ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

মৃত্যু মিশ্রিত আখ্যান

রিপন আহসান ঋতু
🕐 ২:১৭ অপরাহ্ণ, জুন ১১, ২০২১

মৃত্যু মিশ্রিত আখ্যান

সন্ধ্যার কালবৈশাখীর পর ঝিরঝিরে বৃষ্টিটাও থেমে গেছে। এখন শুধু ক্লান্ত পাতাগুলো থেকে টিপটিপ করে জলের ফোঁটা পড়ছে। বাড়ির আঙিনায় থাকা বাগান ছন্নছাড়া হয়ে গেছে। গাছে গাছে শুরু হয়েছে পাখির মাতম। ভেঙে পড়া পাখির বাসায় হয়তো ইঁদুররা হামলা চালিয়েছে। প্রকৃতির এমন পরিবেশটা দেখে মনটা বিষণœ হয়ে যায় মিলুর।

ঝড় শুরু হতেই বিদ্যুৎ চলে গেছে। চারপাশ এখন মহিষের মতো অন্ধকার। মিলু হ্যারিকেন জ্বালাল। হ্যারিকেন জ্বালানোর সঙ্গে সঙ্গে সামনে তৈরি হলো একটা ছায়া। সে ছায়া তার নিজেরই। হ্যারিকেনের সলতে যত বাড়াল ছায়া তত লম্বা হতে থাকল। আলো কমালেই ছায়া আবার ছোট হয়ে গেল। মিলু আবিষ্কার করল, হ্যারিকেন জ্বললে লম্বা ছায়া। আর না জ্বললে থলথলে আঁধার। সেই আঁধারে শুয়ে থাকে তাদের প্রকাণ্ড বারান্দা। এমন ঘনঘোর অন্ধকারে বারান্দায় বসলেই মৃত ছেলের কথা মনে পড়ে মিলুর। প্রকা- বারান্দার এক কোণ থেকে হেসে ওঠে ছেলে মাহিন। থলথলে আঁধারের মধ্যে হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসে তার দিকেই। কেঁপে ওঠে মিলু। মনে পড়ে স্বামী লতিফের কথা। স্ত্রী-সন্তান ছাড়া লতিফ এখন কেমন আছে? লতিফকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে মিলুর। কিন্তু সে তো দেশে নেই। পর দুটো ছেলে মারা যাওয়ার পরে মিলুকে রেখেই বিদেশে পাড়ি জমায় লতিফ। এমন অপয়া মেয়ের সঙ্গে কে ঘর করে।

মিলুও গ্রাম থেকে চলে এল শহরে। কাজ শুরু করল হাসপাতালে। সহকর্মী কয়েকজনের সঙ্গে এই বাড়িতে ভাড়া থাকে। কিন্তু এখন বাড়িতে কেউ নেই। সবাই হাসপাতালের ডিউটিতে। বাড়িটা ভারি সুন্দর। একদম গ্রামের দিকের সম্পন্ন গৃহস্থের বাড়ি যেমন হয়, তেমন। এখানে ছোট্ট একটা উঠোন আছে। গাছ-গাছালিতে ভরা। যদিও বাড়িটা মন্ত্রের মতো পুরনো। আশপাশে আগাছায় ভর্তি। লোকজনেরও আনাগোনা খুবই কম এদিকে। এসব নানা কিছু ভাবতেই মুহূর্তেই একটা অচেনা ভয় চেপে বসে। বারান্দা থেকে উঠে বিছানায় গিয়ে বসে মিলু। উত্তর পাশের জানালাটা খুলে দেয় মনের অজান্তেই।

চারপাশ চাপা অন্ধকার। অথচ সামনের জানালা ভেদ করে বের হয়ে আসছে অফুরন্ত বিজলি বাতির আলো। জানালায় চোখ পড়তেই মিলু দেখল খুনসুটি করছে মনি ভাই আর খুশি ভাবি। সরষে রঙের আলো এসে পড়েছে তাদের যৌথ শরীরে। মাঝে মাঝে ভিতর থেকে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির ছাট মেখে নিচ্ছে দুজন। তারা এখন রস ও রতিতে বিভোর। এতই বিভোর যে তাদের ক্রিয়ার ছায়া মিলুর বিছানায় এসে বারবার ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছে।

একসময় ওদের শীৎকারের ধাক্কায় মিলুর জানালা বন্ধ হয়ে যায়। শরীরের মধ্যে ডাকতে থাকে অচেনা এক ডাহুক। নিশুতি সেই ডাক এমনি যে শুনেছে সে জানে, এই ডাক অমোঘ। চোখ বন্ধ করে ঘুমাতে চেষ্টা করে মিলু। চাঁদনি রাত, নৃত্যপটিয়সী খুশি ভাবি যেন হাত বাড়িয়ে ডাকে মনি ভাইদের বাড়ির দিকে। মিলু বিছানাতে থেকে উঠে দরজা জানালা সব বন্ধ করে দেয় শক্তভাবে। বিছানা আঁকড়ে ধরে ঘুমানোর চেষ্টায়। শিমুল তুলোর কোলবালিশ চালান করে দেয় পেটের নিচে।

শিখরে শিখরে ধাক্কা খায় ভোরবেলা। ঘুম থেকে উঠে একটা কেমন যেন অন্যরকম ঠেকছে চারপাশ। চোখ খুলতেই মাথার উপর একটা নোংরা মশারি। তাতে নানা সাইজের ফুটো। কয়েকটা ফুটো আবার সেলাই করা। কয়েকটা সেফটিপিন মারা। তার উপরে কাঠের কাঠামোতে বাঁশের ছাউনির ছাদ। এলোমেলো বিছানায় বালিশ ছাড়াই শুয়ে আছে। বেডকভার দিয়ে শরীর ঢাকা। সেটাও কেমন জড়ানো। উঠে বসল। মনে পড়ে গেল কাল রাতে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো। মাথাটা কেমন ভারী ভারী লাগে মিলুর। গায়ে অনুভব করে ঢিমঢিমে জ্বর। দরজা খুলতেই দেখে আগুনের মতো জ্বলজ্বল করছে নবীন সূর্য। পাখিদের কিচিরমিচির ফুরিয়ে গেছে পেপারওয়ালার হাঁকডাকে। জানালা খুলতেই ঘর ভরে ওঠে চেনা এক সুঘ্রাণে। খানিক সময়ের জন্য থেমে যায় মিলু, অন্যরকম এক ভালোলাগায় চোখ বন্ধ হয়ে যায়। হঠাৎ ঢংঢং শব্দে ঘোর কেটে যায় মুহূর্তেই। খোলা চোখ গিয়ে পড়ে সোজা দেয়াল ঘড়িতে। ওহ, বড্ড দেরি হয়ে গেছে আজ। দ্রুত হাসপাতালে যেতে হবে তাকে। এখন রোগীর চাপ বেশি থাকায় বিশ্রাম নেওয়ার তেমন সুযোগও নেই।

মিলু একটি বেসরকারি হাসপাতালের চাকরি করে। ডিউটি করে শিশু ওয়ার্ডে। এই ওয়ার্ডেই দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে সে। কোনো রকমে রেডি হয়ে বাতাসের বেগে ছোটে হাসপাতালের দিকে। রাতেই শুনেছে একজন গর্ভবতী মা ভর্তি হয়েছেন। মিলু আপনা থেকেই ভাবতে থাকে এতক্ষণে নিশ্চয়্ই বাচ্চা হয়ে গেছে, নাম রাখাও হয়ে গেছে। এসব ভাবতে ভাবতেই হাসপাতালের মূল গেটে পৌঁছে যায়। দেখা হয় সহকর্মী শ্রাবণীর সঙ্গে। ক্লান্ত দেহে বাসায় ফিরছে এখন তার শিফট শেষ।
: কী রে রোগীর চাপ কেমন?
: ভালোই।
: নতুন বাচ্চা হয়েছে নাকি?
: হুম।
: কী নাম রাখল রে? মা-বাচ্চা ভালো আছে তো! মিষ্টি খেয়েছিস?
: নাম রাখেনি। এখন তোর ডিউটি, গিয়ে দেখ কী অবস্থা। আমার না এসব নিয়ে এখন কিছুই বলতে ইচ্ছে করছে না। একটানে কথাগুলো বলে শ্রাবণী মিলুকে কোনো রকমে এড়িয়ে দ্রুত বের হয়ে যায় হাসপাতাল থেকে। পুরো রাত পার হয়ে গেছে এখনো বাচ্চাটার নাম রাখা হয়নি! আজব ব্যাপার। এমন তো কখনো হয় না। মিলু এসব ভাবতে ভাবতেই শিশু ওয়ার্ডের বারান্দায় চলে এসেছে।

একটা বাচ্চাকে শোয়ানো হয়েছে বারান্দায়। মাথার কাছে ধূপ জ্বলছে। গায়ে পাতলা চাদর। এ দৃশ্য মিলুর পরিচিত। ও জানে মরা মানুষের গায়ে মাছি বসে। তাই মাছি তাড়াবার জন্য একখানা টেবিল ফ্যান ফুল স্পিডে চালিয়ে রাখা হয়েছে। তাতে গায়ের চাদর মাঝে মাঝেই সরে সরে যাচ্ছে। আচমকা সেদিকে চোখ পড়তেই মনে হচ্ছে, এই বুঝি নবজাতকটি লাথি মেরে চাদরটা সরাল।

বাচ্চাটার আশপাশে মানুষের ভিড় একেবারেই কম। তেমন কাউকে মাতম করতেও দেখা যাচ্ছে না। আদতে পৃথিবীতে যার আয়ু যত কম, তার প্রতি মানুষের দুঃখও তত কম। তবুও মিলু নবজাতকের মাকে খোঁজার চেষ্টা করে। দুই-তিনজন মহিলা পাশাপাশি বসে আছেন। তাদেরই একজনের কাছ থেকে শুধু চাপা গোঙানির শব্দ ভেসে আসছে। বাকিরা ব্যস্ত কত দ্রুত বাচ্চাটিকে দেশের বাড়ি নেওয়া যায় সে নিয়ে।

শোকে মন আচ্ছন্ন হয়ে আসে মিলুর। মনে পড়ে মৃত ছেলেদের কথা। রাজ্যের ক্লান্তি নিয়ে হেঁটে যায় স্টাফ রুমের দিকে। শুরু হয় নতুন এক কর্মব্যস্ততা। আজ রোগীর চাপ অনেক বেশি। শ্বাস ফেলার উপায় নেই। মিলুর আর এ পেশা একদম ভালো লাগে না। চাকরিতে চাপ থাকবেই সেটা কোনো সমস্যা না। সমস্যা হলো এ পেশার অনুষঙ্গগুলো। কেননা এখানে কোনো কিছু উপভোগ করার নেই। অসুস্থ মা ও শিশুদের সেবা করে সেরে তুলতে পারলে মিলুর আনন্দ হয় কিন্তু যখন কেউ অসুস্থ অবস্থায় মারা যান তখনই মিলু অস্থির হয়ে ওঠে। চাকরিটা ছাড়তে মরিয়া হয়ে ওঠে। কিন্তু চাকরি না করেও কোথায় যাবে সে? স্বামী থেকেও নেই, লতিফ এখন নিরুদ্দেশ। পরপর দুটো ছেলে মারা যাওয়া নিয়ে সবার ধারণা মিলু একটা অপয়া।

যখন ওয়ার্ড থেকে বের হলো মিলু, তখন দেখল সূর্য মাথা ছাড়িয়ে পশ্চিমদিকে হেলেছে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল আর বিকেল গড়িয়ে এখন সন্ধ্যা। মাথাটা কেমন টিপটিপ করছে। একবার ছাদ থেকে ঘুরে আসবে নাকি! যদিও এই সন্ধ্যাবেলায় ছাদে উঠতে দেখলে গার্ডরা নিশ্চয়ই চেঁচাবে। মিলুর নিজেরও কেমন যেন গা ছমছম করছে। চারদিকে আবছা অন্ধকার তার মধ্যে ধবধবে সাদা বিল্ডিংগুলো লাশের মতন দাঁড়িয়ে আছে। এই হাসপাতালের চারিদিক প্রায় নিঃশব্দ। গা ছমছম করাই স্বাভাবিক। তবুও মিলু কাউকে বুঝতে দিতে চায় না। পায়ে পায়ে ছাদেই চলে এলো। ছাদে এই অন্ধকারে এলেও কিছুতেই পিছন ঘুরে তাকায় না। দাদি ওকে ছোটবেলায় বলেছিল, ভয় পেলে পিছন ঘুরে না তাকাতে। ছাদের ধারটায় চলে এলো মিলু। বুক সমান উঁচু রেলিঙটায় ভর দিয়ে নিচের দিকে তাকাল।

হাসপাতালের মাঠে একটা অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে আছে। মৃত নবজাতকের পাশে গোঙানো সেই মহিলাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন একজন মাঝবয়সী লোক। নিশ্চয় লোকটি উনার স্বামী হবেন। এতক্ষণ হয়তো তার জন্যেই অপেক্ষা করছিল সবাই। নবজাতকের লাশ তোলা হচ্ছে গাড়িতে, হঠাৎ বাতাসে সরে গেল নবজাতকের গায়ের চাদর। ভেসে উঠল ছেলে মাহিনের মুখ। গাড়িটি প্রচণ্ড আওয়াজ করে মাথার ওপর জ্বালিয়ে দিল তীব্র লাল আলো। মিলু চিৎকার করে ওঠে- মাহিন! ওরা মাহিনকে কোথায় নিয়ে যায়? বলেই ঝাঁপ দেয় গাড়িটি ধরতে।

 
Electronic Paper