সুকান্তের কবিতায় সুসময়ের অঙ্গীকার
আব্দুল্লাহ আল মাছুম
🕐 ১২:১৩ অপরাহ্ণ, জুন ২৬, ২০২০
যুদ্ধজয়ী বীরের তৃপ্তি অত্যন্ত মৌলিক। এর সঙ্গে জগতের কোনো কিছুরই তুলনা চলে না। যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলে বীরের রক্তে আগুন জ্বলে ওঠে। সে ঘরে বসে থাকতে পারে না। এই যে যাতনা- ঠিক এমন অনুভূতিই হয় প্রাথমিকভাবে সুকান্তের কবিতা পাঠে। যুদ্ধের মাঝামাঝি সহযোদ্ধাদের লাশের পাহাড় ঢেকে যায়।
বীর নিজেও ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। তখন চারপাশের বীভৎসতা বীরের দর্শনে দ্বান্দ্বিক মেরুকরণ করার প্রয়াস পায়। কিন্তু বীর স্বীয় জীবনের মায়া সত্ত্বেও যুদ্ধের ময়দান ত্যাগ করতে পারে না। কীসে বীরকে পালাতে রুদ্ধ করল? সেই প্রশ্নের উত্তর মেলে সুকান্তের কবিতায়। সুকান্তের কবিতা পাঠে পাঠক যেমনি রাতের আঁধারে সংকল্প বাঁধে তেমনি দুর্দিনে আত্মবিশ্বাস খুঁজে পায়। সুকান্তের কবিতার প্রথম কয়েক ছত্রে দাবি ও প্রতিবাদ জোরাল হয়।
অসাম্যকে পদদলিত করার অভিপ্রায়ে পাঠক ক্ষিপ্ত হয়। কিন্তু জয়-পরাজয়ের অনিশ্চয়তা নিয়ে অসাম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মনোবল ধরে রাখা দুষ্কর। এই মনোবল চাঙ্গা করতে পাঠককে অন্য কবির দ্বারস্থ হতে হয় না। প্রতিটি লেখার শেষেই মেলে বিজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী। যেমনি ছাড়পত্র কাব্যগ্রন্থের ‘চট্টগ্রাম : ১৯৪৩’ কবিতায় আত্মবিশ্বাসী সুকান্ত লিখেছেন, ‘তোমার সংকল্পস্রোতে ভেসে যাবে লোহার গরাদ, এ তোমার নিশ্চিত বিশ্বাস।’
সুকান্ত ভট্টাচার্য বাংলা ১৩৩৩ সালের ৩০ শ্রাবণ (১৫ আগষ্ট, ১৯২৬) জন্মগ্রহণ করেন। দেশচেতনা ও বিশ্বচেতনায় অনন্য হয়ে ওঠা কবি মাত্র ২১ বছর ধরার আলো-বাতাস গ্রহণ করেছেন। ১৩৫৪ সালের বৈশাখ মাসের ২৯ তারিখ (১৩ মে, ১৯৪৭) জীবনপ্রদীপ নিভে যায়। সাহিত্যচর্চার এই স্বল্প সময়ে কবির শব্দ চয়ন, আদর্শবোধ, সাম্যবাদের জয়ধ্বনি সমকালীন কবিদেরও বিস্মিত করে। সুকান্তের বয়স যখন চৌদ্দ তখন সুভাষ মুখোপাধ্যায় সুকান্তের কবিতা সম্পর্কে অবহিত হন। সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘শুধু আমি কেন, আমার অন্যান্য বন্ধু, এমনকি বুদ্ধদেব বসুও কবিতার সেই খাতা পড়ে অবাক না হয়ে পারেননি।’
১৯৩৮ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল এই দশ বছরকে সুকান্তের কাব্যচর্চার কাল বলা যায়। সুকান্ত ১৯৩৭ সালে মা সুনীতি দেবীকে হারান। এরপর সুকান্ত একপ্রকারের স্বাধীনতা পেয়ে যান। যোগ দেন মাঠে ময়দানের রাজনীতিতে। এই সময়ে মায়ের মৃত্যুর বিষাদ, দেশের ভঙ্গুর অবস্থা, স্বাধীনতা লাভের স্পৃহা কবিকে অস্থির করে তোলে। সুকান্ত সেই দশ বছরের অবস্থাই লিখে গিয়েছেন। যেখানে কোনো রাখঢাক নেই। নিজেকে আড়াল করার বা উচ্চ করে তুলে ধরার ছলনা নেই। কবি যা দেখেছেন, যাতে কষ্ট পেয়েছেন, যা বিশ্বাস করেছেন, যে জীবনাদর্শনের স্বপ্ন দেখেছেন তাই লিখেছেন।
এর সুস্পষ্ট চিত্রায়ন দেখা যায় ১৯৪৩ সালে অরণি পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ক্ষুধা’, ‘দুর্বোধ্য’, সাপ্তাহিক জনযুদ্ধ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘দরদী কিশোর’, ‘কিশোরের স্বপ্ন’ গল্পে। সুকান্তের কবিতা কঠিন সময়ে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার সাহস জোগায়। পরাধীনতার বিরুদ্ধে বজ্রকণ্ঠ হওয়ার আহ্বান জানায়। সুকান্ত চেয়েছেন নিপীড়িত মানুষ সাহসী হয়ে উঠুক। একত্রিত হয়ে পুঁজিবাদী শোষণের অবসান ঘটাক। সুকান্ত ‘ঘুম নেই’ কাব্যগ্রন্থের ‘১লা মে-র কবিতা ৪৬’-এ এমন প্রত্যাশায় লিখেছেন, ‘শিকলের দাগ ঢেকে দিয়ে গজিয়ে উঠুক সিংহের কেশর প্রত্যেকের ঘাড়ে’।
সুকান্ত যদি বেঁচে থাকতেন তবে তার এমন আপসহীনতার ঘোষণা অব্যাহত থাকত কিনা বলা যায় না। তবে তিনি নিশ্চয়ই নতুন কোনো ধারার প্রতিষ্ঠা করতেন। কিশোর বয়সের কবিতাগুলোর জনপ্রিয়তা এরই ইঙ্গিত দেয়। সুকান্ত পরবর্তী বহু কবি সুকান্তর ধারা অনুসরণ করেছেন।
এদের মধ্যে শামসুর রাহমান, মোহাম্মদ রফিক, পবিত্র মুখোপাধ্যায়, অমিত গুপ্তসহ বহুজনের নাম বলা যায়। কিন্তু সাম্যবাদের কথা সুকান্ত’র বলার ভঙ্গিমাতেই এখনো সবচেয়ে শ্রুতিমধুর।
কবি, লেখকদের পাশাপাশি সুকান্তকে জানে না এমন মানুষও তার কবিতার পঙ্তি সাহসের আবহে উচ্চারণ করেন। সভা-সমাবেশ, দাবি আদায়ের মঞ্চে কর্মীদের উজ্জীবিত করতে সুকান্ত’র কবিতা আবৃত্তি করা হয়। তরুণ প্রজন্মের কাছে সুকান্ত এখনো জনপ্রিয় কবিদের শীর্ষে।
প্রতিজ্ঞা ও আত্মবিশ্বাসের পাঠে পাঠক ক্ষণে ক্ষণেই সুকান্তকে স্মরণ করে। বর্তমান বিশ্ব ও দেশের সংকটকালে তাই সুকান্তর কবিতা হতে পারে শক্তির আধেয়। কবি যেন নিজেই ‘বিবৃতি’ কবিতায় প্রার্থনা করছেন- ‘বিপন্ন পৃথ্বীর আজ শুনি শেষ মুহুর্মুহু ডাক/ আমাদের দৃপ্ত মুঠি আজ তার উত্তর পাঠাক।/ ফিরুক দুয়ার থেকে সন্ধানী মৃত্যুর পরোয়ানা,/ ব্যর্থ হোক কুচক্রান্ত, অবিরাম বিপক্ষের হানা।’