শব্দশিল্পে করোনাকাল
সাইফুল ইসলাম
🕐 ৪:০৪ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ১৩, ২০২০
বিজ্ঞানের বহুমাত্রিক উন্নয়ন ঘটলেও সভ্যতার মানদণ্ডে আমরা শত বছর পিছিয়ে আছি। সৃজনশীল জ্ঞানসম্পন্ন মানুষের সংকট দিন দিন প্রকটাকার ধারণ করছে। সৌহার্দ্য কমে যাচ্ছে, মানবতার রেখা নিম্নগামী। করোনার মতো বৈশ্বিক প্রাকৃতিক দুর্যোগকালেও মানুষ ঘুষ, দুর্নীতি, ধর্ষণসহ নানান অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত। মাতৃরূপী প্রকৃতিকে শাসন করতে করতে মানুষ তাকে হিংস্র করে তুলছে। প্রকৃতি যদি তার হিংস্ররূপ একের পর এক প্রকাশ করতে থাকে। তাহলে আজকের অমানবিক ও নিষ্ঠুর মানুষরা তৃষ্ণাকাতরতা নিয়েই মরবে। আগুনে পুড়ে মরবে এবং অজানা রোগাক্রান্ত হয়েও মরবে এতে কোনো ভুল নেই। করোনা সংক্রমণ তারই উদাহরণ।
কবি অন্তরের স্টেথোস্কোপে সমাজের ব্যাধি অনুভব এবং সেই ব্যাধির প্রতিষেধক শব্দের অবয়ব চিত্রাঙ্কন ‘করোনাকালে কাব্য’ গ্রন্থটি। কবি মুনীর সিরাজ পেশায় চিকিৎসক। মানুষের রোগ সারিয়ে তোলেন। তিনি জানেন কোন রোগের লক্ষণ কী এবং করণীয়। গ্রন্থের কবিতায় অন্তরের স্টেথোস্কোপ দিয়ে তিনি পরিমাপ করেছেন সমাজকে, করোনাকালে মানুষের যাপিত জীবনকে। তার শব্দশিল্পে ফুটিয়ে তুলেছেন মানুষ যদি ভোগ ও লোভের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসতে না পারেন তাহলে এর পরিণাম কী হতে পারে।
করোনাযুদ্ধ অজানা, অচেনা-অদেখা জীবাণুর সঙ্গে মানুষের। যুদ্ধ নিঃশ্বাসের সঙ্গে, রক্তের সঙ্গে, শারীরিক সক্ষমতার সঙ্গে। বৈশ্বিক সংকট করোনাকে কবি তুলনা করেছেন মহাযুদ্ধের সঙ্গে। ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’ কবিতায় লিখেছেন-
পৃথিবীর চঞ্চলতা থেমে গেছে।...
...ধরিত্রী সহ্য করে নাই
মানুষের বিবেকহীন নিষ্ঠুরতা।
অতি নিশ্চুপে স্নিগ্ধ আবেগে
মানুষের বুকের নিঃশ^াস কেড়ে নিতে
বৈশাখী আল্পনার মতো আঁকা
মনোরম আলোকোজ্জ্বল ‘করোনা’-
পৃথিবী প্রকৃতিকে দিয়েছে উপহার;
গৃহবন্দি মানুষ এখন নতজানু, ক্ষমাপ্রার্থী।
করোনায় সম্মুখযোদ্ধা ডাক্তার, নার্স, শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দুর্দশার শেষ নেই। যুদ্ধের সরঞ্জাম ছাড়া তারা যুদ্ধের ময়দানে নেমেছেন। অমানবিক কতিপয় মানুষের এ সরঞ্জাম সরবরাহের নামে আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছে। অথচ নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন ডাক্তার, নার্স, পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। তারা নিঃশব্দে এক ফোঁটা দু’ফোঁটা জল ফেলছেন। কবি মুনীর সিরাজ সম্মান জানিয়েছেন এ মহান যোদ্ধাদের, অনুভব করেছেন তাদের ব্যথা। ‘নীলপরি’ কবিতায় বলেছেন-
কিন্তু হায়, আমার সোনার দেশে
সোনালি-রুপালি করোনাক্লান্ত যোদ্ধাদের
নিভৃতে অশ্রুপাত...
সাধারণ মানুষ যখন মুখে বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেন তখন কবির কবিতার ভাষা হয় প্রতিবাদ। কবিতা হয় অনুপ্রেরণা, অগ্রযাত্রার সঙ্গী। মন্দির, মসজিদ, গির্জা, অন্য উপাসনালয়, ঘরে-ঘরে মানুষ স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করছেন। মহামারী থেকে মুক্তি চাইছেন। কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। যেন ঈশ্বর এখন নির্জীব। কারণ তিনি প্রকৃতিকে এবারে মানুষের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। প্রকৃতি এবং মানুষের অসহিষ্ণুতায় ঈশ্বর বিরক্ত। এ ভাবনায় কবি ‘ঈশ্বর ঘুমিয়ে পড়েছে’ কবিতায় বলেছেন-
বিস্ময়ে হতবাক ঈশ্বর!
আমার সৃষ্টির অনির্বচনীয় পৃথিবীর এ কী চেহারা
এমন কালিমালিপ্ত!
কোথায় সেই সবুজ, নীল, রঙধনুর রঙ-
কে করেছে এইসব? ’
করোনা মানুষকে গৃহবন্দি করে ফেলেছে। মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস বাধাগ্রস্ত করছে। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এমনকি কর্মহীন করে ফেলেছে লাখো লাখো মানুষকে। জীবন-মৃত্যুর মাঝামাঝি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে মানুষকে। কিন্তু সময় থেমে নেই। ঠিকই সূর্য আগের মতো উঠছে-ডুবছে। তারিখ বদলাচ্ছে, মাস বদলাচ্ছে, বছর বদলাচ্ছে। ঈদ আসছে, পূজা আসছে। অথচ কোনো কিছুই আগের মতো নেই, জমকালো আয়োজন নেই। মানুষের মাঝে শুধু অদৃশ্য শত্রুর আতঙ্ক। মহামারীতে মানুষ আনন্দহীন, সঙ্গহীন। এ বিষয়ে কবি ‘করোনাকালের ঈদ’ কবিতায় বলেছেন-
এইবার হবে না তো পরা, রঙিন স্বপ্নের জালে
জড়ানো সুতোয় কাজ করা নতুন পাঞ্জাবি...
এছাড়াও ‘করোনাকণা কবিতা’ শিরোনামে ১৭টি কবিতা এবং ‘করোনা ছড়া’ শিরোনামে ১৩টি ছন্দোবদ্ধ ছড়া সংযোজন গ্রন্থটিকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। কবিতা তার শব্দ শেকলে সময়কে ধারণ করতে পারে। মুনীর সিরাজের ‘করোনাকালের কাব্য’ গ্রন্থটি এমন একটি সময়কে ধারণ করেছে যা হাজার বছর পরেও পৃথিবীবাসী মনে রাখবে। ৩৯ পৃষ্ঠার পেপারব্যাক বাইন্ডিংয়ের গ্রন্থটিতে স্থান পেয়েছে করোনাকালীন বিভিন্ন চিত্র। করোনাচিত্রের ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে কবিতায়, শব্দের বিন্যাসে কবি হৃদয় নিংরানো ভাবনার নিখুঁত ছোঁয়া রেখেছেন। তবে কয়েকটি কবিতায় আরও যতœবান হওয়া প্রয়োজন ছিল। আশা করি পরবর্তী সংস্করণে কবি বিষয়টি খেয়াল রাখবেন।