ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

নিরুদ্দেশ যাত্রা

গৌতম বিশ্বাস
🕐 ১:০৫ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ২৭, ২০২০

খিদের ভারে বেঁকে যাওয়া শরীরটাকে সাধ্যমতো সোজা করে দাওয়া থেকে নেমে এল শ্যামদাস। দুপুরের ক্ষিপ্রতা ভুলে রোদ এখন অনেকটাই নরম। হালকা একটা হাওয়াও বইছে। অন্য সময় হলে দাওয়ায় বিছিয়ে রাখা মাদুরটায় গা-টা এলিয়ে দিয়ে ছোটখাটো একটা ঘুম সেরে নিত সে। সারাদিন খাটুনি তার কম যায় না। পুরনো ভ্যানরিকশাটায় বিভিন্ন রকম মুখরোচক খাবার নিয়ে তিন মাইল দূরের হাইস্কুলের গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিক্রি করে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পা দুটো টনটন করে। চোখে-মুখে একটা জ¦লুনি অনুভূত হয়। মাথাটা ভারী হয়ে আসে। এক একবার মনে হয় আর নয়। এই বয়সে এমন খাটাখাটুনি আর করবে না। কিন্তু ওই ভাবাই সার। বাস্তবটা তার কাছে বড়ই কঠিন। তাই ছাড়তে চাইলেও ছাড়তে পারে না। ছেলের মুখটা ভেসে ওঠে চোখের সামনে।

সুধন্যর এক কথা। বাপকে বলে দিয়েছে, ‘তুমারে কিন্তুক নিত্যিদিন বসায়ে বসায়ে খাতি দিতি পারব না আমি। একবেলা খাওয়ার জন্যি তিরিশটে কইরে ট্যাকা দিতি হবে। যে বেলা দিতি পারবা খাবা। না পারলি না খাইয়ে থাকপা।’

ছেলের মুখে এমন কথা শুনে মরে যেতে ইচ্ছে হয়েছিল তার। মনে হয়েছিল বউটা তার মরে গিয়ে বেঁচেছে। আবার বাঁচিয়েও দিয়ে গেছে শ্যামদাসকে। নয়তো দু’দুটো পেট চালাতে ভিক্ষেই করতে হতো। ছেলের কথা মেনে নিয়েও সে কেবল বলেছিল, ‘বাপ রে, আমি তোরে জম্ম দিছি। ছোট থ্যিকে বড় করছি। সেই তুই আমারে দুডো খাওয়ার জন্যি...’
বউমা কাজলতারা কথা শেষ হওয়ার আগেই খেঁকিয়ে উঠেছিল, ‘ছেল্যের জম্ম দিলিই তার ঘাড়ে বস্যে খাতি হবে নেকি? ওইডে হবে না। খাতি হলি ট্যাকা দিতি হবে। না দিলি আমার ঘরে ভাত নাই।’
অগত্যা এই বৃদ্ধ বয়সেও খাটতে হচ্ছে শ্যামদাসকে। সকালের খাওয়াটা স্কুলের মিড ডে মিল থেকে সেরে নিতে পারলেও রাতের খাওয়াটার জন্য তিরিশটা করে টাকা নিত্যদিন তাকে জুগিয়েই যেতে হয়। না জোগাতে পারলে খাওয়া বন্ধ। এই ভয় সারাক্ষণ তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। দু’দ- স্থির থাকতে দেয় না। রোদ, জল, ঝড়, বৃষ্টি সবেতেই বেরোতে হয় তাকে।
এতদিন এভাবেই চলছিল। খেয়ে-পরে একপ্রকার বেঁচেই ছিল শ্যামদাস। বাদ সাধল অসুখটা এসে। কী যে এমন অসুখ দেশে এলো যার জন্য গাড়িঘোড়া, স্কুল, কলেজ, বাজার সব বন্ধ করে দিল সরকার। এমনকি বাড়ি থেকে বেরোনোও বন্ধ। এ অবস্থায় বড্ড আতান্তরেই পড়ে গিয়েছিল শ্যামদাস। মাত্রই ক’টা টাকা সঞ্চিত করে রাখতে পেরেছিল কাছে। সেই দিয়ে একবেলা করে খেতে পাচ্ছিল। সারাদিন উপোস দিয়ে রাতের বেলায় চাট্টি খাওয়া। আজ দু’দিন হলো সেটাও বন্ধ। এত করে যে ছেলেকে বলেছিল, ‘একমুঠো দে রে বাপ, ব্যবসাডা শুরু কত্তি পালি হিসেব কইরে সপ মেটায়ে দেব।’ ছেলে কিন্তু তা শোনেনি। বলেছে, ‘উঁহু, ওইডি হচ্ছে না। ট্যাকা ফ্যালো, ভাত খাও।’

একে খিদের জ্বালা, তার ওপর মন খারাপের যন্ত্রণা। একফোঁটা ঘুমোতে পারেনি শ্যামদাস। সারাটা রাত কেবল কেঁদেছে আর বিছানায় এপাশ-ওপাশ করেছে। বারে বারে অতীত এসে কেবল খুঁচিয়ে দিয়ে গেছে চোখ দুটো। জল নয়, যেন রক্ত ঝরেছে চোখ দিয়ে। এই সেই ছেলে যাকে কত আদর সোহাগ দিয়েই না বড় করেছে শ্যামদাস। যখন খেতে পারত না তখন এই হাতে করে তাকে খাইয়ে দিয়েছে। যখন হাঁটতে পারত না তখন এই কাঁধে করে বিকেল বেলায় মাঠ থেকে ঘুরিয়ে এনেছে। গরমে রাত জেগে তালপাখার হাওয়া দিয়েছে। শীতের রাতে এই বুকের ওম দিয়েছে। সেই ছেলেই কিনা—
বড় কষ্টের একটা সংসার ছিল শ্যামদাসের। দিন আনি দিন খাই মানুষ ছিল সে। অন্যের জমিতে জন খেটে যা পেত দিনান্তে তার কাছে থাকত না কিছুই। চাল, ডাল, তেল, নুন কিনতেই চলে যেত সব। ফুলমালা বলত, ‘আর কদ্দিন। ছেল্যে বড় হলি দ্যাকবা আমাগের আর কষ্ট থাকপে না। তহন পা-র উপর পা তুল্যে খাবা।’
কেমন যে পায়ের ওপর পা তুলে খাচ্ছে শ্যামদাস বউটা যদি তার একটিবার এসে দেখে যেত।
দু’দিনের উপোসী পেটটা আজ সকাল থেকে কিছুতেই শ্যামদাসের কথা শুনতে চাইছিল না। তার কেবল একটাই চাওয়া ছিল—একমুঠো ভাত। হ্যাঁ, একমুঠো ভাত চাইছিল সে। নিদেনপক্ষে খানদুয়েক রুটি। বাসি, পান্তা যা হয় হোক। কিন্তু তাইবা কোত্থেকে দেবে শ্যামদাস। অগত্যা দাওয়ায় বসে পিঠটাকে বেড়ার গায়ে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে পড়ে ছিল। মাঠ থেকে ফিরে চান- টান করে সুধন্য দাওয়ায় এসে বসতেই কাজলতারা একথালা পান্তা ভাত তার সামনে এগিয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘নেও, খাও।’ সেই ভাতে কাঁচা লঙ্কা ঘষে নিতেই দারুণ একটা গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল দাওয়াজুড়ে। আর তাতে খিদেটাও চাগাড় দিয়ে উঠেছিল শ্যামদাসের। খানিক এগিয়ে গিয়ে শ্যামদাস বলেছিল, ‘আমারে একবাটি দে রে বাপ। খিদেয় তো আর থাকতি পারি নে।’
বাপের কথায় কোনো সাড়া না দিয়ে গোগ্রাসে গিলেই যাচ্ছিল সুধন্য। শ্যামদাস ফের বলেছিল, ‘দে না বাপ।’
এবারও কোনো উত্তর না দিয়ে সুধন্য আড়চোখে একবার তার দিকে তাকিয়েছিল কেবল। শ্যামদাস বলেছিল, ‘আমি যে তোর জম্মদাতা বাপ। বাপে না খাইয়ে আছে, তুই ক্যামনে খাচ্ছিস? তোর যে পাপ হবে রে।’

আর সহ্য হয়নি সুধন্যর। খাওয়া ফেলে বলতে গেলে একপ্রকার ছুটে গিয়ে ঘরের ভিতরে ঢুকে শ্যামদাসের বালিশ, কাঁথা পাজা করে তুলে উঠোনে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলেছে, ‘বার হও। বার হও বাড়ি থ্যিকে। শান্তিতি শালা দুডো খাতিও দেবে না।’
পাশ থেকে কাজলতারা ফোড়ন কেটেছিল, ‘দ্যাহো ক্যামনে শগুনির মতন চাইয়ে আছে। এমন কইরে কেউ নজর দিলি খাইয়ে হজম হয়?’
খুব বেশি আগের কথা সে নয়। এখনো সমানে চেঁচিয়ে যাচ্ছে সুধন্য। একবাটি খেতে চেয়ে শেষে কিনা—
দাওয়া থেকে নেমে এসে একবার উঠোনে দাঁড়াল শ্যামদাস। পেছন ঘুরে তাকাল ছেলের দিকে। এই সেই ছেলে, যাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল শ্যামদাসের। ছেলে বড় হবে। তার কাঁধে সংসারের জোয়াল তুলে দিয়ে বুড়ো বয়সে সে খাবে আর ঘুমোবে। সারাজীবন কম তো আর খাটেনি। ছেলে বড় হলে আর খাটবে কেন? ঘরটার দিকেও তাকাল শ্যামদাস। নিজের হাতে বানানো ঘর। এই ঘরে বসেই ফুলমালা জন্ম দিয়েছিল সুধন্যর। সেই ভরা বর্ষার রাতে ঝড় জল মাথায় করে দাই বিন্তি খুড়িকে ডেকে এনেছিল সে। রাত জেগে বসে ছিল দাওয়ায়। কত শীত, গ্রীষ্ম এই ঘরেই কেটেছে শ্যামদাসের। ওই যে ঘরের পাশে বুড়ো আম গাছটা। বোধ করি দু’কুড়ি বছর বয়স হলো। সোনাডাঙার হাট থেকে চারাটা এনে নিজের হাতে পুঁতেছিল সে। সুধন্যর তখন জন্মও হয়নি। এই ভিটে, উঠোন, কলপাড়, তুলসিতলা— সব শ্যামদাসের। অথচ এদের ছেড়েই আজ চলে যেতে হচ্ছে তার।
একফোঁটা জল বুঝি গড়িয়ে পড়ল চোখ থেকে। ঘুরে নিচু হয়ে মাটি থেকে কুড়িয়ে নিল সুধন্যর ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া তার বালিশ-কাঁথা। তারপর পেছন দিকে না তাকিয়ে হাঁটতে লাগল শ্যামদাস। কোথায় যাবে নিজেও তা জানে না।

 
Electronic Paper