ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

কালের বিবর্তনে ম্রিয়মান পুঁথিসাহিত্য

বারী সুমন
🕐 ৩:১৯ অপরাহ্ণ, জুন ২৫, ২০২১

কালের বিবর্তনে ম্রিয়মান পুঁথিসাহিত্য

‘হারিকেনের টিমটিমে আলোর সাথে আসমানে উঁকি দিত আধফালি চাঁদ। বাঁশঝাড়ের পাতার ফাঁকে দিয়ে এক চিলতে আলোর ঝলকানি পুঁথি পাঠের আসরকে আরও মোহনীয় করে তুলত।’

সংস্কৃত শব্দ ‘পুস্তিকা’ শব্দ থেকে পুথি শব্দটির উৎপত্তি। এর নাসিক্য উচ্চারণ পুঁথি। হাতে লেখা বইকে আগে ‘পুস্তিকা’ বলা হতো। যেহেতু আগের দিনে ছাপাখানা ছিল না, তাই তখন হাতে পুঁথি লেখা হতো। প্রাচীন বা মধ্যযুগের প্রায় সকল সাহিত্য হাতে লিখতে হয়েছিল এবং এদের একাধিক সংস্করণও তৈরি হয়েছিল হাতে লিখে। তাই প্রাচীন ও মধ্যযুগের সকল সাহিত্যকেই পুঁথিসাহিত্য বলা হয়। পুঁথিসাহিত্য আরবি, উর্দু, ফারসি ও হিন্দি ভাষার মিশ্রণে রচিত এক বিশেষ শ্রেণির বাংলা সাহিত্য। আঠারো থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত এর ব্যাপ্তিকাল। এ সাহিত্যের রচয়িতা এবং পাঠক উভয়ই ছিল মুসলমান সম্প্রদায়।

পুঁথি এক সময় মুখে মুখে রচিত হতো। লোককাহিনির মতোই পুঁথির জন্ম। পরবর্তীকালে লিখে স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করা হয়। পুঁথি সাধারণত কোনো একটি কাহিনিকে কেন্দ্র করে রচিত। বাংলাদেশেও পুঁথিসাহিত্যের বেশ সুনাম রয়েছে। পুঁথিসাহিত্য পরবর্তীকালে গ্রাম-বাংলায় পাঠ করত গ্রামের কিছু পাঠক। তারা সুর করে পাঠ করত পুঁথি। একটি পুঁথি পাঠ করে শেষ করতে লেগে যেত অনেকদিন। কখনো কখনো মাসও পার হয়ে যেত। নানা অঙ্গভঙ্গি আর হাস্যরসাত্মক কথার মধ্য দিয়ে পুঁথি পাঠ করত। সাধারণত বয়স্ক ব্যক্তি যিনি পুঁথি পাঠ জানতেন এবং এর কাহিনি সম্পর্কে অবগত তিনিই পাঠ করতেন। পুঁথি পাঠে পাঠকের সুর একটি মুখ্য বিষয় ছিল। পুঁথির সুরটি অন্যান্য সুর থেকে একটু আলাদা। পুঁথির কিছু অংশ পাঠ করে এর সারসংক্ষেপ পাঠক, উপস্থিত দর্শকদের বুঝিয়ে দিতেন কথার মাধ্যমে।

পুঁথি পাঠ সাধারণত রাতের বেলা অনুষ্ঠিত হতো। সবাই খাওয়াদাওয়া শেষ করে অবসর সময়ে কোনো এক আঙিনায় জড়ো হতো। তারপর সেখানে উপস্থিত হতো পুঁথিপাঠক। অনেক পুঁথিসাহিত্য বাংলায় নামকরা ছিল। গুলেব কাওলি, বাহরাম বাদশা, লাইলি মজনু, ইউসুফ জোলেখাসহ বহু পুঁথি সাহিত্য জনপ্রিয় হয়েছিল। যা বাংলার অমূল্য সম্পদ। আগে থেকেই তারা ঠিক করে নিত কোন পুঁথিটি পাঠ করবে।

আগেই বলেছি, একেকটি পুঁথি শেষ করতে মাসখানেক বা তার বেশি সময়ও লেগে যেত। বাড়ির ছোট ছেলেমেয়েরা থেকে শুরু করে, মুরুব্বি এবং মহিলারাও পুঁথি শুনতে আসত। যে বাড়িতে পুঁথি পাঠ করা হতো শুধু সে বাড়ির নয়, এ শ্রোতা থাকত আশপাশের অনেক বাড়ির মানুষজন। সবাই নির্ধারিত সময়ে পুঁথি পাঠের আসরে চলে আসত। হারিকেনের টিমটিমে আলোয়, জলচৌকিতে পুঁথি রেখে পাঠক আসন করে বসত। চারদিকে সবাই নীরব। তারপর সুর করে পাঠ চলতে থাকত। কয়েক লাইন পড়ে পাঠক থামতেন এবং এর মর্মার্থ উপস্থিত দর্শকবৃন্দকে বুঝিয়ে দিতেন। পুঁথি পাঠের কথা শুনে কখনো হেসে কুটিকুটি হয়েছেন দর্শক, কখনো-বা চোখের কোণে জমেছে অশ্রু। পুঁথি পাঠের মাঝখানে থাকত বিরতি। পাঠককে চা করে এনে দিত। সঙ্গে উপস্থিত দর্শকরাও চা পান করত। সঙ্গে একটু পান বা তামাকের ব্যবস্থা করা হতো। বিরতির পর আবারও শুরু হতো পুঁথি পাঠ। রস-রসাত্মক, হাসি-ব্যঞ্জনায় ভরে থাকত পুঁথি পাঠের পুরো সময়টি। রাত যত গভীর হতে থাকত পুঁথি পাঠ ততই জমে উঠত। ছোট বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়ত মায়ের কোলে। বসার তেমন ব্যবস্থা না থাকলেও চাটাই বিছানো থাকত, কখনো আরেকটু আরাম প্রিয় করার জন্য খড় বিছিয়ে নেওয়া হতো।

পাঠক নানান কথা দিয়ে বর্ণনা করে পুঁথি পাঠের পুরো সময়টিকে মাতিয়ে রাখতেন। গ্রাম-বাংলার প্রতিদিনের অঘোষিত একটি সময় থাকত এই পুঁথি পাঠের জন্য। সে সময়ে সবাই পুঁথি পাঠের আসরে চলে আসত। এটা প্রতিবেশীদের সঙ্গে একটি সম্পর্কের সেতুবন্ধনও বলা যেতে পারে। এ বাড়ির ও বাড়ির মানুষের খোঁজখবর নেওয়ারও একটা মাধ্যম ছিল পুঁথি পাঠের আসর। কে এলো কে এলো না, কেন আসেনি, কেউ অসুস্থ কিনা এমন খোঁজ-খবরের মাধ্যমে সামাজিক সম্প্রীতি আরও সুদৃঢ় হতো। এখানে কত অজানা কাহিনি উন্মোচিত হতো তা বলার অপেক্ষা রাখে না। উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা তখন এ পুঁথি পাঠ শুনতে আসত। পুরোপুরি মর্মার্থ না বুঝতে পারলেও আনন্দ পেত এবং এ সময়টা তারা অন্য কোনো কাজে অপব্যয় না করে বিনোদনের মধ্য দিয়ে কাটাত।

পুঁথি পাঠ তখনকার দিনের একটি বিনোদনেরও মাধ্যম ছিল। বাড়িতে কোনো মেহমান এলে বা বিশেষ কোনো অনুষ্ঠান থাকলে সেদিনের আসরটা আরও বেশি জমজমাট হতো। বিভিন্ন উপলক্ষকে কেন্দ্র করে পুঁথি পাঠের অনুষ্ঠানে মজাদার খাবারেরও আয়োজন থাকত। হারিকেনের টিমটিমে আলোর সঙ্গে আসমানে উঁকি দিত আধফালি চাঁদ। বাঁশঝাড়ের পাতার ফাঁকে দিয়ে এক চিলতে আলোর ঝলকানি পুঁথি পাঠের আসরকে আরও মোহনীয় করে তুলত। এমনি কত হাসি কান্নার ভিতর দিয়ে যে একটি পুঁথি শেষ হতো তা বলা কঠিন। এই পুঁথি পাঠের আসরে এসে একেকটি পরিবারের সঙ্গে গড়ে উঠত দৃঢ় সম্পর্ক।

সময়ের বিবর্তনে আজ অনেক গ্রামীণ ঐতিহ্যই আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান প্রজন্মের অনেকে জানেই না পুঁথি কী জিনিস, তা কীভাবে পাঠ করা হতো। বর্তমান সময় প্রযুক্তির যুগ। প্রযুক্তির ভালো ও খারাপ দুটো দিকই আছে। তখনকার সময়ের ছেলেমেয়েরা পুঁথি পাঠ বা গ্রামীণ কিচ্ছাগান দেখে বিনোদন পেত। আর বর্তমানে অনলাইনভিত্তিক বহু বিনোদন মাধ্যম রয়েছে। তবে সেকালের পুঁথি পাঠ আর বর্তমানের প্রযুক্তির বিনোদনে রয়েছে বিস্তর তফাৎ। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে পুঁথি পাঠ সম্পর্কে অবহিত করতে হবে। তা না হলে একসময় তারা জানবেই না বাংলা পুঁথি সাহিত্যেরও একটা স্বর্ণযুগ ছিল। যারা সাহিত্যপ্রেমী, লোকসংস্কৃতি নিয়ে কাজ করেন, গবেষণাধর্মী কাজ করেন, পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি সকল সংগঠন ও ব্যক্তির পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে পুঁথি সাহিত্যকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে নতুন প্রজন্মের জন্য।

 
Electronic Paper