কবিতায় কথা বলার মানুষ সৈয়দ আহসান কবীর
এনাম রাজু
🕐 ১২:৩৩ অপরাহ্ণ, মার্চ ০৫, ২০২১
সময়টা ২০১৪ সালের প্রথমদিকে। মালিবাগ রেলগেটে প্রচুর আড্ডা হত। সাহিত্যের বিশুদ্ধ আড্ডা। কবিতা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ হত। সে সময়ে দু’একজনের আলোচনা মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। মুগ্ধতা এক সময় নেশা ধরিয়ে দিয়েছিল। আলোচনার গুরুত্ব ও গাম্ভীর্য এ নেশা তৈরি করেছিল। তাদের উপস্থিতি টের পেলেই ছুটে যেতাম। সেই বিশেষ দু’একজনের মধ্যে সৈয়দ আহসান কবীর ছিলেন। শুরুতে তার কবিতা ও গল্পবিষয়ক বিশ্লেষণ ভালো লাগলেও ধীরে ধীরে তার গল্প ও কবিতা আমাকে ভক্ত ও পাঠক হতে বাধ্য করে। কবিতা তো অনেকেই লেখেন বা লিখি, কিন্তু কবিতা ধারণ করেন কয়জন! কবিতার শরীর গড়তে নিত্য যে মানুষটি শব্দের আরাধনা করেন, ভাঙ্গা-গড়া করেন, তিনিই তো কবি।
‘সুখাদ্যে রুচি নেই/ আমি এখন আগুন খাবো/ নিশ্বাসে বেরুবে হাইড্রক্সিল শিখা/ বাতাশে ভাসবে বারুদের গন্ধ।/ আমি আগুন খেয়ে পাড়বো আগুনের ডিম/ যেন এক ফুৎকারে নিভিয়ে দিতে না পারে/ আমার যতো অতীত-বর্তমান।/ (কবিতা : আলোকিত ভবিষ্যৎ, গ্রন্থ : হৃদয়ের সিন্কহোল)।
পঙ্ক্তিগুচ্ছ কবিকে দিয়েছে অনন্য উচ্চতা। সমাজের যত কালো, মিথ্যের ভেলা, চামড়ার মুখোশ সবকিছুর বিরুদ্ধে তার কলমের জবান সর্বদা সচেষ্ট। সমসাময়িক অন্ধকারাচ্ছন্ন রক্ত-ঢেউয়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে করোনার পূর্ব পর্যন্ত যশোর থেকে প্রকাশিত দৈনিক ‘সমাজের কথা’য় প্রতিদিন লিখেছেন ‘ছন্দকথা’ শিরোনামে সমসাময়িক ছড়া-পদ্য। যার সংখ্যা হাজার পেরিয়েছে বহু আগেই। মুখোশহীন ভালোবাসার রঙ, সমাজের যাবতীয় আঁধার, প্রথাহীন-কাঁটাহীন জীবনব্যবস্থা তার ছড়ায় ছড়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানে প্রতি শনিবার সমৃদ্ধ সাহিত্য পাতাটিতেও রয়েছে তার অবদান।
সৈয়দ আহসান কবীর প্রথমত কবি। যদিও গল্প, অণুগল্প, প্রবন্ধ, আলোচনা-সমালোচনায় তার কলম ছোটে দুরন্তগতিতে। তবে কবি পরিচয়েই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তিনি বিশ্বাস করেন পৃথিবীটা কবিতাময়। কবিতার মতো সুন্দর পৃথিবীতে কিছু নেই। তাই হয়ত লিখেছেন, ‘মেয়ে, কবিতা পড়/ পড়তে পড়তে কবিতায় ভিজে উঠে পূর্ণ হও / অথবা বদলে নাও নিজেকে (কবিতা : মেয়ে, কবিতা পড়, গ্রন্থ : অথচ পাখিরা ডানা মেলে দেয়)।
কবিতায় নিজস্ব ঢঙ সৃষ্টিতেও মগ্ন কবি শব্দের, উপমার, মিথের নিরীক্ষা করেন প্রতিনিয়ত। চিত্রকল্পের ছড়াছড়ি না থাকলেও কমতি নেই তার কবিতায়। কাব্যিকতার দেয়ালে আঁকেন পিকাসোর রঙ, ভালোবাসার দেহাবয়ব, ঘুণেধরা সমাজে ছুঁড়ে দেন অসংখ্য লুকায়িত প্রশ্ন, খুঁজতে আগ্রহী করে তোলেন উত্তর। সেই সব প্রশ্নের কাব্যিকতায় ধরা দিয়েছে দ্রোহ-প্রেম, আকার-নিরাকারের ভাবনা, আশা-উচ্ছ্বাস-আকাক্সক্ষার চিত্র। কবিতায় বারুদের গন্ধ ছোড়া কবি ব্যক্তিগত জীবনে খুবই নরম ও বন্ধুবৎসল। কবির সঙ্গে কাছ থেকে মিশে দেখেছি, তিনি আড্ডায় কাটিয়ে দিতে প্রস্তুত পুরোটা যৌবন। তবে সে আড্ডা হতে হবে সাহিত্যের। যেখানে থাকতে হবে কবিতার সুগন্ধি, কাব্যের নির্যাস। তাকে কবিতার বাইরে খুব কমই কথা বলতে শুনেছি। যখন যেখানে সাক্ষাৎ হবে কুশল বিনিময়ের পর ঢুকে যাবেন কবিতার গুহায়। সেখানেই তার তপস্যা। যে তপস্যায় নিজেকে নতুন করে উপলব্ধি করে হয়ত বলার প্রয়োজন বোধ করেছেন- ‘আশারাও ভিজে যায়, গলে যায়, টপ টপ পড়ে যায়/ সময়ের ঠিলে-ভাঁড়ে জমা হয়, জমে জমে হয়ে যায় স্বপ্নের গুড়।/ অথচ আমি অনিচ্ছার আলো হবো ভেবে নিভে থাকা আলোকবাতির মতো নিউ আরবানে/ যোগ-বিয়োগের দুইতারে ঝুলে থাকি,/ হয়তো থাকো তুমিও;/ ঝুলে ঝুলে আমারই মতো হয়তো বা এঁকে যাও, বুনে যাওÑ/ কুয়াশায় ভিজে যাওয়া স্বপ্নের মন্ত্রজাল, রেখা, পথ।/ অথবা হৃদয়ের বুকে, বিবেকের চোখে-মুখে লাগাও রঙ।’ (কবিতা : নিউ আরবানে, গ্রন্থ : অথচ পাখিরা ডানা মেলে দেয়)। একই সঙ্গে জাগিয়েছেন স্বপ্ন ‘আয়রে আবার মন বেঁধে নি’ মিহি সুতোয় হৃদমাঝে/ আয়রে আবার, আয় ছুটে যাইÑ নতুন করে ফের কাজে।/ দেখবি থেমে যাচ্ছে মেঘ ও ঝোড়ো তালের বাতাশটা/ সাজছে আবার রঙধনু সাজ আলোয় ভেজা আকাশটা।’ কবি সৈয়দ আহসান কবীরের গল্প তাকে বিশেষ পরিচিতি দিয়েছে। তার গল্পের বৈশিষ্ট্যে সব বয়সী পাঠক তৈরি করেছে। এটাই একজন লেখকের সবচেয়ে বড় পাওয়া বলে মনে করি। তার গল্পের ভাষা সহজ সরল। গল্পের প্লট নির্মাণে তিনি স্বতন্ত্র ও বিরলপ্রজ। গল্পে বাঁক ঘোরাতে দেখিয়েছেন মুনশিয়ানা, দিয়েছেন নতুনত্ব। তার গল্পের বাকশক্তি পাঠককে শুরু থেকে শেষ অবধি নিয়ে যায়। হাস্যরসাত্মক ও রম্য গল্পের পরতে পরতে দেখিয়েছেন বর্তমান সমাজচিত্র। চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন বাস্তবতার মানচিত্র। এ বৈশিষ্ট্যই বোধহয় পাঠকের কাছে তাকে অনন্য করে রেখেছে।
বহুমাত্রিক লেখক সৈয়দ আহসান কবীরের গল্পের আবেগ চোখের বরফ গলিয়ে দেয়। তিনি লিখেছেন, ‘ডুবন্ত সূর্যের দিকে চেয়ে আছেন আংকেল। কাছে এগিয়ে তার পিঠে হাত রাখে অহনা। চমকে ওঠেন তিনি। অহনার চোখ ভরা জিজ্ঞাসা। আংকেল ওঠে দাঁড়ান। অহনার মাথায় সান্ত¡নার হাত বুলিয়ে দেন। মুখে কিছুই বলেন না। পকেট থেকে বের করেন একগুচ্ছ চিঠি। তুলে দেন তার হাতে। যার প্রতিটি খামে লেখা বাবার চিঠি...’ (গল্প : বাবার চিঠি, গ্রন্থ : গল্পরা কথা বলে)। আবার তার গল্পের ভাষা কখনোবা হাসাতে হাসাতে নিয়ে যায় দ্রোহের সংসারে। তার লেখা মনোদৈহিক গল্প পাঠককে তাড়িত করতে করতে নিয়ে ওঠে বাস্তবতার উঠোনে।
কবির কবিতার সংসার নতুনের জন্য উদাহরণ হয়ে থাকুক। তার কাছ থেকে আমরা আরও কবিতা আশা করি। তিনি দীর্ঘজীবী হোনÑ এটাই প্রত্যাশা।