ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে অজানা কিছু!

সাজেদুর রহমান
🕐 ৪:২৫ অপরাহ্ণ, মে ০৭, ২০১৮

আজ ২৫ বৈশাখ, বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৭তম জয়ন্তী। তার জন্মদিনে প্রকৃত প্রস্তাবে অজানা কিছু কি বলা সম্ভব? এমন কিছু, যা আগে কেউ বলেনি? মনে হয় না। সব কিছু বলা হয়ে গেছে। নানানভাবে বলা হয়েছে। তারপরেও দেখি অজানা কিছু বলতে পারি কি না।

ক) ভদ্রলোক ধর্মপ্রাণ মুসলমান :
রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে ইংরেজ পুলিশের কৌতূহল হাস্যকর রূপ নিয়েছিল। বীরভ‚মের এসপি তখন ইংরেজ সাহেব। জেলার বোলপুর থানার ভিলেজ ক্রাইম নোটবুকের তৃতীয় অংশে পুলিশ যে বিবরণ দিয়েছে তাতে বলা হচ্ছে, ‘কে এই আলখাল্লা পরা দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ ভদ্রলোক, যিনি শান্তিনিকেতনে প্রতিদিন পায়চারি করেন?’
গোয়েন্দারা ছুটলেন, সুপার নিজে তদন্ত করে গোপন রিপোর্ট দিলেন, ‘ভয় পাওয়ার কিছু নেই, ভদ্রলোক ধর্মপ্রাণ মুসলমান।’ কিন্তু পুলিশের বড় কর্তারা এতেও সন্তুষ্ট নন। ফলে জোর তদন্ত শুরু হলো। এবার গোপন রিপোর্ট এল, ‘শুনেছি তিনি একজন কবি, নাম রবীন্দ্রনাথ। নামডাকও আছে। তবে তিনি পুলিশের সঙ্গে বড় দুর্ব্যবহার করেন।’
খ) সন্দেহভাজন ‘দাগি’ আসামি :
পুলিশের নথিতে রবীন্দ্রনাথের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১৯০৫ সালের ডিসেম্বর মাসে। সরকারের কাছে পাঠানো আইজি পুলিশের এক বিশেষ রিপোর্টে কবিকে ‘কবি-রাজনীতিবিদ’ (চড়বঃ-চড়ষরঃরপরধহ) বলা হয়েছে। ১৯০৯ সালে বাংলার স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডিআইজি এক প্রজ্ঞাপন দিয়ে জেলার এসপি ও কলকাতা পুলিশ কমিশনারকে কয়েকজন ‘পাবলিক অ্যান্ড প্রমিনেন্ট পারসন কানেকটেড উইথ পলিটিক্যাল অর্গানাইজেশন’-এর ওপর নজর রাখার নির্দেশ দিলেন। এই তালিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম ছিল।
এই নির্দেশনামার পুলিশের পরিভাষায় ‘Suspect’ বা সহজ চলতি কথায় ‘দাগি’ ব্যক্তি। এ বিষয়ে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘শুনেছি কলকাতায় থাকাকালীন কবি যখন ঘোড়ার গাড়িতে চেপে রাস্তা দিয়ে যেতেন সেই সময় জোড়াসাঁকো থানা থেকে পুলিশ হেঁকে জানিয়ে দিত অমুক নম্বর আসামি যাচ্ছে।’
গ) রবীন্দ্রনাথ একজন ইহুদি :
 নোবেলপ্রাপ্তির পরে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অদ্ভুত কিছু অপবাদের মুখোমুখি হয়েছিলেন। বিশের দশকেই রবীন্দ্রনাথ জার্মানি গেলে দক্ষিণপন্থী জার্মান পত্রিকায় প্রচার করা হচ্ছিল, রবীন্দ্রনাথ একজন ইহুদি। তার আসল নাম জধননর ঘধঃযধহ. এই কবি ‘ওপেন হাইমার’ নামে বোম্বাইয়ের এক ধনী ইহুদি যুবতীকে বিয়ে করে প্রচুর টাকা পেয়েছেন। মেয়েটির বাবা বাঁশের ব্যবসা করে প্রচুর টাকা করেছেন। দক্ষিণপন্থী জার্মান পত্রিকা অন্ধ স্বাদেশিকতাবশত ১৯২১-এই বলছিল রবীন্দ্রনাথ একজন defeatist বা একজন traitor।
ঘ) আদালতের কাঠগড়ায় কবি :     
খুলনার হীরালাল সেন নামের একজন শিক্ষক (সেনহাটী বিদ্যালয়ের, বর্তমান দিঘলিয়া উপজেলার সেনহাটী গ্রাম) ‘হুঙ্কার’ নামে একটি কবিতার বই প্রকাশ করেন। বইটি রবীন্দ্রনাথকে উৎসর্গ করেছিলেন কবি।  
রাজদ্রোহের বিবেচনায় ওই বই বাজেয়াপ্ত করে হীরালালের বিরুদ্ধে মামলা করে ব্রিটিশ সরকার। এই সূত্রে ১৯০৮ সালে খুলনা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে সমন পেয়ে সরকার পক্ষে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য কবিকে শেষ পর্যন্ত খুলনা আদালতের সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়।
রবীন্দ্রনাথ ওই মামলার প্রধান সাক্ষী ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সাক্ষ্য মোটেই সরকারের পক্ষে যায়নি। ওই মামলায় হীরালালের সাজা হয়েছিল। কারামুক্তির পর ১৯১০ সালে হীরালালকে শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্যাশ্রমে নিয়োগ করেন রবিঠাকুর।
ঙ) আপিল বিভাগের বিচারক :
পৈতৃক জমিদারির ভার নিয়ে রবীন্দ্রনাথ এলেন কুষ্টিয়ার শিলাইদহে। কিছুদিনের মধ্যেই বেশ জাঁকিয়ে বসলেন তিনি। গ্রামের অশিক্ষিত চাষি প্রজারা প্রায়ই সামান্য স্বার্থের জন্য মারামারি-হানাহানি বাধিয়ে ফেলত। আর দশটা জমিদারের মতো তাকেও করতে হতো বিচার-সালিশ। তবে রবীন্দ্রনাথ এর সমাধান করলেন একটু অন্যভাবে। গঠন করলেন গ্রাম পঞ্চায়েত।  
কোর্ট-কাচারি, উকিল-মোক্তার নানা হুজ্জত এরিয়ে পঞ্চায়েতপ্রধানরা গ্রামের ছোটখাটো ঝগড়া-বিবাদ এমনকি ফৌজদারি মামলার বিচার-সালিশ করতেন। এতে বিবাদ না মিটলে পরগনার পাঁচ পঞ্চায়েতপ্রধান মিলে আবার করতেন বিচারটি।
বাদী বা বিবাদী কোনো পক্ষ যদি সেই রায়ে সন্তুষ্ট না হতেন, তাদের জন্য খোলা ছিল আপিলের দুয়ার। তখন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের কাছে আপিল করতে পারতেন তারা। তবে ব্রিটিশ ভারতের সরকার সব জায়গায় এ ধরনের ব্যবস্থায় সন্তুষ্ট ছিল না। রবীন্দ্রনাথের এই পঞ্চায়েতি বিচারব্যবস্থা এতটাই সফল হয়েছিল যে ইংরেজ সরকার তাতে নাক গলাতে আসেনি কখনই।
চ) একাই যখন প্রতিবাদী :  
১৯২১ সালে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্থাপনা ও ঐতিহ্য তাজমহল ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একাই তাজমহল ভাঙার প্রতিবাদ করেছিলেন। এ ব্যাপারে তিনি দেশ-বিদেশে বক্তব্য দেন ও জনমত গড়ে তোলেন। এ নিয়ে আমেরিকায়ও তিনি বক্তব্য রাখেন। যার ফলে পৃথিবীর অসাধারণ সৌন্দর্যময় স্থাপনা তাজমহল রক্ষা পায়। বাংলা একাডেমিতে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট স্থপতি, রবীন্দ্র গবেষক ও পরিবেশবিদ অরুনেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পরিবেশ, নির্মাণ সংস্কৃতি ও রবীন্দ্রনাথ’ শীর্ষক বিশেষজ্ঞ বক্তৃতায় এ কথা জানা যায়।
‘সঙ্কোচের বিহ্বলতা নিজের অপমান’-এ গানটিতে রবীন্দ্রনাথ নিজেকে আত্মবিশ্বাসী হওয়ার কথা বলেছেন। তিনি দেখিয়েছেন পর্বতের মতো অবিচল থেকে বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে কিভাবে সফলতা অর্জন করতে হয়।
পর্বতের ছবি কাগজে আঁকা যায়। মুছে ফেলা যায়। কিন্তু বাংলার সিথানে যে দাঁড়িয়ে আছে হিমালয়, তাকে মুছে ফেলা যায় না। রবীন্দ্রনাথকেও মুছে ফেলা যাবে না। বাঙালির সারস্বত নির্ভরতার প্রধান ভরসা রবীন্দ্রনাথ। তিনি আমাদের জীবনচর্যার পরতে পরতে জড়িয়ে মিশে যাচ্ছেন সুখে ও দুঃখে। বাঙালির প্রতিটি সংকটে, সম্ভাবনা, জনারণ্যে, নির্জনতায় সিথানে হিমালয়ের মতো জেগে আছেন। তাঁর জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধা।

 
Electronic Paper