ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

‘সুসম্পাদিত ছোটকাগজ যুগপ্রবর্তক হতে পারে’

বীরেন মুখার্জী, সম্পাদক, দৃষ্টি

শফিক হাসান
🕐 ৭:৫০ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ৩০, ২০২০

লেখক সৃষ্টির আঁতুড়ঘর লিটল ম্যাগাজিন। নবীন লেখকদের অধিকাংশ হাত পাকান এখানে লিখে। সারা দেশে ব্যক্তি ও গোষ্ঠী উদ্যোগে প্রকাশিত হচ্ছে অসংখ্য লিটলম্যাগ। লিটলম্যাগচর্চার নানা প্রসঙ্গে কথা বলেছেন ‘দৃষ্টি’ সম্পাদক বীরেন মুখার্জী। সঙ্গে ছিলেন শফিক হাসান

দৃষ্টির প্রথম সংখ্যা কখন প্রকাশিত হয়
কবিতার প্রতি অকৃত্রিম টান আর নতুন স্বরের সন্ধানে ব্রতী হয়ে ১৯৯৪ সালে মাগুরা থেকে ব্রডশিটে প্রথম প্রকাশিত হয় ‘দৃষ্টি’। তখন নিজেদের মধ্যে অর্থাৎ সমমনাদের মধ্যে প্রচার সীমাবদ্ধ ছিল। কিছু কপি বিতরণ করা হয়েছিল স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মধ্যে। দ্বিতীয় সংখ্যা প্রকাশের সময় বেশ কিছু নতুন লেখা পেয়েছিলাম। এতে বোঝা যায়, ‘দৃষ্টি’ বোদ্ধামহলে কমবেশি আলোচনার জন্ম দিয়েছিল।

কোন লক্ষ্য থেকে সম্পাদনায় ব্রতী হয়েছেন সম্পাদনায় অর্জন কী
অনেকের অনেক উদ্দেশ্য থাকতে পারে। আমি মূলত কবি হতে চেয়েছি আর গতানুগতিক সাহিত্যচিন্তার বিপরীতে নতুন চিন্তা উসকে দিতে চেয়েছি। যেটা অনেক আগেই করেছিলেন তিরিশের কবিরা। এরপর সাহিত্যে নানান মতবাদের উদ্ভব ঘটছে, দেশের কবিরা সেটা গ্রহণ করে এগিয়ে গেছেন অথচ মাগুরার সাহিত্যচর্চা তখনও মান্ধাতা আমলের। তরুণদের নতুন চিন্তাযুক্ত লেখা গ্রহণ করার মানসিকতা ছিল না মাগুরার প্রবীণ সাহিত্যকর্মীদের মধ্যে, উপরন্তু ছিল অবহেলা। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমরা কয়েকজন মিলে ‘দৃষ্টি’ প্রকাশ করি। আমাদের নির্দিষ্ট কিছু ইশতেহারও ছিল। বলা যায় আত্মসুখে এক ধরনের পাগলামি। বৈশ্বিক দুনিয়া থেকে নিজেকে পৃথক রাখতে পারা একটি বড় অর্জন। তবে কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা সঞ্চয়, লেখকদের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি শত্রুও বেড়েছে। তবে সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলার মত সৎ সাহসও অর্জিত হয়েছে সম্পাদনার মধ্য দিয়ে।

বর্তমানে লিটলম্যাগচর্চা কেমন হচ্ছে আপনার দৃষ্টিতে উল্লেখযোগ্য ম্যাগ কোনগুলো
এখনকার লিটলম্যাগ আগের অবস্থান থেকে অনেকটাই সরে এসেছে। প্রবল প্রাপ্তির প্রবণতা শিল্পের প্রতি দায়বদ্ধতায় জায়গাটি আলগা করে দিয়েছে। যে কারণে নতুন স্বপ্ন নির্মাণের পথে, সামাজিক অবক্ষয় থেকে উত্তরণে তেমন কোনো আন্দোলন নেই। ছোট কাগজের মূল দায়িত্বÑ নতুন লেখকের পরিচয় করিয়ে দেওয়া, তার বিকাশের পথ খুলে দেওয়া, সর্বোপরি প্রকৃত সাহিত্যের পরিচর্যা করা। সঙ্গে পরস্পরের ভাবনা বিনিময়ের সেতুবন্ধ তৈরি করা। সৎ-সমালোচনার ধারা তৈরিতে ছোট কাগজই বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু বর্তমানে যা হচ্ছে তা একে অপরের পিঠ চুলকানো বলা যায়। প্রতিবছর লিটলম্যাগের নামে অনেক পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে এটা যেমন সত্য, তেমনি সত্য মানতে হবে, এগুলো সংকলন ছাড়া কিছু নয়। বেশিরভাগই মানহীন, বাজারি সাহিত্য। এতে সম্পাদকের নিষ্ঠা, দায়িত্বশীলতা অনুপস্থিত।
উল্লেখযোগ্য লিটলম্যাগÑ মাহমুদ কামাল সম্পাদিত ‘অরণি’, ফারুক সিদ্দিকী সম্পাদিত ‘বিপ্রতীক’, আন্ওয়ার আহমদ সম্পাদিত ‘কিছুধ্বনি’ ও ‘রূপম’, খোন্দকার আশরাফ হোসেন সম্পাদিত ‘একবিংশ’, অরুণাভ সরকার সম্পাদিত ‘ঈষিকা’, সালাম সালেহ উদদীন সম্পাদিত ‘অরুন্ধতী’, হেনরী স্বপন সম্পাদিত ‘জীবনানন্দ’, রহমান হেনরী সম্পাদিত ‘পোয়েট্রি’, ওবায়েদ আকাশ সম্পাদিত ‘শালুক’, শহীদ ইকবাল সম্পাদিত ‘চিহ্ন’, শাকেরউল্লাহ সম্পাদিত ‘ঊষালোকে’, আযাদ নোমান সম্পাদিত ‘চর্যাপদ’, চন্দন চৌধুরী সম্পাদিত ‘বেহুলাবাংলা’, আমিনুর রহমান সুলতান সম্পাদিত ‘অমিত্রাক্ষর’, আবদুল মান্নান স্বপন সম্পাদিত ‘ধমনি’, এজাজ ইউসুফী সম্পাদিত ‘লিরিক’, মনজু রহমান সম্পাদিত ‘টোঙ’, শিকদার ওয়ালিউজ্জামান সম্পাদিত ‘সপ্তক’, রিসি দলাই সম্পাদিত ‘চারবাক’ ও ‘সরলরেখা’, কামরুল হুদা পথিক সম্পাদিত ‘দ্রষ্টব্য’, পুলক হাসান সম্পাদিত ‘খেয়া’ ইত্যাদি।

লেখক সৃষ্টিতে লিটলম্যাগের ভূমিকা কতটুকু
লিটলম্যাগকে লেখক তৈরির সূতিকাগার বলা হয় এ কারণে, সম্পাদক সবসময় অগ্রসর চিন্তা লালন করেন এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন চিন্তা বিশ্বে নিজেকে মিলিয়ে নেন। একজন লেখকের বিকশিত হওয়ার আগে প্রয়োজন আত্মপ্রকাশের যথাযথ প্লাটফর্ম। লিটলম্যাগ নতুন লেখকের প্লাটফর্ম, যার মাধ্যমে নতুন লেখকের লেখা যথাযথ পরিচর্যা ও সম্পাদনার মাধ্যমে পাঠকের সামনে উপস্থাপিত হয়। লিটলম্যাগের প্রধান প্রতিকূলতা অর্থসংকট; যথাযথ লেখা না পাওয়া। লেখক কিংবা সাহিত্যনুরাগী কেউই লিটলম্যাগের পৃষ্ঠপোষকতা করতে চান না। এ সংকট দিনদিন আরো প্রকট হচ্ছে।

কী বৈশিষ্ট্যে লিটলম্যাগ ও সাহিত্যপত্রিকাকে আলাদা করবেন
লিটলম্যাগের নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যা সাহিত্যপত্রিকার মধ্যে অনুপস্থিত। আমি মনে করি, প্রথাগত রীতির বিপরীতে মৌলিক, যৌক্তিক ও নতুন চেতনার উদ্বোধন, শিল্পমান অক্ষুণœ রেখে সাহিত্যের বিভিন্ন প্রকরণের নিরীক্ষাকে প্রণোদিত করা, সত্য, সুন্দর ও শিল্পের প্রশ্নে আপসহীন থাকা, চাতুর্য ও ভাবালুতার বিপরীতে প্রজ্ঞা ও মনীষার পথে পরিভ্রমণ করা, হঠাৎ চিন্তার ঝলকানি নয়; ঐতিহ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ চিন্তা ও মননের পরিচর্যা, যেকোনো ধরনের সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তির বিরুদ্ধে অবস্থান, গোষ্ঠীপ্রীতি ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের বিপরীতে ঔদার্যের স্বাক্ষর থাকা, অপরিচিতকে পরিচিত এবং নতুনের আত্মপ্রতিষ্ঠার পথ সুগম করে দেওয়া, লেখক নয়, লেখার পরিচর্যা করাÑ এসব বৈশিষ্ট্য থেকেই লিটলম্যাগ এবং সাহিত্যপত্রিকা পৃথক করা যেতে পারে।

দৃষ্টিতে কী ধরনের লেখা প্রাধান্য পায়
নতুন চিন্তা সম্বলিত লেখাকে প্রাধান্য দিয়ে থাকি। বিশ্লেষণী ক্ষমতাসম্পন্ন তরুণদের লেখা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করি। ভবিষ্যতে একটি লিটলম্যাগ প্রকাশের ইচ্ছে আছে, যেটি হবে সম্পূর্ণ সমালোচনাভিত্তিক। অনেকেই যখন প্রচলতার স্রোতে গা ভাসিয়ে দেন তখন নতুন বলয় উন্মোচনের প্রয়োজন হয়ে ওঠে। এমন বাস্তবতায় চিন্তার পার্থক্য প্রকাশে লিটলম্যাগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। সাহিত্যচর্চার এই ভিন্ন প্লাটফর্ম কখনোই নিঃশেষ হবে না।

কোনো কোনো লিটলম্যাগ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান হিসেবেও দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। এটাকে কীভাবে দেখেন
ইতিবাচক বিবেচনা করি। প্রতিষ্ঠিত প্রকাশকরা যখন নতুন লেখকের বই প্রকাশে অনীহা প্রকাশ করেন, অর্থ দাবি করেন তখন সমমনারা নিজেদের নতুন চিন্তা সংবলিত লেখা এভাবে প্রকাশ করেন। এর মাধ্যমে চিন্তা বিশ্বে নতুন চিন্তার উন্মোচন ঘটতে পারে। তবে এর মাধ্যমে আবর্জনা যাতে না বাড়ে সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি।

প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা করে কোনো কোনো লিটলম্যাগের জন্ম হয়েছে। দৃষ্টির অবস্থান কী
প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা ভিন্ন একটি প্রপঞ্চ। এখানে প্রতিষ্ঠান বলতে মূলত প্রচল চিন্তা লালনকারী প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশ করে। ঘুণে ধরা নিয়ম-কানুনকে নির্দেশ করে। এই প্রতিষ্ঠান মূলত রাষ্ট্র। লিটলম্যাগের চরিত্রের সঙ্গে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা ওতপ্রোত। আমার লিটলম্যাগের অবস্থানও এর বাইরে নয়। ব্যক্তিগতভাবে প্রতিষ্ঠানবিরোধী নই, আবার প্রতিষ্ঠানের মধ্যে নিজেকে সমর্পণ করতেও রাজি নই।

ছোট কাগজের সঙ্গে বাণিজ্যিক কাগজের কী ধরনের পার্থক্য থাকা জরুরি
বাণিজ্যিক কাগজ বিজ্ঞাপননির্ভর; এটি বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষার নিমিত্তে প্রকাশ করা হয়। এখানে প্রতিষ্ঠিত লেখকের গতানুগতিক লেখা প্রকাশিত হয়। বাণিজ্যিক কাগজ গণরুচির উপাচারের জোগান দেয়। বিপরীতে ছোট কাগজ নতুন চিন্তার উন্মেষ ঘটায়। এর পাঠকসংখ্যাও সীমিত। এখানে প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ লেখকদের লেখা যথাযথ সম্পাদনার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। আমি মনে করি, সুসম্পাদিত হলে একটি ছোট কাগজ নতুন যুগের প্রবর্তক হয়ে উঠতে পারে। ছোট কাগজ প্রথাগত রীতির বিপরীতে মৌলিক, যৌক্তিক ও নতুন চেতনার উদ্বোধন ঘটায়, শিল্পমান অক্ষুণœ রেখে সাহিত্যের বিভিন্ন প্রকরণের নিরীক্ষাকে প্রণোদিত করে, চাতুর্য ও ভাবালুতার বিপরীতে প্রজ্ঞা ও মনীষার পথে পরিভ্রমণ করে, ঐতিহ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ চিন্তা ও মননের পরিচর্যা করে। বাণিজ্যিক কাগজে এসব অনুপস্থিত।

দৃষ্টির বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কোন সংখ্যাটি, কেন
প্রকাশনার ২৫ বছরে ‘দৃষ্টি’র ১৯টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিটি সংখ্যা কোনো না কোনোভাবে গুরুত্বপূর্ণ তবে, ‘বাংলা কবিতায় ঐতিহ্য’, ‘স্বাধীনতা উত্তর ছোটগল্প’, ‘নব্বইয়ের নির্বাচিত কবিতা’, ‘সৈয়দ শামসুল হক’ এবং ‘সাম্প্রতিক কবিতা’ সংখ্যা এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
আমার মনে হয় না প্রযুক্তির প্রসারে লিটলম্যাগ আন্দোলন সংকুচিত হচ্ছে। বরং বলা যেতে পারে, প্রযুক্তির কল্যাণে একই মনোভাবের ওয়েবম্যাগ এক্ষেত্রে আরো ভূমিকা রাখতে পারছে। তবে প্রযুক্তির মন্দ দিকটি অবশ্যই বর্জন করতে হবে। লিটলম্যাগ যেহেতু নতুন কিছু বলতে চায়, সুতরাং একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীই এর লেখক ও পাঠক। এ সত্ত্বেও গোষ্ঠীপ্রীতি এবং গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের বিপরীতে ঔদার্যেও স্বাক্ষর রাখে। পরশ্রীকাতর, ক্রোধোন্মত্ত হয়ে ওঠা এবং বিভিন্ন ধরনের চাতুর্য প্রদর্শনের গোষ্ঠীবদ্ধতাকে সমর্থন করি না।

দুই বাংলার লিটলম্যাগচর্চায় মৌলিক কোনো পার্থক্য দেখতে পান
স্থান-কাল-পাত্রভেদে সাহিত্যের রুচি পরিবর্তিত হয়। এছাড়া ভাষা এবং রাজনৈতিক উপযোগও এক্ষেত্রে পার্থক্য নিরূপণ করে। আপাতদৃষ্টিতে আকারে-প্রকারে তেমন পার্থক্য নেই। তবে, তাদের যাপন এবং জীবনের প্রতিচ্ছবি আমাদের মতো নয়। ভাষাগত পার্থক্যও রয়েছে।

 
Electronic Paper