পরম্পরা
আফরোজা পারভীন
🕐 ১২:০৪ অপরাহ্ণ, মার্চ ১২, ২০২১
শেষ বিকেল। ছুটির দিন। বিকেলের আয়েসী চা শেষ করে মা মীরার দিকে তাকিয়ে রাতুল বলল, দরজা বন্ধ করে দাও। বাইরে যাব।
: কোথায় যাচ্ছিস?
: নিউমার্কেটে।
: শোন, কসকো সাবান পাস কিনা দেখিস আর পমেড ক্রিম।
রাতুল থমকে দাঁড়াল।
: আচ্ছা মা, এত ভালো ভালো বিদেশি সাবান আছে, বডি ওয়াশ আছে। সেসব তুমি ব্যবহার করতে চাও না। কেবল তোমার পছন্দ কসকো সাবান যা সহজে পাওয়া যায় না। আমার মন খারাপ হয়। কেন বলো তো মা, অন্য সাবান তোমার পছন্দ না? আর পমেড! কত ভালো ভালো ক্রিম তোমাকে এনে দিই কিন্তু তুমি চাও ওই পমেড। কেন মা?
মীরা খানিকটা বিব্রত হন। তারপর বলেন, ব্যবহার করি না কে বলল! না পেলে তো ব্যবহার করিই। কসকো আর পমেড পছন্দ করার কারণ আছে। ধরে নে কসকোর ওই চকলেট চকলেট রঙটা আমার খুব প্রিয় আর পমেডের কমলা রঙটা তাই।
রাতুল আর গভীরে যায় না। হেসে ফেলে। মাকে জড়িয়ে ধরে। মার লম্বা চুলগুলোর মধ্যে আঙুল চালাতে গিয়ে আঙুল আটকে যায়। কপট রাগে বলে, মা তুমি চুল আঁচড়াও না কতদিন? বাবুনি বুঝি তোমার জট ছাড়িয়ে দেয় না। এই বাবুনি...।
: আহ, চেঁচাস না, ও ঠিকই জট ছাড়ায়, চুল আঁচড়ায়। অনেক চুল আর লম্বা তাই অল্পতেই জট পড়ে যায়। এবার তুই রওনা হয়ে যা।
রাতুল বের হয়। গাড়িতে বসে মনে মনে হাসে। কী ছেলেমানুষ তার মা আর কী মজার! কসকোর চকলেট রঙ-এর জন্য তার পছন্দ আর পমেডের কমলা রঙয়ের জন্য। বাচ্চা বাচ্চা, মা-টা তার একদম বাচ্চা! এবার থেকে গাদা গাদা চকলেট আর কমলা রঙয়ের জিনিস কিনে দেবে মাকে!
দুই
মীরা বিছানায় বসে টেবিলের ওপর থেকে পমেডের কৌটাটা টেনে নেয়। শীত শীত পড়েছে। চামড়ায় টান পড়ছে। সারাটা শীত সে হাতে আর ঠোঁটে পমেড মাখে। এ কৌটার ক্রিম তলানিতে এসে ঠেকেছে তাই রাতুলকে আনতে বলা। মীরার মা মিনারা ছিলেন খুবই সৌখিন। খুব পরিপাটি থাকতেন। সংসারের হাজার কাজের মাঝে কখনো তার শাড়ি মলিন হতো না। এক কোমর গোছা চুল এলোমেলো হতো না। সকালে উঠে ব্রাশ করার পরই নিজ হাতে ওই একডালা চুল আঁচড়াতেন, মুখে মাখতেন তিব্বত ক্রিম। যে ক্রিমের কৌটায় একজন নারীর ছবি থাকত। শীতে নিয়মিত ক্রিম ব্যবহার করতেন। এর কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। মারা যাওয়ার সময়ও মায়ের কোমর অবধি গোছা গোছা চুল ছিল, ত্বক ছিল নিভাঁজ। মা প্রায়ই মীরাকে স্নো মাখিয়ে চুখ আঁচড়ে দিতেন। আসতে না চাইলে জোর করে ধরে আনতেন। শীতের দিনে তার ফাটল ধরা ঠোঁটে যত্নে মাখিয়ে দিতেন ক্রিম।
পমেড মেখে চিরুনি হাতে নেয় মীরা। কিন্তু আঁচড়াতে ইচ্ছে করে না। নিজের ব্যাপারে বড়ই অলস সে, আর বড় অগোছালো। এক কাপড় হয়তো পাঁচদিন ধরে পরছে, এক শাড়ি পরে সকাল বিকাল বাইরে যাচ্ছে। এসব নিয়ে ওর বিকার নেই। বাড়ি ঘর-দোর অগোছালো। যেমনটা মা ভাবতেও পারত না।
ক্ষুধা লেগেছে। বিকালে সামান্য কিছু খাওয়া অভ্যাস। মীরা বাইরে গিয়ে বাবুনিকে বলে, আমার প্লেটটা দে। আর খাবার কিছু আছে?
: ভাবি নুডুলস বানিয়েছে।
: দে।
বাবুনি প্লেট এনে টেবিলে রাখে। প্লেটটা স্টিলের। আকারে বেশ ছোট। কিন্তু এটাতেই খায় মীরা। দীর্ঘদিনের পুরনো হওয়ায় স্টিল বিবর্ণ, ডিজাইনের ফাঁকে আঁকে বসে গেছে ময়লা। হাজার মাজা-ঘষা করলেও যা পরিষ্কার হয় না। এটা নিয়েও রাতুলের অসন্তোষ। বাসায় এত ভালো ভালো প্লেট আছে অথচ মা ওটাতেই খাবে। মাঝে মাঝে নামীদামি অতিথিরা আসেন। তখনো মা ওই প্লেটে খান। মাকে অনেকবার বলেছে প্লেট বদলাতে, মা শোনেনি। এটা নিয়ে রাতুলের খানিকটা রাগ, খানিকটা অভিমানও আছে। একদিন রাগ করে বলেছিল, এবার আমি স্টিলের থালাটা ফেলে দেব ঠিক।
: অমন কাজ ভুলেও করিস না বাবা। এটা আমার নির্দেশ।
মার কণ্ঠ চড়ে গিয়েছিল। বড় কঠোর আর কঠিন ছিল সে কণ্ঠ!
রাতুল তাই আর সে কাজ করেনি। কিন্তু মনে মনে ক্ষোভ রয়েই গেছে। রাতুল মাকে ভালো রাখতে চায়, সবচেয়ে ভালো। ভালো খাওয়াতে চায়, ভালো পরাতে চায়। সবচেয়ে ভালো জিনিসটা দিতে চায়। কিন্তু তা হওয়ার নয়। মায়ের পছন্দ ওই কসকো পমেড আর পুরনো প্লেট।
তিন
নিউমার্কেট থেকে ফিরেছে রাতুল। অনেক শপিং করেছে। প্রয়োজনীয় জিনিস ছাড়াও অপ্রয়োজনীয় অনেক কিছু কিনে এসেছে। এনেছে মায়ের জন্য শাল সোয়েটার মাফলার। শালের রঙ চকলেট, সোয়েটারের রঙ কমলা। মীরার এসবের কমতি নেই। এত আছে যে রাখার জায়গা নেই। তারপরও রাতুল আনবেই। প্রতি শীতে মীরা পুরনো কাপড় বিলায়। তারপরও আলমারিতে জায়গা হয় না। মীরা মহাবিরক্ত। রাতুলকে বলে, তোর আক্কেল কবে হবে বল তো! গরম কাপড়ের অভাব আছে আমার? আমি কি তোকে আনতে বলেছি? তাও আবার চকলেট আর কমলা। ওসব পরার বয়স আমার আছে!
: কেন ওই রঙ তো তোমার পছন্দ। তাছাড়া তুমি নিজ মুখে কিছু চাইবে, তেমন মা তো তুমি না! সারাটা জীবন কত কষ্ট করেছ, খেয়ে না খেয়ে কত কষ্টে আমাকে বড় করেছ। এবার একটু আরাম করো মা। একটু শান্তি করো। ভালো খাও। নিত্যনতুন জামাকাপড় পরো। আমাদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াও। নিজের দিকেও তো তাকানো দরকার মা। তুমি তো সারাটা জীবন এক কসকো আর পমেড ছাড়া কিছু চাওনি। এই নাও পমেড। কসকো পাইনি। অনেকগুলো ভালো সাবান এনেছি। ব্যবহার করবে। মীরা নেড়েচেড়ে দেখে। তারপর বলে, এ সাবানগুলো আপাতত তুই আর বউমা ব্যবহার কর। আমার হাতে এখনো একটা কসকো আছে। ফুরোলে যদি না পাওয়া যায় তখন চেয়ে নেব এ সাবান তোদের কাছ থেকে।
এবার রীতিমতো রেগে যায় রাতুল। খানিকটা উঁচু স্বরে বলে, এ কেমন কথা মা, কসকোই তোমাকে ব্যবহার করতে হবে! কী আছে কসকোয় যা অন্য সাবানে নেই?
মীরা সামান্যক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর অস্ফুটস্বরে বলে, এমন কিছু আছে যা সত্যিই অন্য সাবানে, অন্য ক্রিমে নেই। মায়ের স্মৃতি আছে। মায়ের হারিয়ে ফেলা স্পর্শ আছে!
: মানে?
: আমার মা কসকো আর পমেড ব্যবহার করতেন। ওই স্টিলের প্লেটটায় খেতেন। মা মারা যাওয়ার পর বাড়ি থেকে প্লেটটা নিয়ে এসেছি আমি।
চার
দশ বছর পরের কথা। সারা ঢাকা খুঁজে রাতুল অনেকগুলো কসকো আর পমেড কিনেছে। মীরার জন্য নয়। মীরা এখন ছবি হয়ে দেয়ালে ঝুলছে। রাতুল একটা ট্রেনিংয়ে বিদেশে যাচ্ছে এক বছরের জন্য। বউ সোহানাকে বলল, সুটকেসটা ভালো করে দেখে গোছাবে। যেন কিছু বাদ না পড়ে। আর সবার আগে দেবে মায়ের প্লেটটা। মনে করে দেবে কসকো আর পমেডগুলো। সোহানা হাসল। অনেক আগেই সে চমৎকারভাবে গুছিয়ে দিয়েছে জিনিসগুলো।