ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

মাছের ডিম

আফরোজা পারভীন
🕐 ১২:২৭ অপরাহ্ণ, জুলাই ২৪, ২০২০

পেটে ডিমওয়ালা মাছ কিনবে না ডিম ছাড়া এ নিয়ে ছেলেবেলা থেকেই বাবা-মায়ের ঝগড়া দেখেছে লাবণী। বাবা বাজারে যাওয়ার সময় মা তার হাতে থলেটা ধরিয়ে দিয়ে বলতেন, দেখে শুনে ভালো ইলিশ এনো, পেটভরা যেন ডিম থাকে।

: আরে না, ডিম ছাড়া আনব। মাছে ডিম হলে স্বাদ থাকে না। 
: তুমি কচু জানো!
: আর তুমি তো সবজান্তা!
বাজার থেকে মাছ আসত। যেদিন মাছে ডিম থাকত মা মহাখুশি। মাছের ডিম ভেজে বা রেঁধে সবাইকে সমান টুকরো করে দিতেন। তখন বাবার মুখেও হাসি ফুটত। পরম তৃপ্তিভরে খেতে খেতে বলতেন, পেটে ডিম থাকলেও মাছটা ভালো।
: হু, গরিবের কথা বাসি হলে ফলে।
: তুমি আবার গরিব কোথায়! আমার ট্রেজারির সব মালামাল তো তোমার দখলে। চেয়ে চিন্তে খড়কুটো পাই।
মা-বাবার এমন মজার খুঁনসুটিও শুনত লাবণী। ওর খুব ভালো লাগত। ওর বাবা-মায়ের এত মিল! অনেক বাবা-মায়ের নাকি মিল থাকে না। তাদের ছেলেমেয়ের খুব কষ্ট। বাড়িতে এত এত মাছওয়ালা ডিম আসত, কিন্তু মাকে খেতে দেখত না লাবণী। বাবা মাকে বারবার বলতেন, আমাদের সঙ্গে খেতে বসো। মা বলতেন, বসলে তোমাদের তুলে দেবে কে! বাবা বিরক্তির সঙ্গে বলতেন, এত তুলে দেওয়ার কী আছে, সবই তো টেবিলে। যে যার মতো তুলে নেবে। মা হেসে বলতেন, আমার সন্তানদের আমি চিনি। তুলে না দিলে কিচ্ছু নেবে না। ওই প্রথম পাতে যতটুকু তুলবে অতটুকু খেয়েই উঠে পড়বে। পেটে ক্ষিদে থাকবে। তোমাকেও চিনি। তুলে না খাওয়ালে আমার তৃপ্তি হয় না।
পেটভরা ইলিশ যেদিন এল সেদিনও সবার পরে খেতে বসেছিলেন মা। লাবণী মায়ের পাতে ডিম না দেখে বলেছিল, মা, মাছের ডিম কোথায়?
মা থতমত খেয়ে বলেছিলেন, তুই এখন এখানে কী করছিস? যা একটু ঘুমিয়ে নে।
: মা তোমার ডিম কোথায়?
: না মানে...।
: মানে তোমার ডিমের টুকরোটা তুমি আমাদের খাইয়ে দিয়েছ। কেন মা? আমাদের খারাপ লাগে না! তুমি যদি এমন করো আমি কিন্তু আর কখনও মাছের ডিম খাব না।
: এই শোন শোন, রাগ করিস না।
ডিমওয়ালা মাছ মায়ের চাই। আব্বা যেদিন পুঁটি বা বেলে মাছ কিনতে যেতেন সেদিনও মা বলতেন, পেটে ডিমভরা বড় দেখে মাছ এনো। যেন সতেজ হয়।
: ডিমঅলা মাছ কখনও তাজা আর সরেস হয়। আর বেলে পুঁটি তাতেও তোমার ডিম লাগবে। ওতো আর সবার পাতে দিতে পারবে না।
: আনতে বলছি এনো, কী পারব, না পারব সে আমি জানি।

দুই.
মা চলে গেছেন। বাবা গেছেন তারও আগে। শেষ কয়েকটা বছর মা বড় মুষড়ে পড়েছিলেন। বাবা তার শুধু স্বামী ছিলেন না, বন্ধুও ছিল। এদেশে স্বামীরা খুব কম ক্ষেত্রে বন্ধু হতে পারে। লাবণীর বাবা মায়ের বন্ধু হতে পেরেছিলেন।
ভাইরা বড় হচ্ছিল। ওরাই বাজার করত। মা আগের মতোই রাঁধতেন। ভাইদের ডিমঅলা ইলিশ, পুঁটি, বেলে কিনতে বলতে হত না। ওরা সবাই জানে কেমন মাছ মায়ের পছন্দ। আর ওরাও তো ছেলেবেলা থেকে মাছের ডিমের টুকরো খেয়ে অভ্যস্ত। মা রাঁধতেন, সবাইকে সমান টুকরো করে দিতেন। লাবণী সামনে থাকলে খুবই অনিচ্ছাসত্ত্বে সবচেয়ে ছোট টুকরোটা নিতেন। এই মেয়েটা বড্ড জেদি। না নিলে, না খেয়ে উঠে পড়বে। লাবণী মনে মনে হাসত।
মাও একদিন চলে গেলেন। ভাই দুটো দুই দেশে ছড়িয়ে পড়ল। লাবণীর নিজের সংসার হল। স্বামী চলে গেল রোড এক্সিডেন্টে। অফিস-বাড়ি সামলিয়ে লাবণী নাজেহাল। ছেলেমেয়ে দুটো বিবেচক। বোঝে মার কষ্ট হয়। তাই বুয়া যা রাঁধে তাই খেয়ে উঠে যায়। তবে যেদিন লাবণী রাঁধে সেদিন ওদের চোখে মুখে ভেসে ওঠে উজ্জ্বল দ্যুতি। দু’গাল ভাত ওরা বেশি খায়। তাই লাবণী চেষ্টা করে মাঝে মাঝে রাঁধতে। ছেলেমেয়ে আজকালকার আর দশটা ছেলেমেয়ের মতোই। মাছ মোটেও পছন্দ করে না। চিকেন বেবি। এ নিয়ে লাবণীর বড় কষ্ট মনে। পৃথিবীতে যে কত রকম কত মজাদার স্বাদের রান্না আছে ওরা বুঝল না। এঁচড় দিয়ে চিংড়ি, কই ভাঁপা, মাছের কাঁটাকুটি দিয়ে পুঁই এমন কত কিছু। এসব শুনলেই আঁতকে ওঠে ওরা। তবে মাছের ডিম ভেজে বা ভুনা করে দিলে তৃপ্তিভরে খায়। লাবণীর মনে পড়ে ছেলেবেলার সেই অনিন্দ্য সুন্দর দিনগুলোর কথা। মনে পড়ে মায়ের মুখ। এ বাড়িতে লাবণীর জন্যই মাছ রান্না হয়। যখন যে মাছ হাতের কাছে পায় তা-ই রাঁধে। মাছ খেতে বসে মাঝে মাঝেই কই, পুঁটি, বেলে মাছের পেটে ডিম পায়। একদিন ও ডিমগুলো বের করে, ভাবে। তারপর দু’ভাগ করে দুই ছেলেমেয়ের ঘরে যায়। মেয়েকে বলে, হা কর, হা কর।
: কেন?
: হা কর না।
ডিমের অর্ধেকটা চালান করে দেয় মেয়ের মুখে। মেয়ে প্রথমে খানিকটা দ্বিধা খানিকটা সংশয়ে চিবায়। না জানি কেমন স্বাদের জিনিস খেতে দিয়েছে মা। চিবিয়ে ওর মুখে হাসি ফোটে। মায়ের দিকে চেয়ে বলে, তুমি খেয়েছ, না সবটুকু দিলে?
: আরে না, খেয়েদেয়ে পেট পুরে বাড়তিটুকু দিতে এলাম।
মা মেয়ে দুজনেই হেসে ওঠে এই অসাধারণ কৌতুকে।
ছেলের মুখে ডিম দিতে গিয়েও একই ঘটনা ঘটে। ছেলেও তৃপ্তি ভরে খায়। তারপর থেকে এই চলছে। খাবারের পাত থেকে উঠে মা ঘরে এলেই ছেলেমেয়ে বুঝতে পারে মা মাছের ডিম খাওয়াতে এসেছে। ওদের বলতে হয় না। হা করে। আর লাবণীও ডিম খাইয়ে আনন্দে ছলছল চোখে ডিমবিহীন মাছটুকু খায়। ঠিক এমনই করতেন তার মা। আহা মা!
আজও খেতে বসেছে লাবণী। বড় বড় পুঁটি মাছ রেঁধেছে সে। মাছের পেটভরা ডিম। ও ডিম দু’ভাগ করে। মেয়ের ঘরের দিকে যেতে যেতে থমকে দাঁড়ায়। এ ডিম মেয়েকে খাওয়ানো উচিত হবে না। মাছ রান্না হয়েছে উত্তপ্ত তাপে। ভাইরাস নেই। কিন্তু লাবণী তো হাত দিয়ে মেয়ের মুখে, ছেলের মুখে ডিম তুলে দেয়। উচিত হবে কী! না থাক। করোনা যাক।

 
Electronic Paper