ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

জীবন ও জগতের মহাকাব্যিক রূপ

হারুন পাশা
🕐 ২:৪২ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ০৯, ২০২১

জীবন ও জগতের মহাকাব্যিক রূপ

নিজের লেখা নিয়ে বলা বা লেখা দারুণ বিব্রতকর কিংবা জটিলতার। আমি যখন উপন্যাস লিখি তখন লেখক হিসেবে লিখি। লেখা শেষে যখন পড়ি তখন পাঠক হিসেবে পড়ি। নিজেই নিজের আলোচনা-সমালোচনা করি। কিন্তু নিজের উপন্যাস নিয়ে যখন ফরমালি বলতে হবে সেটা একটু জটিলতার উপাখ্যান হয়ে যায়। যাই হোক, সম্পাদকের ইচ্ছাকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে একটু বিব্রত কিংবা জটিলতর বোধ করি।

আমি চেষ্টা করি নতুন প্রকরণে গল্প-উপন্যাস লেখার। যে প্রকরণে লেখক অনুপস্থিত থাকে। রোলাবার্থের উক্তির মতো- The Death of the Author. আমার উপন্যাসে চরিত্ররাই কথক, ঘটনা বা পরিস্থিতির ব্যাখ্যাকারক এবং উপন্যাসের পরিণতিও তাদের কথনেই। আবার এক চরিত্র শোনায় গল্প আরেক চরিত্রকে। উপন্যাসের ভেতরে থাকে ‘সংযুক্তি’, যা কাহিনির ধারাবাহিকতা রক্ষা করে সেতু হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে।

লিখেছি ‘তিস্তা’ এবং ‘চাকরিনামা’ উপন্যাস। এ বছর বেরিয়েছে ‘বদলে যাওয়া ভূমি’ নামে আরেকটি উপন্যাস। আমার সবগুলো উপন্যাসের প্রকাশক ‘অনিন্দ্য প্রকাশ’। আমার কথাসাহিত্যে থাকে সংকটের আখ্যান। ‘বদলে যাওয়া ভূমি’ও ব্যতিক্রম নয়। এ উপন্যাসে আছে করোনার কারণে দেশ এবং বহির্বিশ্বের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক সংকটের চিত্র। সামষ্টিক চেতনাকে ধারণ করে আছে এটি।

করোনা নিয়ে হয়ত অনেক উপন্যাস লেখা হবে কিন্তু দেশ এবং বহির্বিশ্বের সামগ্রিক চিত্র নিয়ে লেখা ‘বদলে যাওয়া ভূমি’ বিষয়বস্তু ও উপস্থাপনের কারণে স্বতন্ত্র হয়ে থাকবে। এ উপন্যাসে কী নেই? মানুষ, সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, প্রকৃতি, আন্দোলন, প্রতিবাদ সবই উপস্থিত। উপস্থিত আধুনিক বা পুঁজিবাদী সমাজ। মানুষের সম্পর্কহীনতা, অবিশ্বাস, স্বার্থবাদিতার উলঙ্গ প্রকাশ আছে। যা আমরা করোনাকালে দেখতে পেয়েছি।

মানুষ কথা বলতে পারছে না। সত্য বলতে পারছে না। বাক-স্বাধীনতা না থাকায় বড়ো এক সংকট সৃষ্টি হয়েছে জীবনে। এ উপন্যাসে খনার সময়কাল থেকে আরম্ভ করে ব্রিটিশ পিরিয়ড, পাকিস্তান পিরিয়ড এবং স্বাধীন বাংলাদেশে মানুষের বাক-স্বাধীনতা না থাকার দীর্ঘ ইতিহাস ও সত্যের সন্ধান করেছি। বাক-স্বাধীনতা ভারত কিংবা পুরো দুনিয়ায় কেমন সে কথাও এনেছি।

আরও ধরে ধরে বললে হাসপাতাল ও রোগীর দুরবস্থা, নিম্নবর্গ এবং মধ্যবিত্ত মানুষের দুর্বিষহ জীবন; গার্মেন্টস বা বড় ব্যবসায়ীর দৌরাত্ম্য; স্বাস্থ্যখাতের ভঙ্গুরতা; ত্রাণচুরি এবং ত্রাণ পেতে মানুষের আন্দোলন; মানুষের চাকরিগত বা অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, শঙ্কা, হতাশা; করোনার কিট আবিষ্কারে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর চেষ্টা, লকডাউন শেষে কোটির উপরে মানুষের শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যাওয়া; করোনায় চাকরি হারানোদের আর্তনাদ উপন্যাসে উপজীব্য।

কেবল দেশের পরিস্থিতিতেই উপন্যাসের পটভূমি সীমাবদ্ধ নয়। করোনার চাপে বেসামাল হওয়া পুরো দুনিয়ার অনুন্নত-উন্নত রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পটভূমিও বিস্তৃত হয়েছে উপন্যাসে। বিশ্ব নেতৃত্ব আমেরিকা থেকে চীনের হাতে চলে যাওয়া। কীভাবে যাচ্ছে চলে ক্ষমতা অন্য রাষ্ট্রের হাতে তারও বিস্তর আলোচনা করেছে চরিত্র। দুনিয়া লকডাউনে থাকায় বিশ্ব প্রকৃতির সজীব আর সতেজতার হিসাবও বাদ যায়নি।

বিশ্বরাজনীতি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে শুরু করে ২০২০ সালের ভেতর ঘটে যাওয়া রাজনীতির আদ্যোপান্ত এসেছে। করোনার আগে হওয়া মহামারী, বিশ্বমন্দা, অর্থনৈতিক পঙ্গুত্ব সবই আছে।

করোনাকালে মানুষের কল্যাণে পুলিশ, ডাক্তার-নার্স, সাংবাদিক, ব্যাংকারের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যাওয়া। সহযোগিতা কিংবা অনাত্মীয়ের আত্মীয় হওয়া এবং আত্মীয়ের দূরে সরে যাওয়ার নির্মম বাস্তবতাও লক্ষণীয় এ উপন্যাসে। উপন্যাসে দিয়েছি বেশ কিছু পর্ব বিভাজন। উপন্যাসে যেহেতু লেখকের উপস্থিতি নেই সেহেতু এসেছে ‘সংযুক্তি’ অংশ। দুই পর্ব কিংবা উপন্যাসের কাহিনির সেতু হলো এই ‘সংযুক্তি’।

একসময় মানবভূমি করোনামুক্ত হয়। যে ভূমিতে দাঁড়িয়ে চাকরি হারানোরা, চিকিৎসায় অবহেলার কারণে আত্মীয়-স্বজন মারা যাওয়ারা, আইসিটি আইনে গ্রেপ্তার হওয়ারা মুক্তির দাবিতে আন্দোলন করছে। এ উপন্যাস একজন পাঠক ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করতে পারবে, রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করতে পারবে, সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করতে পারবে, অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করতে পারবে, নিম্নবর্গ তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারবে, অস্তিত্ববাদী দর্শন দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারবে, উত্তরাধুনিক তত্ত্ব বা উত্তর-ঔপনিবেশিক তত্ত্ব দিয়েও ব্যাখ্যা করতে পারবে।

মধ্যবিত্তের হাপিত্যেশ, বেসরকারি চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের অবস্থা-পরিণতি জানার ভালো উপায় এ উপন্যাস। আরও অনেক ব্যাপার-স্যাপার আছে যা বলা হলো না। পাঠক পড়ুন সেসব।

‘বদলে যাওয়া ভূমি’ কেবল উপন্যাস নয়- জীবন ও জগতের মহাকাব্যিক রূপ।

বদলে যাওয়া ভূমি। প্রকাশক : অনিন্দ্য প্রকাশ। প্রচ্ছদ : ধ্রুব এষ। মূল্য : ৫০০ টাকা

 
Electronic Paper