কবিতা : জীবন উপলব্ধির হিরণ্ময় মাধ্যম
বীরেন মুখার্জী
🕐 ২:৪৩ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ০৯, ২০২০
চিন্তনবিভার বহুবিধ স্তর অতিক্রমের সময় হঠাৎ থমকে যাই, দেখি জীবন এক হাওয়ায় মিঠাই! নিমেষেই পরিসমাপ্তি যেন! কখনো অনুভূত হয়, জীবনের মধ্যে জীবন নেই; কেবলি রাশি রাশি অনুভব। বাস্তবে এ অনুভবের সমষ্টিকে জীবন হিসেবে ধরে নিলে, অনুভবটুকুই প্রকৃত প্রস্তাবে কবিতা। ফলে বাস্তবতার উদঘাটন ছাড়া কবিতা আর কিছু নয়।
কবিতা ভাষার সৌন্দর্যে উপস্থাপিত একধরনের সংকেত। ফলে কবিতাকে সংকেতবাহীও বলা যায়। কবিতার এ সংকেতময়তা ভিন্ন ভিন্ন ব্যঞ্জনা নিয়ে রসগ্রাহী পাঠকের অনুভবে যত বেশি জীবন্ত হয়ে উঠতে সক্ষম, সে কবিতা তত বেশি বহুরৈখিক। কবিতা আমার কাছে এমন একটি অনুভবের সূত্রমুখ যা দিয়ে আমি জীবন উপলব্ধি করতে চাই। আমার ব্যক্তিগত মান-অভিমান, কল্পনা-অনুরাগ, প্রকাশ-অনুভূতি সবই তাই কবিতাকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে।
প্রয়োগের কারণে শব্দের মধ্যে যে চিন্তা দুল্যমান, তার যে ব্যাপ্তি এবং সম্প্রসারণ তা নিয়েই আমি নিয়ম ভাঙার মায়া-বিভ্রমে মেতে উঠি। বুঝি, আলো-ছায়ার পক্ষপাতিত্বে আমার বিশ্বাস। প্রচলিত ধারণাকে বাজিয়ে দেখার ইচ্ছেও কাজ করে। এভাবে জীবনটাকে ধরার, সমগ্রতার অনুসন্ধান চালাই কবিতা দিয়ে। কবিতা আমার কাছে একাধারে কাঁটা এবং কুসুমসদৃশ।
কবিতাকুসুমকে আরেকটু চিত্রিত অন্যভাবে করলে দেখতে পাই, জীবনের মৌন আঙিনায় একাকী পল্লবিত শিল্পটির নামই কবিতা। শিল্পের যে গভীরতা এবং সততা, তার মধ্যে কবিতাই সবচেয়ে জীবনতন্নিষ্ট। তাই আমার কবিতা কোলাহলমুক্ত ও মায়াবী। হৃদয়সংবেদনের স্তরে মৃদু আঘাত সৃষ্টিকারী অহঙ্কার এবং সারল্যের স্বচ্ছতায় উদ্ভাসিত অমৃত-সুন্দরও বটে। আক্ষরিক অর্থে আমার কবিতা হলো শব্দ সমবায়ে গড়ে তোলা জীবনের প্রতিরূপ।
পূর্বসূরিরা জীবনকে যেভাবে দেখেছেন, আর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কীভাবে দেখছি, এর মধ্যে তারতম্য রয়েছে নিশ্চিত; কিন্তু বিষয় ও প্রকরণগত গঠনে পূর্বসূরিদের থেকে হয়তো পুরোপুরি প্রভাবমুক্ত নয় আমার কবিতা। তবে অনুভবের চিত্ররূপ উপস্থাপনে নিজস্ব শৈলী সৃষ্টির পথেও যতœবান আমি।
শুনে আসছি, কবিতা অনেক রকমের। বিশ্বাসও করি। আর এই বিশ্বাসের তাৎপর্য আমার মতো করে বুঝি। ফলে কবিতা কখনো কখনো জটিলতম সুন্দর হয়ে ধরা দেয়।
যদিও তাকে আমি জীবন থেকে পৃথক করি না, করতে চাই না। বরং ভাবনার অজস্রতা ও বহুমুখি রসায়নে, প্রাচ্যীয় নন্দনতত্ত্বের আলোকে তাকে নিজের মতো করেই আদল দিয়ে থাকি। কবিতা আমার মনের আকাশে পুঞ্জিভূত মেঘদল, কখনো শ্রাবণের অমল বর্ষণ আবার যাপনের সমূহ বাস্তবতা। কবিতা আমার জীবন উপলব্ধির হিরণ্ময় মাধ্যম।
প্রণয়ের চেয়ে বেশি কিছু নয়
আগাম ঘটনার ভেতর ভয়ানক বাস্তবতা দুল্যমান;
পরিত্রাণহীন সবাই, যেন নির্মম আঁধারের মুখোমুখি;
সন্ধিহীন স্তব্ধতার কাছে এরপরও যেটুকু স্বাক্ষর
নোনাধরা পৃথিবীর কাছে যতটুকু পরমায়ু
পাখা মেলেছে রোদেলা পথে! ঘুমের আজলা ধরে
কার লালসার নিচে জমে আছে অশ্রুত সকল স্মৃতি,
প্রণয় রাঙাতে এসে তুলে নিচ্ছে কে গগনবিদারী পাপ?
গ্রীষ্মের উজ্জ্বল ভোর, নিপুণ বিশ্বাসে জেগে ওঠা মুখ
বিপুল ঘাসের বুকে সপ্রতিভ দিন আজ আর
চোখে ধরছে না, যখন প্রান্তর ছেড়ে উড়ে যায় পাখি
শাদা জ্যোৎস্নায়; পরিশীলিত জীবনের গানে—
ত্রিমাত্রা
১.
অসাধারণ ভাঙলাম নিজেকে—
বিরল-মুহূর্ত ডাকছে লেক ভ্রমণে;
জানালার পাশে অকস্মাৎ রঙয়ের হাট
বইছে শরৎ. যথাস্থানে তুমুল উচ্ছ্বাস!
২.
শিহরণ বুনে যায় রাত
নানাবর্ণে ভাবনাসংঘাত
অচেনা কি খুব আসন্ন প্রভাত?
৩.
তুমি বলেছিলে : পঞ্জিকার পাতা ছিঁড়ে
রক্ত ফুটবে—
খুলে পড়বে মাত্রা ও তেধাই!
অথচ, আমি দেখছি—
অক্ষরে অক্ষরে শ্রুতি
অভীপ্সায় সোম-ফাঁক
মৃদঙ্গ ছুঁয়েই উড়ে যাচ্ছে হরিবোল...
তৃতীয় পৃষ্ঠা
হেসেই বলেন তিনি : কী আর এমন বাধা;
স্বপ্নটাকে ভেঙে ফেলে— পালিয়ে যাবেন
এটাই সহজ, এখানেই নিষ্কৃতি;
রাত পোহালেই অন্য শোভা, পুরু দেয়াল
গৃহস্থালি; হয়তো পাবেন নম্র কোলাহল
লজ্জানত; আঁকড়ে ধরা ভোর
রত্ন-আভাটুকু;
আরও পাবেন শাদা জেদ আর বরফকুচি
দিগ্-দিগন্তে আলোর পাখি রঙের শরীর
নস্টালজিক বন;
হেসেই বলেন তিনি : ভোরের গাছেই
ফুটবে সেদিন ভস্মীভূত মন।