুম অবিরাম ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। সেই জুমার নামাজ পড়ে রাজ বেরিয়েছে। এখনো রুমে ফেরার নাম নেই। আর ফিরবেই-বা কী করে, সে তো সুযোগ পেলেই হাইকোর্টসহ বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে বিকলাঙ্গ-প্রতিবন্ধী ফকির মিসকিনদের খোঁজখবর নিতে যায়। যথাসাধ্য চেষ্টা করে অর্থকড়ি দিয়ে সাহায্য করতে। আসলে এদের জীবন যে জীবন নয়।

আস্ত একটা নরক! সমাজে এদের অবস্থান কোথায়? রাজ সেটা বেশ ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পারে। তাই বুঝি এমন আট কপালে মানুষদের দেখলে তার বুকটা হু হু করে কেঁদে ওঠে। স্রষ্টার কাছে রাজের একটাই অনুনয়, আর যাই হোক তিনি যেন পৃথিবীতে এমন ভর্ৎসনার জীবন কাউকে দান না করেন। শাসিত এই সমাজের চোখে বিদ্রুপের দহনে কেবলই এরা জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। সে অনলের আঁচ বড়ই মর্মাহত বেদুইন বেদনার্ত; যা প্রতিনিয়ত রাজ সয়ে এসেছে! দু’বছর বয়সে টাইফয়েড জ্বরের এক করাল ছোবলে তার বাম পা অকেজো হয়ে যায়। সেই থেকে রাজ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাটে। নিয়তির নির্মম কষাঘাত মেনে নিয়ে বহু পরিস্থিতি প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে। ইচ্ছে ছিল ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে নিগূঢ় অন্ধকার জীবনের বোঝা কিছুটা হলেও হালকা করবে। কিন্তু দারিদ্র্যের বাস্তব প্রেক্ষাপটের জল ততদূর অব্ধি পৌঁছায়নি বলে। সংসারের হাল ধরতে গ্রাম ছেড়ে রাজধানীর মতিঝিলে একটা বেসরকারি ফার্মে অফিস সহকারী পদে নিযুক্ত হয়েছেন। পাঁচ বছরের চাকরি জীবনে অফিসের সহকর্মী নিজামের সঙ্গে বেশ বন্ধুত্বও হয়ে গেছে।

দুজন অফিসের পাশে দোতলায় ফ্ল্যাট নিয়ে থাকেন। সকালে বুয়া এসে রান্না করে দিয়ে যান, তা দিয়েই দুপুর অব্ধি চলে। অফিস ছুটির পর বাসায় ফিরে দুই বন্ধু নানা খোশগল্প, হাসি-ঠাট্টা শেষে রাতের খাবার নিজেরাই রান্না করেন। কিন্তু রাজ এখনো ফেরেনি। রাতে দু’বন্ধুকে এনাদের বাসায় ইনভাইট করেছে। সে কথা মনে হয় রাজ আজকেও ভুলে গেছে। নাকি ইচ্ছে করেই সে মাঝে মাঝে এমন করে, তা বুঝতে পারে না নিজাম। এনা ওদের সঙ্গে একই অফিসে কাজ করে। রাজকে প্রচ- ভালোবাসে। গেল বছর নিজামের বিয়ের নিমন্ত্রণ করতে রাজকে সঙ্গে নিয়ে একবার এনাদের বাড়িতে গিয়েছিল। সেই থেকে এনার বাবা-মা ও রাজকে ভীষণ পছন্দ করেন। তাই একমাত্র মেয়ের চাওয়া যাতে অপূর্ণ না থাকে, সে ব্যাপারেই কথা বলার জন্য, বেশ কয়েকবার নিমন্ত্রণ করেছে। কিন্তু রাজ এ কথা, সে কথা বলে উড়িয়ে দেয়। এনা এবং রাজ একই পোস্টে পাশাপাশি টেবিলে কাজ করে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে এনার দৃষ্টি বারবার রাজের দিকে পড়ে। রাজ তা ভ্রƒক্ষেপ করে না। এনা দেখতে বেশ সুন্দরী স্মার্ট একজন মেয়ে। তারপরেও রাজ কেন তাকে এভয়েড করে? কেন সে এনার প্রতি বিমুখী? এনাকে দেখলে কেন সে নিজেকে শামুকের মতো গুটিয়ে নেয়? কী কারণে এনার পাশে নিজেকে অ্যাডজাস্ট করতে চায় না রাজ! বিয়ের কথা বললেও কেমন জানি উদাসীনতায় অন্যমনস্ক হয়ে যায়। এটা কি রাজের কোনো দম্ভ? নাকি এনার প্রতি তার কোনো ক্রোধ বা আক্রোশ; এর কোনো উত্তর বিগত বছরগুলোতে খুঁজে পায়নি নিজাম। কিন্তু আজ সে পণ করেছে যেভাবেই হোক প্রিয় বন্ধুর না বলা কথা শুনবেই। মুহূর্তের মধ্যেই কলিং বেলটা বেজে উঠল। দরজা খুলে নিজাম জিজ্ঞেস করল, এতক্ষণে আসার সময় হলো তোর?

হাতে রাখা শপিং ব্যাগটা নিজামের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এটা ধর, আমি ভেজা কাপড় ছেড়ে আসি। সেন্টার টেবিলের ওপর ব্যাগটা রেখে জানতে চাইল নিজাম, এটা কী? ততক্ষণে রাজ ফ্রেশ হয়ে কিচেন থেকে দুটো প্লেট এনে সেন্টার টেবিলে রেখে উত্তর দিলÑ আমি জানতাম একা একা রান্না করতে তোর ভাল্লাগবে না। তাই ফেরার পথে পুরান ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোড থেকে দুই প্যাকেট কাচ্চি নিয়ে এলাম। কথার ফাঁকে খাবার পর্ব শেষ করে নিজাম বলল, আজও তাহলে এনাদের বাসায় যাওয়া হলো না? বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে মৃদু হেসে রাজ বলল, আজ তো বৃষ্টির কারণে পিছিয়ে পড়লাম অন্য একদিন যাব।

: কিন্তু আজ তোকে বলতেই হবে, কেন এনাকে তুই এড়িয়ে চলিস। যে মেয়েটা তোকে পাগলের মতো ভালোবাসে, তা জেনেও কেন তুই না জানার ভান করে থাকিস?
রাজ কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল।

: কীরে কথা বলছিস না কেন?

: কী বলব!

: দেখ রাজ, আজকে যদি আমার প্রশ্নের উত্তর না পাই, তাহলে তুই শুনে রাখ চাকরি ছেড়ে দিয়ে, গ্রামে গিয়ে চা কিংবা পানের দোকান করে খাব। তবুও যে আমাকে আপন ভাবতে পারে না তার সঙ্গে আর থাকব না।

শোয়া থেকে উঠে রাজ বলল, দেখ নিজাম, তুই ছাড়া এই শহরে কে আছে আমার বল। আমার জীবনে এমন কোনো কথা নেই যা তোকে বলিনি। তবে একটা কথা অবশ্য গোপন রেখেছি। ভেবেছিলাম আমাকে নিয়ে যে মানুষটা পরিহাসের খেলায় মেতে ছিল। তার কথাটা পৃথিবীর কাউকে নাইবা বললাম। কিন্তু তুই যখন সে কথাটা না শুনে কষ্ট পাচ্ছিস, তাহলে শোন। আমাদের বাড়ির পাশেই ছিল অদিতিদের বাড়ি। কৈশোর থেকেই ওর প্রতি কেমন জানি দুর্বল ছিলাম। ওকে এক নজর দেখার জন্য, সুতো কাটা ঘুড়ির মতো কিংবা ছোটবেলায়, মেলায় গিয়ে হাত-ফসকা গ্যাস বেলুনের মতো দূর আকাশে আমার মনটা কেমন করত। যখন দুজন একসঙ্গে স্কুলে যেতাম, অদিতির বাঁকা চাহনি দেখে বুঝতে পারতাম, অদিতির প্রেমে পড়েছি।

আমি ওর গভীরে নিমজ্জিত হচ্ছি। কখনো কখনো হারিয়ে যেতাম ওর চোরাবালি চোখে। ওদের বাড়িতে পিঠা-পায়েস তৈরি হলে, অদিতি লুকিয়ে এনে আমাদের বাঁশঝাড়ে বসে আমাকে খাওয়াত। এভাবে অনেক হাসি আনন্দের মুহূর্তগুলো বুকে নিয়ে দুজন একসঙ্গে মাধ্যমিক পাস করলাম। বকুল ফুল আমার প্রিয় ছিল বলে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছি এ খবর শোনার পর শরতের এক বিকেলে একটা বকুল ফুলের মালা গেঁথে আমার গলায় পরিয়ে দিয়েছিল। অদিতি আমার সামনে এলে সর্বক্ষণ ওর ঠোঁটের কোণায় ঈষৎ হাসি দোল খেত। অদিতি আমাকে প্রচ- ভালোবাসে, এ বিশ্বাস আমার প্রতিটি সেকেন্ডে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হতো। মনে হতো যেন নতুন এক পৃথিবী আমার মনে-মাথায়-মগজে। আমি যেন মৃগনাভীর গন্ধ নেওয়া এক মাতাল হরিণ। কিন্তু ওকে যে আমার জীবনের চেয়েও ভালোবাসি।

এ কথাটা কখনো বলার সাহস পেতাম না। ফার্স্ট ইয়ারের মাঝামাঝি সময়ে এক পড়ন্ত বিকেলে সংকোচহীন সাবলীল আস্থাপূর্ণভাবে সেই কথাটা বললাম। তা শুনে অদিতি অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছিল। কারণ জানতে চাইলাম। তখন অদিতি আমাকে নিয়ে বিদ্রুপ পরিহাস করতে লাগল। যে কথাগুলো আমার কানে সেদিন গরম সীসার মতো লেগেছিল। যা মনে হলে এখনো আমার বুকের ঠিক মাঝখানে সূক্ষ্ম ধারালো ইস্পাতের মতো বিঁধে আছে। এখন তুই বল যাকে আমি শৈশব, কৈশোর থেকে দেখে এসেছি। যে ছিল আমার পড়ার সাথি, খেলার সাথি। তাকে ভালোবসি কথাটা শোনার পর সেই অদিতি যখন আমার কচি মনটাকে ভেঙে দিয়েছে। আর এই এনার সঙ্গে মাত্র তো চার বছরের পরিচয়।

এই মেয়ে যে আমাকে ল্যাংড়া লুলো বলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করবে না এটা বিশ্বাস করি না। তুই জানিস না, নিজাম আমার ভাঙা মনে পাথর চাপা দিয়ে বেঁচে আছি। তাই আমি চাই না অন্য কোনো মেয়ের আঘাতে সেই চাপা পাথরটা সরে গিয়ে ঘুমিয়ে থাকা যন্ত্রণাটা ফের জেগে উঠুক। এতক্ষণ ধরে রাজের না বলা কথাগুলো শুনে নিজামের চোখ থেকে টপটপ করে অশ্রু ঝরতে লাগল। আলতো করে চোখ মুছে বলল, শোন রাজ, অদিতিকে শুধু তুই একাই ভালোবেসে গিয়েছিলি। অদিতি কোনোদিন তোকে ভালোবাসেনি। শুধু করুণা করে গেছে। যেটা তুই বুঝতে পারিসনি। অদিতি ছিল একটা স্বার্থপর। আর তুই তো জানিস স্বার্থপর হওয়ার সহজ উপায় হলো বিবেকহীন হওয়া। কেননা বিবেক বেঁচে থাকলে মানুষ কখনো স্বার্থপর হতে পারে না। তুই দেখিস, ওই মেয়ে কখনো সুখী হতে পারবে না। কেন তুই এনার মতো একটা ভালো মেয়েকে দুঃখ দিচ্ছিস। এনা তোকে জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। টেলিফোনটা ক্রিং ক্রিং আওয়াজে বেজে উঠল। নিজাম রিসিভারটা কানে তুলে রাজের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, তোর ফোন। টেলিফোনের কথা শুনে রাজের মুখটা জ্বলজ্বল করে ওঠে। কিন্তু এক নিমিষেই তা বিলীন হয়ে, মুখ যেন চন্দ্রগ্রহণে ছেয়ে যায়। রিসিভারটা রাখতেই নিজাম প্রশ্ন করল, কী রে, কী হয়েছে?

: গ্রাম থেকে মা ফোন করেছে। আমার বড় আপার ছেলে হয়েছে।

: মানে তুই মামা হয়েছিস। এটা তো খুশির খবর।

: তার সঙ্গে একটা দুঃখের খবরও আছে। অদিতির পছন্দ করা, বড় লোকের ছেলে সেই মাদকাসক্ত ও জুয়াড়ি স্বামী হঠাৎ স্ট্রোক করেছে। এবং সেই সঙ্গে দেহের এক অংশ অবশ হয়ে গেছে। ঢাকাতে কোন হসপিটালে ভালো চিকিৎসা হবে মা সেটা জানতে চেয়েছে।

: দেখেছিস, কাউকে নিয়ে বিদ্রƒপ করার পরিণাম কী! দেখিস ওই মেয়ের চোখের জল কোনোদিন ফুরাবে না।

: এভাবে বলিস না নিজাম। আমি চাই অদিতি ওর স্বামী-সন্তান নিয়ে সারাজীবন সুখে থাকুক। আমি ওর চোখের জল সইতে পারব না। অদিতি আমাকে ভালো নাইবা বাসল!

 
Electronic Paper