সুখসারি
ইমরুল কায়েস
🕐 ১:৫১ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০২১
হায়!
কী পোড়া কপাল শ্যামলার? এত দিন লোকমুখে শুনেছে- ‘নাগর আর নদীতে ভরসা নাই’ আজ তাই হলো। পরের ঘরের আশায় বরের ঘর ফেলে কোন গাঙের কিনারে ভিড়বে শ্যামলা?
অচ্ছুত নিচু জাতের হিদুর ঘরের মেয়ে। শুধু শরীরের গন্ধ আর ভাঁজের দাম আছে; মনের কি একপাই দামও নেই!
গতরের সদাই বেচে রাতের আঁধারে ধুয়ে-মুছে তো আর মন্দির-মণ্ডপে শ্রী শ্রী হরে হরে করে না। মনের শুদ্ধতা নিয়ে শ্যামলা হরিহরকে হৃদতুল্য দেবতার আসনে বসিয়ে শরীর ও মনের প্রার্থনায় এক মোহনায় নিয়েছিল। হরিহরও শ্যামলার পিরিতে প্রাণকাড়া। ঐ দূরে নোঙর করা এ পাড়ার জেলেদের নৌকার আড়ালে প্রতিরাতে চলে তাদের অভিসার। দুজনে মনভরে মুখ ডুবিয়ে ভালোলাগার চাদরে আদরের জলে অবগাহন করে তারপর শান্তি পেত। শেষে হরিহর মনে মনে বলে- ‘নেশাতে আর নারীতে সব দেবতা এক’। এ এক সাংঘাতিক অসুখ শ্যামলার- জাগানো শরীরের ক্ষুধা কি কমে?
শত সুখের পরও স্বামীর সোহাগের সুখ নারীর প্রথম কামনা। এখানে যখন টান পড়ে গেল তখন শ্যামলা প্রথম যৌবনের বিহান বেলার পাখি হরিহরের দিকে অজান্তেই টান বাড়াল। শরীর মনে শ্যামলা শতভাগ কিন্তু হরিহরের দিক থেকে শরীরের দিকে ষোলোকলা মনের দিকে সিকিভাগ। হরিহর ভাবে- শ্যামলা বরের ঘাটতি তাকে দিয়ে পুষিয়ে নিচ্ছে।
শ্যামলার শাস্ত্রসিদ্ধ পতিধন বিসু পয়সাপাতিতে পূর্ণ কিন্তু কামকলায় তার নৈপুণ্য ঠিক ফতুর হওয়া আড়ৎদারের মতো- মিছে লোকসানে ক্যাশ বাক্স খালি। কামে নেই; গন্ধও নেই যে শ্যামলা ওতে খানিকটা তৃপ্তি পাবে।
দোষ শ্যামলা ও হরিহর কারওই নয়। দোষ প্রকৃতি আর ওই ঠাকুরের। ঠেকলে সবাই ঠাকুরকে সঁপে। ঠাকুরকে মাথা ঠুকিয়ে শ্যামলার উতলা জলকে শীতল করার ঝরনা বিসুর নেই।
বিসু নিজেও বুঝতে পারেনি। বিয়ে গত হওয়ার মাস তিনেকের মধ্যে তার এ দশা হবে। শরীরের দুর্বলতা নেই; আহার নিদ্রায় নিয়ম আছে। বয়স ২৭-এ শরীরের গরম তার চরমে থাকার কথা। কিন্তু শ্যামলার সান্নিধ্যে গেলে বিসুর মহুয়ার কথা মনে পড়ে। তার সমস্ত শরীর জ্বলে ওঠে দপ করে নিভে যায়।
বিসু নিচু জাতের। মহুয়া জাতে ব্রাহ্মণ। মহুয়ার বাবা কোনোভাবেই রাজি না; সমাজ তো আরও না। একদিন নিশিতে বিসুর আদর নিতে নিতে মহুয়া চট করে মুখে বিষ ঢেলে পরজনমের রাধা হয়। গভীর রাত! মৃত ও নগ্ন নারী শরীর দেখে বিমূঢ় বিসু আস্তে আস্তে মহুয়ার লাশকে জামা পরিয়ে পাশের গাঙের কিনারে ফেলে দেয়। দমবন্ধ করা দৌড় দিয়ে বাড়ি এসে মাটির দাওয়ায় শুয়ে পড়ে।
পরের দিন সকালে মর্গ থেকে মহুয়ার কাটাছেঁড়া লাশ বিসুদের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে নিয়ে গেল। ভ্যানগাড়ির ঝাঁকুনিতে বাঁশের চাটাই থেকে মহুয়ার পা দুখানি বাইরে ঝুলছে। পা দেখে বিসু ভাবে, যে পায়ে চিমটি কেটে চুমু খেয়ে মহুয়াকে ভিন্ন স্বাদের খবর পাইয়ে দিত সেই পা...? মনে হচ্ছে পা দুটি দুলে দুলে বিসুকে ঠাট্টা করছে আর লাথি দেখাচ্ছে!
মহুয়া বলছে, লাথি মারি সাহসহীন শরীরপিয়াসী সুখের পায়রা অমন প্রেমিকের মুখে; সমাজের মুখে। যারা শরীরের ভাঁজ খোঁজে; মনের কারুকাজ বোঝে না। জোর করে বিয়ে দিলে বর-বউয়ে বাসর করলে বৈধ সঙ্গম হয় না। নারীর মনের একান্ত ইচ্ছের তো একটা বৈধ ও অবৈধ দিক আছে? এ বৈধতা কে দেবে?
মহুয়া সমাজের ভয়ে, বাপের ধর্মকর্ম লাটে ওঠার ছলে চলে গেল। কিন্তু শ্যামলার? এ যে সারা জীবনের জ্বালা। হিদুর নারী- পতিপ্রধান; পতিই শেষ। তাই বলে কি শ্যামলার শরীর এমনি করে যাবে- বিনা রোদে বিনা বৃষ্টিতে! জাগানো শরীর প্রতি রাতে ‘কাঁদে প্রতি অঙ্গের লাগি’।
শ্যামলার এ আর ভালো লাগছে না। বিসুকে কত বলে চিকিৎসার কথা। গঞ্জে কোনো কবিরাজের কাছে পাঁচুর ধ্বজভঙ্গ সারছে। পাঁচুর বউ তিনমাসের মাথায় পেট বাঁধতে পারছে। পাঁচুর বউয়ের খুশি আর ধরে না। ছয় বছরের সংসারে এত সুখ আর কখনো নাকি পায়নি ফুলন। গল্প করছে শ্যামলার সঙ্গে- পাঁচু নাকি খুবলে খুবলে তেনা-ছেঁড়া করে। ফুলন বলে আর আঁচলে মুখ ঢাকে। এদিকে শ্যামলা শোনে আর অভুক্ত তিয়াসে তার শরীর ফুলে ও শিরশির করছে। ইস! কেন যে বিসু কবিরাজের কাছে যায় না।
বিসুর বেদনা যে কোনখানে তা কি শ্যামলা জানে। শ্যামলার পেটানো শরীর কোনো দিকে ঘাটতি নেই। নিখুঁত এমন শরীরের টানে বিসুর শরীর জাগে না। যখনই শ্যামলায় উপনীত হয় তখনই মহুয়ার মৃত ও নগ্ন শরীর বিসুর চোখে ভাসে। সঙ্গে সঙ্গেই বিসু ভ্যাদা মাছের মতো চুপসে যায়; দম ফুরিয়ে আসে।
শ্যামলা জ্বলছে ভিতরে ও বাইরে...। ফণা তোলা সাপের মতো ফুঁসতে ফুঁসতে হাত ঝটকা দিয়ে দরজার কপাট খুলে মাটিতে বসে রাতের ঠাণ্ডা বাতাস গায়ে মাখে আধো শরীর আধো কাপড়ে। দূরের নিশ্চুপ আকাশে ডুবে যাওয়া চাঁদের পরে মিটমিট একটি তারা জ্বলছে। ক্ষীণ তারা বড় একা দূরের আকাশে; নিচে বড়ই একা শ্যামলা। দূরের এই নিঃসঙ্গ তারা শ্যামলাকে আরও জ্বালা দেয়। জোড়া ছাড়া জিনিস দেখলেই রাগ লাগে তার। যুগলে সুখ। জোড়া জিনিস দেখতে শ্যামলার ভালো লাগে। সকালে বাড়ির উঠানে কিংবা গাঙের পাড়ে জোড়া হাঁসা-হাঁসি, মোরগ-মুরগি, কুকুর-কুত্তি দেখলেও চোখ জুড়ায় শ্যামলার।
দিনদিন শ্যামলার অতৃপ্তি আরও তিতিয়ে উঠছে। ওদিকে হরিহর নতুন বউ নিয়ে ব্যস্ত। গত তিনমাস হরিহরের টিকিরও দেখা নাই। শুনেছে নৌকায় মাল চাপিয়ে সমুদ্রে গেছে। এ দিকে শ্যামলার তরী ভরাট। মাঝি বিনে বিরহে উদগ্রীব কখন খালি হবে তার ভরা তরী।
একদিন লাজ খুইয়ে শ্যামলাই বলে ওঠে- ‘চলেক হরি, মোরা বিহা করি। সন্দীপে গিয়া ঘর বাঁধুম।’ হরিহর শ্যামলার বুক থেকে চটকে ওঠে। উদাম শ্যামলার কাছ থেকে সটকে পড়ে বলে- ‘তা হবেক লয়; ঘরে হামার লতুন বহুউ আছে!’
শ্যামলা রাগে হরিহরের বুকে ও মুখে এক দলা থু থু দিয়ে বলে- ‘নাগর; নাগরই হয়। ভাতার লয়।’
‘বেডারা মাতারীর শরীল খোঁজে; মনডার গতি বোঝে না।’
‘যা ভাগ এহান হতি।’