ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ভাঙা সংসার

বিবিকা দেব
🕐 ২:৪৯ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ০৯, ২০২১

ভাঙা সংসার

চৈত্র মাসের গনগনে রোদ মাথায় নিয়ে কোদাল হাতে অমল দাদু। মলিন লুঙ্গিটা মালকোঁচা দিয়ে হাঁটুর ওপর তুলে কাজে লেগে গেলেন জমিতে। সবে ধানে ফুল আসতে শুরু করেছে। আগাছারা সঙ্গে মাথা উঁচু করে নির্বিঘ্নে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। আইলে দুর্বাঘাস ও হেলেঞ্চার উৎপাত বেড়েছে। কোদালের আঘাতে পরিষ্কার করে। দেখলেন এক জায়গায় পানি জমে আছে। সোজা মাটি কেটে পানিকে নিজের গতিপথ তৈরি করে দিলেন। মাথার গামছা খুলে একটু জিরিয়ে নেয়। স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের দিকে তাকালেন উদাস মনে। রোদটা এমনভাবে উঠেছে যেন ক্ষুধার্ত বাঘ শিকারির খোঁজ পেয়ে হামলে পড়ছে। বসে আছেন অনেকক্ষণ ধরে।

বিগত কয়েক বছর ধরে অনেক কিছু জীবন থেকে হারিয়ে ফেলেছেন। স্ত্রী, বড় ছেলে, জোড়া হালের গরু। যেন অতীতের সাক্ষী এক একটা ঘামের বিন্দু। কত কষ্ট করে রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে বড় ছেলেকে ডাক্তারি পাস করালেন। হোমিও চিকিৎসক হিসেবে পরিচিত। অমল দাদুর তিন ছেলে দুই মেয়ে। বড় হিমাংশু দেখতে খুব সুন্দর। কোঁকড়া মাথায় চুল। হাতে পায়ে লম্বা গড়নের শরীর। টকটকে ফর্সা ত্বক। হাসিটাও বেশ দেখার মতো।

একদিন বিকেল বেলা হিমাংশু বোনের বাড়ি যাচ্ছে। হাতে বিস্কুটের প্যাকেট। গাড়ির ছিল ব্যবস্থা কম। গ্রামের মেঠোপথ দিয়ে কয়েকটা জিপগাড়ি আর কয়েকটা রিকশা। সূর্যের আলো কমে এসেছে। কিন্তু যেটুকু আকাশে ফর্সা ভাব আছে, তাতেই হাঁটা পথে বোনের বাড়ি পৌঁছাতে পারবে না। ওই দিকে দীপালির মনে উদ্বেগ। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে, বড় দাদা আসার কথা। এখনো কেন আসছে না? কেরোসিনের প্রদীপটা হাতে নিয়ে দরজায় নির্বাক হয়ে বসে আছে। কোনো কাজে মন বসে না। ছোট দুটি ছেলে-মেয়ে। তারাও মামার অপেক্ষায় বসে আছে। এদিকে হিমাংশু বড় রাস্তা ছেড়ে খেতের আইল দিয়ে হাঁটা শুরু করে। হাঁটছে আর ভাবছে এই পথে এগোলে হয়তো তাড়াতাড়ি যেতে পারবে। হাতে হাতঘড়ি ছিল না। আকাশে সন্ধ্যাটা মিশে গিয়ে এক ফালি চাঁদ জেগে আছে। আশপাশে কোনো প্রাণীর অস্তিত্ব পাচ্ছে না। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। গায়ে শিহরণ দিচ্ছে। তবু সাহসের সঙ্গে পথ চলে হিমাংশু। কিছু দূরে কয়েকটা আলো দেখা যাচ্ছে। পাশে ধানখেত। এখনো ধানে ফুল আসেনি। সবে যৌবন এসেছে, শুধু দোল দেয়।

দীপালির শ্বশুরবাড়ির আগে একটা চা বাগান আছে। এত হাটছে তবু বাগানের দেখা পাচ্ছে না। তার মানে অনেকটা পথ বাকি। অবশেষে প্রদীপগুলো আর দেখা যাচ্ছে না। হিমাংশু স্থির করে আশপাশে কোনো বাড়িতে রাত পার করে দেবে। কাল সকালে না হয় বোনের বাড়িতে যাবে। সামনে এগোতেই দেখতে পেল একটা ছনের ছাউনি ঘর। চারপাশে বাঁশের খুঁটি আর বেড়া দিয়ে তৈরি। ভিতরে গিয়ে দেখল কয়েকটা সেচ পাম্পের মেশিন। নদী থেকে মেশিনের মাধ্যমে পানি তুলে জমিতে দেয়।
কাঠের একটা লম্বা বেঞ্চে বসে পড়ে। অনেকটা পথ হাঁটার ফলে পা দুটো অবশ হয়ে যাচ্ছে। একটু নড়াচড়া করতে যেন আপত্তি। গায়ে ঘাম হচ্ছে প্রচুর। ভ্যাপসা গরম তাই গা থেকে শার্ট খুলে রাখে। জোছনার আলো বেড়ার ফাঁকগলে উঁকি দিচ্ছে ঘরের ভিতর। তাতেই অনেকটা আলো পাওয়া গেল। পেটের ভিতর প্রচণ্ড ক্ষুধায় মাথা ঘুরছে। খাবার বলতে হাতের বিস্কুটের প্যাকেট। তাড়াতাড়ি প্যাকেটের কয়েকটা বিস্কুট খেতেই পানির পিপাসা পেল। পানি খেতে হলে পাশেই নদী। জোছনার আলোয় ছোট নদীর ঢেউ যেন হাতছানি দেয়। নেমে পানি পান করে দুহাতের আঁজলা ভরে। পাড় বেয়ে ওঠে চারপাশটা দেখে জনমানবশূন্য। শুধু জেগে আছে চাঁদ, তারা, ধানখেত, নদী ও অসংখ্য জোনাকি। ক্লান্ত অবসাদ দেহ নিয়ে বেঞ্চের ওপর শুয়ে পড়ে হিমাংশু।

রাত যত গভীর হচ্ছে, তত রাতটাকে মোহনীয় লাগছে। গভীর ঘুমের অতলে হারিয়ে যাচ্ছে। তখনি একজন হিমাংশুর গলা চেপে ধরছে। নিঃশ্বাস নিতে খুবই কষ্ট হচ্ছে। দু’হাত দিয়ে প্রাণপণে হাত ছাড়াবার চেষ্টা করছে। হাতও চেপে ধরেছে ডাকাতের দল। হিমাংশুর একপর্যায়ে ধস্তাধস্তি শুরু হয়। একজন নয়, অনেকজন এসেছে। শার্টের পকেটে যে অল্প পরিমাণ টাকা ছিল সব খোয়া গেছে। যাওয়ার সময় তারা বলে, তোমার ওপর যে আক্রমণ হয়েছে, তা কাউকে বলবে না। বন্দুকের বাঁট দিয়ে বুকের ওপর চাপ দিতেই হিমাংশু ব্যথায় কুঁকড়ে ওঠে। ভয়-উদ্বিগ্নের মাঝে সকালটা উঁকি দিচ্ছে। ঝকঝকে সকালবেলা সারা শরীরে ব্যথা নিয়ে নিজেদের বাড়িতে ফিরে আসে। হাতে বুকে পিঠে কালচে দাগ। বোনের বাড়িতে আর যাওয়া হলো না।

মা-বাবার চিন্তার শেষ নেই। ওই দিনের পর থেকে হিমাংশুর ঘনঘন জ্বর। শরীর ও মাথাব্যথা। ওষুধ খেলে একটু ভালো লাগে। কিছুদিন পর আবার সেই জ্বর দেখা দেয়। এভাবে অনেক দিন ভোগার পর এক বিকেলে হিমাংশু আর দু’চোখ খোলেনি। চিরদিনের জন্য সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেছে। সেই পুত্রশোক সইতে না পেরে হিমাংশুর মা এক বছরের মধ্যে মারা গেলেন।

অপ্রত্যাশিত কয়েকটা মৃত্যু গোটা পরিবারকে নিস্তব্ধ করে দিয়েছে। গ্রামবাসীও শোকে বিহ্বল। সংসারের হাল ধরার জন্য কয়েক বছর বাদে মেজ ছেলে প্রেমাংশুর বিয়ে দেয়। কোনো রকম স্বস্তি ফিরে আসে। কিন্তু কোথাও অভাব বোধ কিংবা শূন্যতা রয়েছে। দীর্ঘশ্বাস বয়ে যায়। ছোট ছেলে হিমেল সবে এসএসসি পাস করেছে। সামনে পরে আছে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। অমল দাদু বুকের কষ্ট চাপা দিয়ে নতুনভাবে বাঁচার উৎস খুঁজেছেন। হাসি-খুশিতে চলছে জীবনের ভাঙা দিনগুলো। বছর শেষ না হতেই নাতির মুখ দেখলেন। নাতির নাম রাখে সাজন। সেই গায়ের রঙ, গড়ন মুখের আদল সব কিছুই যেন দ্বিতীয় হিমাংশু। একটু একটু শোক হারিয়ে যাচ্ছে।

সাজনের আধো আধো বুলিতে জীবন আবারও মুখরিত। সাজনের বয়স যখন সাড়ে চার বছর। অমল দাদু জমিতে আগাছা পরিষ্কার করতে গিয়ে, মাথা ঘুরে আইলের ওপর পড়ে। একরাত দুই দিন চোখ খোলেনি। পরের দিন সকালবেলায় চোখ বন্ধ অবস্থায় মারা গেলেন।

যথানিয়মে সৎকার। পরে যাবতীয় ক্রিয়াদি সম্পন্ন করে। ছোট ভাই হিমেল, এক ছেলে, স্ত্রীকে নিয়ে প্রেমাংশুর সংসার কোনোভাবে নিয়মের গতিতে চলছে। হিমেল বিএ পাস করে। চাকরির জন্য চারদিকে দরখাস্ত করে। পাশাপাশি হোমিও বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করে। সাজনের আরও দুটো বোনের জন্ম হলো। প্রেমাংশুর জীবিকা হিসেবে ছোট চায়ের দোকান আর কয়েক বিঘা আবাদি জমি চাষ করে। সাজন যখন দশম শ্রেণির ছাত্র, তখন আরেকটা নতুন বিপদ ওত পেতে ছিল। মাছ দিয়ে ভাত খাওয়াতে গলায় কাঁটা আটকে। কয়েক মাস পর গলার খাদ্যনালিতে মরণব্যাধি ক্যান্সার ধরা পড়ে। হৃষ্টপুষ্ট দেহ দিনদিন ক্ষয় হতে থাকে। বারবার থেরাপির কারণে শরীরে একটা পশম স্থায়ী হতে পারে না। দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া উজ্জল ছাত্র। পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করে। নম্র-ভদ্র, শান্ত-শিষ্ট ছেলে সাজন। চোখের কোটর খালি। বসা গাল অসুস্থ লিকলিকে শরীর নিয়ে বছরখানেক বেঁচে ছিল।

শ্রাবণের বৃষ্টিতে ভিজে সাজন সবাইকে ছেড়ে অদূরে পাড়ি দেয়। নিস্তব্ধ সকাল যেন কান্নায় ঝরে পড়ে। মা-বাবার আদুরে সন্তান। এভাবে অকালে চলে যাবে কেউ ভাবেনি। হয়তো সেদিন গাছের পাতারাও কেঁদেছিল নীরবে। পরিবারে একটা মৃত্যু সবাইকে হতবাক করেছে। মৃত্যুদেবতা যেন ঘরের কোণে বসে, একটা একটা করে প্রাণ নিয়ে যাচ্ছে।

ঘন বর্ষার পরে হালদার চরে কাশফুলের আগমন। সবুজে সবুজে বিমোহিত চোখ। তবে থিতু হয়েছে প্রেমাংশুর ভাঙা গড়ার সংসার। ছোট ভাইটা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হিসেবে নিজ গ্রামে শিক্ষকতা শুরু করে। দুঃখগুলো পালিয়ে যাচ্ছে ব্যস্ততার মাঝে। সব কষ্টকে একসঙ্গে বিসর্জন দেয়। প্রেমাংশুর দুই মেয়ে- ঊর্মিলা ও শর্মিলা। সাজনের শূন্য হৃদয়ে দুইটি সবুজ চারা। মায়ার শাখা প্রশাখায় ঘরের শ্রী বৃদ্ধি করেছে। মেধাবী ছাত্রী হিসেবে স্কুলের খাতায় সুনাম আছে। ছোট ভাই হিমেলের ঘটা করে বিয়ে দিলেন। নতুন বউ ঘরে আসাতে আত্মীয় পরিজন মিলেমিশে একাকার। সুখে-দুঃখে কোনোরকম দুই বছর অতিবাহিত।

হঠাৎ প্রেমাংশু চির বিদায় নিল হার্ট অ্যাটাক করে। প্রতি নিঃশ্বাসে যেন মৃত্যু প্রবাহিত হতে থাকে। এত কষ্ট কোথায় রাখবে। প্রেমাংশুর বউ যেন উন্মাদিনী। স্বামী-সন্তান হারিয়ে শুকিয়ে যাওয়া মরা নদী। হে ঈশ্বর আমার মরণ দিলে না কেন! এই তার উক্তি। প্রেমাংশুর মৃত্যুর পূর্বে বউ তার দুই মাসের পোয়াতি ছিল। আবারো মরু উদ্যানে সবুজ চারা মাথা তুলে পৃথিবীর আলো বাতাস চায়। ছেলেসন্তানের জন্ম হলো। স্বামী ও সন্তান হারিয়ে পাগল প্রায়। সেই ছেলেটা পেয়ে একটু স্থির। বেঁচে থাকার অবলম্বন। ছোট ছেলের দিকে তাকিয়ে কষ্টগুলো বিলীন হতে থাকে। অনেক বছর কেটে গেল। বড় মেয়ে ঊর্মিলার বিয়ে দিলেন। ছোট মেয়ে শর্মিলা নার্সিং পেশায় নিয়োজিত আছে। ছেলেটা ক্লাস টুতে পড়ে। স্বামী ও বড় ছেলে সাজনের মুখগুলো অবসরে খুঁজে। একেকটা মৃত্যুর কথা মনে পড়লে ভয়ে শিউরে ওঠে। হে ঈশ্বর আমাকে শক্তি ও সাহস দাও। এরকম দিন যেন দ্বিতীয়বার না আসে। এ লড়াইয়ে ছোট ছেলেটা আশার আলো।

 
Electronic Paper