ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বোরাক

গোলাম মোর্তুজা
🕐 ৪:২০ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ৩০, ২০২০

এশার আজান হলো। বর্ষার সোঁদা আবহাওয়ায় সালাম আজ বাড়িতেই নামাজ আদায় করে স্ত্রী রেবেকাকে ডেকে নরম ভাষায় বললেন, ‘হুনো রেবেকা, একদিন আমাগো সব্বাইরে আল্লাহর কাছে ফিরত যাওন লাগব।’ স্বামীর কথা শুনে রেবেকা প্রতিকূলে সাঁতার না কেটে বললেন, ‘হ পড়মু। ক্যাল থ্যাইক্কা পড়মু।’

সালাম স্বপ্ন পরিধির নোঙর টানতে টানতে বললেন, ‘দু’দিনের দুনিয়া। ফাঁকি দিও না।’ 

সেদিন সারারাত বৃষ্টি থামেনি। সকালেও অবিরাম। রোদের রঙ ধার করে বৃষ্টি নিজেকে রাঙিয়ে নিয়েছে। সালাম হাতে ছাতা নিয়ে বের হলেন। একটু বৃষ্টি হলেই মসজিদের যাওয়ার রাস্তাটি ঘাড় উঁচিয়ে ভয় দেখায়। বয়স হয়েছে কাদা-পাঁক বাধার প্রাকার মাড়িয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। তাই আজ বের হয়েছেন ঘোড়ার খোঁজে। কিছুদিন আগে পাঁচ কাঠার ধানি জমি বিক্রি করেছেন। সে টাকাগুলো নিয়ে হাঁটছেন নাখাইলপুর গ্রামের ঘোড়ার মালিকের বাড়ির উদ্দেশ্যে। মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ার ইচ্ছা উনি মেটাবেনই।

সন্ধ্যার ঠিক আগে সালাম ঘোড়ায় চড়ে পথ ও এলাকাবাসীকে রাঙিয়ে বাড়ি ফিরলেন। ঘোড়াটি গাধার অবয়বের ঘোড়া।

বাইরে বেশ হট্টগোল। দৌড়ে বের হলেন রেবেকা। অবাক কাজলমাখা চোখে তাকালেন সালামের দিকে। আরবার গ্রামবাসীর দিকে। সালাম নামল ঘোড়া থেকে। ঘোড়া চিঁহি চিঁহি রবে জানান দিল, তুমিই আমার মনিব। সালাম তার ডান হাত ঘোড়ার মাথায় রেখে আলতোভাবে বোলাতে বোলাতে তাকালেন রেবেকার দিকে। রেবেকার মুখ যেন অজগরের ফণা তুলে আছে- ‘এ কী করেছেন আপনি। ঘোড়া! আমার বেলাত্ নাই নাই। আর ঘোড়া কিন্না আনলেন কিল ল্যায়?’ নানান খিস্তি কথার তুলে উড়ল অনেকক্ষণ ধরে। সালাম শান্ত মনে অজু করলেন। মসজিদের পথে পা বাড়ালেন। অকস্মাৎ ঘোড়াটি সালামের কথা শোনার জন্য তীক্ষতা নিয়ে উৎকর্ণ হলো। ত্রস্তে ঘোড়াতে চড়ল সালাম। মনিবকে পৌঁছানোর উত্তেজনা যেন ঘোড়াটির শিরায় দাপাদাপি করছে। এখনো আকাশে মেঘ ক্রমবিস্তারী।

দু’মিনিটের মাথায় ঘোড়াটি মসজিদের প্রান্ত ছুঁয়ে দাঁড়াল। সালাম চমকে গেলেন। মসজিদের পথ ঘোড়াটি চিনল কী করে? ঘোড়ারাও চেনে মসজিদ, আল্লাহর বান্দারা চেনেন না! মনের কথা মনে নিয়েই মসজিদে ঢুকলেন। নামাজান্তে মুসল্লিদের মাঝে হইচই পড়ে গেল- শুধু মসজিদে এসে নামাজ পড়ার মানসে সালাম ঘোড়া কিনেছেন।

সালাম ঘোড়ায় চড়ে মসজিদে গিয়েছেন। উনি প্রতিদিন-ই ঘোড়াকে মসজিদের পাশে থাকা কাঁঠাল গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখতেন। নামাজ শেষ করে এসে দেখতেন খোলা সে বাঁধন। ঘোড়াটি কোনোদিনই পালায়নি। বরং দাঁতে দাঁত খিঁচে দাঁড়িয়ে থাকে। ঘোড়ার এমন আচরণে সালাম ঘোড়াকে শাসন না করে অবাক চোখে বারংবার শুধু তাকিয়েই দেখেছেন। পাঁচশত পঁয়ষট্টি দিনের মাথায় সালামের জীবনে কী যেন হলো। অদৃশ্য কেউ এসে বুকটি খামচে ধরল। সে কিছু সময়ের মধ্যে বাকরুদ্ধ হলো। চেতনা হারাল। মুখ দিয়ে ধবধবে সাদা ফেনার মতো কী যেন বের হয়ে গেল।

গ্রামবাসী সেদিন সালামের জন্য প্রাণখুলে দোয়া করেছিল, হে আল্লাহ, সালামেরে পরপারে ভালো রাইখো।

সালামের মৃত্যুর তিন ঘণ্টার মাথায় হঠাৎ ভোজবাজির মতো বোরাকটি উধাও হয়ে গেল।

 
Electronic Paper