মাহবুব আলীর গল্প
জীবনদর্শনের নান্দনিক শব্দছবি
আহমেদ তানভীর
🕐 ২:১৬ অপরাহ্ণ, মে ০৭, ২০২১
‘মরণের আগে মুখে জল দিতে কেউ আসে না। সবাই কফিনের ওপর ফুল ছড়াতে ভালোবাসে।’ কথাশিল্পী মাহবুব আলীর গল্পের লাইন। গল্পের নাম ‘ভায়োলিন কেন কাঁদে’। মাহবুব আলীর প্রকাশিত গল্পগ্রন্থের সংখ্যা তিন জোড়া। জীবনঘনিষ্ঠ নানা ঘটনা, ঘাত-প্রতিঘাত, নিরেট বাস্তবতার চিত্র, গভীর সময়দর্শন, স্বদেশচেতনা এবং অবলা আড়ালকথন প্রভৃতি তার গল্পের প্রধান উপজীব্য।
দশটি গল্প নিয়ে সাজানো বই ‘অস্তিত্বের পলায়ন’। গল্পকথার ভাঁজে ভাঁজে দারুণ সব উপমা আর প্রতীকী বর্ণনার দেখা মেলে। ‘আধবুড়ি কিশোরী’, ‘ডিম-কুসুম সূর্য’ ইত্যাদি শব্দবুনন পাঠকচিত্তকে নাড়া দেয়, আমোদিত করে। মাহবুব আলীর গল্পে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে চমৎকার চিত্রকল্প, জীবন-বাস্তবতা আর একান্ত দর্শন। যেমন : ‘হলুদ এক প্রজাপতি বদ্ধ অন্ধকার থেকে বেরোবার পথ খুঁজে চলে।’ [নিষিদ্ধ গন্দমের জন্ম]। ‘ভালোবাসায় কোনো সন্দেহ চলে না।’ [ভালোবাসা ও একটি গোবরেপোকা]।
‘আমরা তো সাপের প্যাটের মধ্যেই হজম হইতাছি’।
‘পৃথিবী ভারি অদ্ভুত জায়গা! মানুষ আর তার বেঁচে থাকার হাজার নিয়মকানুন বড় আজিব। একজন আর একজনকে সাপের মতো প্যাঁচ দিয়ে চেপে ধরে থাকে। অজগর। একটু একটু করে কষ্ট দিয়ে গিলে খায়।’
‘সময় হলো নদীর জল... একবার শুধু স্পর্শ করা যায়।’
‘দিনে দিনে কত যে সহনীয় হতে হয়। কত সমঝোতা বেঁচে থাকার জন্য।’ [করোটির নীলপদ্ম]।
‘: জগৎ এমনই, সুযোগবাজরা সবসময় সুবিধে নেবে। মার খাওয়া মানুষ অন্য গাল এগিয়ে দেবে, এটাই নিয়ম।
: একদিন বিদ্রোহ হবে। ইতিহাসের শিক্ষা। তখন আমরা থাকব না।
: তারপর আবার নব্য সুযোগবাজ। এই তো ইতিহাস...।’ [যতিহীন পিছুফেরা]।
মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধপরবর্তী বাংলাদেশের ছেঁড়া ছেঁড়া শব্দছবিও প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠেছে মাহবুব আলীর লেখায় : ‘আমি কলেজে পড়তাম। এখন মানুষের জুতো রং করি। যুদ্ধে কতকিছু বদলে গেল।’ [যতিহীন পিছুফেরা]।
‘ভয়’ শীর্ষক বইতে রয়েছে আটটি গল্প। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘স্বপ্নের আত্মহনন’ গল্পের চিত্রকল্প বেশ আকর্ষণীয়, আঞ্চলিক ভাষার সুনিপুণ ব্যবহার আর নাটকের দৃশ্যের মতো বিভাজন নতুন আবহ দিয়েছে গল্পটিকে। এ বইয়ের নামগল্পে বর্তমান সমাজের এক নন্দিত অন্ধকারের বয়ান প্রতিভাত হয়েছে এভাবে : ‘সে পারতপক্ষে কাজে কোনো ফাঁকি দেয়নি। সে ওটা করতে পারে না। সবাই ফাঁকি দেওয়ার লোক নয়। যেমন কেউ কেউ নকল করতে পারে না। শিক্ষাজীবনে কতজনকে তো দেখল, নকল চালিয়ে রেজাল্ট ভালো করে ফেলেছে। আজ তারা কত বড় বড় পদে চাকরি করে। সে মাথা ঘুরে দেখতে পারেনি পরীক্ষার খাতায় কে কী লিখল। তাদের টাকা আছে। উচ্চশিক্ষা বা ভালো চাকরি পেতে কষ্ট হয়নি। তার টাকা নেই। পড়ালেখা আর হলো না।’
‘তুমি কেন মুক্তিযোদ্ধা হতে পারোনি’ একটি দহনের গল্প, না-পাওয়া আর চাপা ক্রোধের গল্প। এর পাঠ বেশ ভালো লাগায় আবেশিত করে পাঠকমনকে।
‘গোপনীয়তার অলিগলি’ বইয়ের গল্পের সংখ্যা চারটি। এ গ্রন্থের সবচেয়ে স্পর্শ করে যে গল্পটি তার শিরোনাম ‘কাপুরুষের অহংকার’। চিত্রকল্প ঝরঝরে সুন্দর, জীবনের টানাপোড়েনের গল্প পড়তে পড়তে মনে হয়, অভাব এক অদৃশ্য হাঙর। শোষণ, নিপীড়ন, ক্ষমতার গল্প এই ‘কাপুরুষের অহংকার’। অসহ্য এক সত্য বিবৃত হয়েছে এ গল্পে : ‘দুনিয়া এখন শয়তানের। যে যত বদমাশ সে তত সুখে থাকে।’
‘টাকা হলো নগদ নারায়ণ! কবরের মুর্দাও টাকার গন্ধ পেলে হাত বাড়িয়ে দেয়।’
বইয়ের নামকরণের মতো লেখক মাহবুব আলীর গল্পের নামকরণও খুব সুন্দর। ‘চাঁদের দেয়ালে ক্যাকটাস’ তেমনই একটি সুন্দর নামের গল্প। মানুষের জীবন নিংড়ে তুলে আনা গ্যালন গ্যালন অন্ধকারের দেখা পাওয়া যায় এ গল্পে।
মাহবুব আলীর কথাশিল্পের নানাবিধ বৈশিষ্ট্যের মধ্যে ‘শব্দপ্রয়োগে দ্বিধাহীনতা’ অন্যতম। আবার না বলা কথাকেও প্রশ্নাকারে তুলে ধরতে লেখক বেশ সাহসী। যেমন : ‘যারা মেধাবী, তারা এট্টু-আধটু ওরকমই হয়। এতে দুষের কিছু না। দেখছেন না বড় বড় রাইটার-শিল্পী সব কেমন মাদারচোদ্-লুচ্চা।’
‘ইলিশ বিদেশে রপ্তানি করা হয়। কেন? সাগরে জলদস্যু আর চোরাকারবারিদের গুলি করা যায় না? ভারত তো সীমান্তে মানুষ মেরে শেষ করে দেয়।’ [স্খলনের মানচিত্র]।
আলোচ্য বইয়ের নামগল্পে মেলে জীবনের এমন সহজ দর্শন : ‘জীবন হলো হিসাবের খাতা। গানের খাতা নয়। জীবন হলো জুয়া। সতর্ক থাকতে হয় প্রতিটি মুহূর্ত।’
‘পিঙ্গল বিকেলের আয়নায়’ মাহবুব আলীর আরেকটি গল্পবই। এতে গল্প রয়েছে আটটি। এ গ্রন্থেও লেখক স্বভাবজাত ভঙ্গিমায় দেখিয়েছেন জীবনচিত্র, বাস্তবতার জলছবি। ‘পৃথিবীতে মানুষ বহু নটির সতীপনা দেখে। সেই দেখা না দেখায় কারও কোনো যায় আসে না।’ [তিক্ততার শেষ কিস্তি]।
‘এই দেশে গাধাকেও ঘোড়া বলে চালান যায়। কথার জাদুতে গম চোর আর ডাকাতরা কত কী হবার পারে।’ [অন্ধকারের বাজার]।
‘চোরের সমাজে সত্যবাদী হয়ে যত বিপত্তি।’ [সুখের আন্ধারশূলা]।
‘কুকুর হইতে সাবধান’ এ বইয়ের একটি সিম্বলিক গল্প, যেখানে কুকুরের মনিবের কুকুরপনা দেখানো হয়েছে দারুণভাবে। কলুষিত সমাজের মুখে দুর্দান্ত চপেটাঘাত গল্পটি।
‘অযোগ্যতার সংজ্ঞা’ গ্রন্থে মলাটবদ্ধ হয়েছে দশটি গল্প। এ বইতেও বরাবরের মতোই জীবনছবি আঁকার ক্ষেত্রে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন লেখক।
‘বেচারা সক্রেটিস... মহাকালের বুদ্ধু। মানুষের প্রতি অগাধ বিশ্বাস। আবেগ ভালোবাসা। বাস্তব সত্য এই যে, বেশিরভাগ মানুষ ইতর প্রকৃতির।’ [অযোগ্যতার সংজ্ঞা]।
‘বোকা মানুষ দাগা খেয়ে একে-ওকে বলে বেড়ায়, চালাকেরা বনজঙ্গলে গিয়ে কাঁদে।’ [র্যাঁদা]।
গল্পে গল্পে যে শব্দছবি এঁকেছেন মাহবুব আলী তার পাঠ-পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় যদিও ইতিবাচক বিষয়ের আধিক্য রয়েছে, তবু কতিপয় অপ্রিয় সত্যকে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। পড়তে পড়তে টুকিটাকি বানানপ্রমাদ চোখে পড়েছে, তবে তা পরিমাণে এতই কম, খুব একটা গ্রাহ্য না করলেও ক্ষতি নেই। অধিকাংশ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রের নাম ‘শিহাব’। কিন্তু শেষাবধি ‘শিহাব’ নামটি কোনো ‘আইকনিক’ চরিত্র হয়ে উঠতে পারেনি, অবশ্য শিহাবের ঘাড়ে বন্দুক রেখে লেখক তার গল্প বয়ান করে গেছেন সাফল্যের সঙ্গে। লেখকের একই গল্পের ‘রিপিটেশন’ খুব দৃষ্টিকটু লেগেছে। ‘ধার করা স্বপ্ন’ গল্পটিকে হুবহু দেখা গেছে ‘অস্তিত্বের পলায়ন’ ও ‘ভয়’ গ্রন্থে। একইভাবে ‘চাঁদের দেয়ালে ক্যাকটাস’ গল্পটি মলাটবন্দি হয়েছে ‘গোপনীয়তার অলিগলি’ ও ‘রাত পাহারা চোখ’ বইয়ে। এমনটি না করলেও হতো। বইয়ের অধিকাংশ প্রচ্ছদই লেখকের নিজস্ব কাজ অথবা আন্তর্জাতিক ছবি থেকে প্রস্তুতকৃত কিংবা গল্পের অলংকরণের অংশবিশেষ। পেশাদার কোনো শিল্পীর প্রচ্ছদে বইগুলোর পরিচ্ছদ আরও সুন্দর ও নান্দনিক হতে পারত। সর্বোপরি, মাহবুব আলীর গল্পের জমিন বেশ পোক্ত এবং সিংহভাগ গল্পই সুখপাঠ্য ও জীবনঘনিষ্ঠ, এ কথা অনস্বীকার্য। যেকোনো নিবিষ্ট পাঠকের ভিতরে তার গল্প স্থায়ী হবে দীর্ঘদিন, নির্দ্বিধায় বলা যায়।