ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

আহমেদ শরীফ শুভ কবি ও গল্পকার

ওমর বিশ্বাস
🕐 ৪:৩০ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ৩০, ২০২০

কবি ও গল্পকার- দুই পরিচয়ে সমান পরিচিত আহমেদ শরীফ শুভ। তার কলম সমানভাবে শক্তিমত্তার পরিচয় দেয়। হৃদয়লাগা ছোট ছোট শব্দে কবিতা সাজাতে পারেন। কবিতার উপস্থাপন ঢঙ সুন্দর। অল্পে অনেক কথা বোঝাতে চান, তার বলা কথাগুলো শব্দমালায় সেজে কবিতা হয়ে ওঠে। তার কবিতা সুখপাঠ্য- তাতে মননের পরিচয় পাওয়া যায়। তার দুটি কবিতার বই- ‘বিহঙ্গ উড়িয়ে দাও’ প্রকাশিত হয় ২০১০ সালে এবং ‘স্বপ্নে দেখি তোমার মুখ’ ২০১৩ সালে।

তিনি গল্প বলেন আয়েশি ঢঙে। সিরিয়াস বক্তব্যকে তুলে ধরেন চিত্তের খোরাক করে খুব সহজে। এ পর্যন্ত দুটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। প্রথমটি ‘তৃষ্ণা ও জলে’ প্রকাশিত হয় ২০১৩ সালে। দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘রাজকন্যার আহ্নিক’ প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে। দুটি বইয়ে মোট ১৯টি গল্প রয়েছে; প্রথমটিতে ৯টি ও দ্বিতীয়টিতে ১০টি। কথাসাহিত্যিক হিসেবে আহমেদ শরীফ শুভকে জানা যায় গল্পগুলোর মধ্যে দিয়ে। সফল গল্পকার হিসেবে তাকে পাওয়া যায় গ্রন্থদ্বয়ে।

আহমেদ শরীফ শুভ কবিতার মধ্যে প্রেমকে উচ্চকিত করে তোলেন, সমাজ বদলের হাতিয়ার হিসেবে কবিতাকে দেখেন। তার কবিতা সুন্দর একটি সমাজের দিকে নিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দেয়। তিনি বলেন, ‘বিশ্ব যেমন সব মানুষের বসত হয়ে/ নিজে থাকে জরাজীর্ণ, ভারাক্রান্ত, অনিশ্চিত/ আমি তেমন অবহেলায় কুঁকড়ে গেলেও বুক চিতিয়ে তোমায় দেব বাসের যোগ্য খানিক ভূমি।’ (অভিমান, স্বপ্নে দেখি তোমার মুখ, পৃ. ৫০)। প্রেমের পাশাপাশি এরকম সাহসী উচ্চারণ দেখা যায় তার কবিতায়।

তিনি অপেক্ষায় থাকেন। তার কোনো কোনো অপেক্ষা শেষ হয়, কোনোটা শেষ হওয়ার নয়। তার প্রেম হৃদয় দিয়ে মোড়ানো, তার স্বপ্নের মতো। তার উপস্থাপনা ঋজুত্ব পাঠককে আকৃষ্ট করবেই। তিনি বলেন, ‘তোমার চিঠি আসবে বলে/ সেদিন অপেক্ষায় স্থবির ছিল সারাটি পৃথিবী।/ চিঠি আসেনি।’ (চিঠি, ঐ, পৃ. ৪০)। চিঠি আসেনি বলে যে ব্যাকুলতা, না আসার ভিতর আছে গভীর বেদনা আর আশার সম্ভাবনাময় অপেক্ষা। আসলে কবিরাই পারে এরকম আলো-আঁধারিকে স্বাপ্নিক করে তুলতে।

তার কবিতাগুলোয় রয়েছে সুন্দর সুন্দর উপমা। অল্প কথায় অনেক বলে বোঝান কবিতায়। কবিতা দিয়ে বোঝান, ‘কাচের চুরির মতো বোধের সংসার ভাঙো।’ (অনুভব, বিহঙ্গ উড়িয়ে দাও, পৃ. ১৩)। এ বোধ ভাঙার কষ্টের ভিতর দিয়েই তিনি প্রেম শেখান, সমাজ গড়ার কৌশল জানিয়ে দেন।

তিনি স্বাপ্নিক কবি হিসেবে তুলে ধরেন সম্ভাবনার বাণী। পাঠককে আশার কথা শুনিয়ে সামনে চলার পথ দেখাতে চান ‘মৃত্তিকার সমগ্রজুড়ে থাকে বিষণœ আকাশ/ স্তব্ধতার অনামিকা ছুঁয়ে যায় শোকের কফিন/ তবুও আমি অপেক্ষায় থাকি।’ (অপেক্ষা, ঐ, পৃ. ৪২)।

‘তৃষ্ণা ও জলে’ বইটি দীর্ঘ পটভূমিতে সাজানো। জীবনের নানা দিক যেভাবে দেখেছেন সেভাবে তুলে ধরেছেন গল্পে। উপলব্ধিটাকে সাজিয়েছেন শব্দ দিয়ে। প্রেম-বিরহ তার গল্পের উল্লেখযোগ্য অংশ দখল করে আছে। সামাজিক কুসংস্কার আর অসঙ্গতিকে নিজের মতো করে দেখাতে চেয়েছেন। কোনো কোনো গল্পে সমাধানের পথও বাতলে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। গল্পের চরিত্রগুলোর ভিতর জটিল জীবনকে দেখা হয়েছে। কিন্তু তার বাক্যগুলো জটিলতামুক্ত। তাই তার গল্পগুলো সহজে বোঝা যায়।

কিছু গল্পগুলো আছে প্রেম আর সংগ্রামের সংঘাত নিয়ে। পাখি উড়ে চলে গেল গল্পের ভিতর দ্বন্দ্ব-সংঘাত দেখা যায়, প্রিয় বারুদের ভিতর দেখা যায় পুরাটাই যুদ্ধজয়ের নেশা। অনেক গল্প আছে মনে হবে শুধু প্রেম নিয়ে লেখা, কিন্তু বাস্তবতাকে জড়িয়ে রেখেছেন গল্পের আঙ্গিকে। তেমনি অতিমানবিকতা দেখা যায় তার ‘অতিকায় মানুষ’ নামের গল্পে।

তার রাজকন্যার আহ্নিককে বলা যায় মনোস্তাত্ত্বিক প্রভাবযুক্ত একটি সফল প্রয়াস। ব্যক্তিজীবন প্রত্যেকের আলাদা আলাদা। অথচ গল্পকার সকলের দিকে দৃষ্টি দিয়ে কাহিনি সাজান। কত বর্ণিল মিশেলে তৈরি হয় গল্পের রসায়ন। মানুষের শরীর মন নিয়ে সে সব একত্রিত করে তোলেন। এক্ষেত্রে সার্থক প্রয়াস এ রাজকন্যার আহ্নিক। গল্পগুলো উচ্চবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণিতে সাজানো। দেশ থেকে দেশান্তরিত পটভূমিতে বিস্তৃত। উচ্চবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্তের প্রভাব প্রবল রাজকন্যার আহ্নিক গল্পগ্রন্থে। এদের নিয়েই বেশিরভাগ গল্প বলা। সামগ্রিকভাবে এ শ্রেণির মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, চাওয়া-পাওয়া তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন- তার গল্পগুলো পড়লে সেটা বোঝা যায়।

গল্পের শুরুটা চমৎকার। আর গল্প না পড়লে বোঝা যায় না কোথায় নিয়ে যেতে চান তিনি পাঠককে। সমাজবদ্ধ মানুষের সীমাবদ্ধতার দেয়াল তিনি ভাঙতে চান। তার সেই দিক দিয়ে সমাজমনস্কতার দিকটি প্রবলভাবে লক্ষ করা যায়। তার গল্পগুলো পড়লে বোঝা যায় তিনি মানুষকে যান্ত্রিক কোনো বস্তু হিসেবে দেখতে চান না। তিনি চান না মানুষ রোবট হোক। মানুষকে মানুষ হিসাবে দেখতে চান, মানুষকে নিয়ে বিশ্লেষণ করেন- এ বিশ্লেষণ ক্ষমতা তার স্বভাবজাত। কম মানুষই পারে নেশা আর পেশাকে একত্রে সামনের দিকে নিয়ে যেতে। আমরা তার মধ্যে দেখি সেই দ্বৈতসত্তার বিচরণ। তার পেশার সঙ্গে নেশার মিল কখনো পাওয়া যাবে না।

অথচ অন্তর যার স্বতঃস্ফূর্ত সৃষ্টির পেছনে সৃজনশীল তাকে কীভাবে আটকে রাখা যায়? তিনি মানুষের মনকে নিয়ে বিশ্লেষণ করেন, তাদের নিয়ে গল্পের ভিতর শব্দের খেলা দেখান। তার গল্পগুলোর এ মনোস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করতে পারেন এ জন্যই, তিনি মানুষ, মানুষের শরীর-মন নিয়ে পেশাগত কাজ করেন। এজন্যই এগুলো তার গল্পের উপাদান হয়, তার গল্পের প্লট সৃষ্টির ক্ষেত্রে সহজ হয়। তার গল্পগুলোতে এজন্য অনেক চিকিৎসাবিদ্যা সংক্রান্ত শব্দ লক্ষ করা যায়।

জীবন সরলরৈখিক নয় কিন্তু তার কবিতা ও গল্প বলার ঢঙ সোজাসাপ্টা, গল্পের ভিতর রয়েছে সমাজচিত্রের দ্বান্দ্বিক উপস্থিতি। কেননা, তিনি চান জীবন জটিলতার অনুষঙ্গগুলো মানুষের কাছে তুলে ধরতে। ভালোবাসার গল্পকার হিসেবে লেখকের হৃদয়ে পরতে পরতে পাওয়া যায় ভাষার খেলা। গভীর প্রেম আর অন্তর্দৃষ্টিতে উঠে আসে জীবনের কাহিনি। কথাগুলো তার কবিতা ও গল্প উভয়টাকেই ছুঁয়ে যায়। একজন সফল কবি ও কথাসাহিত্যিক হিসেবে আমরা তাকে পাই।

 
Electronic Paper