ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ডেভিড ফ্রস্ট প্রোগ্রাম ইন বাংলাদেশ

ডেস্ক রিপোর্ট
🕐 ৫:৪২ অপরাহ্ণ, আগস্ট ০৭, ২০১৮

পাকিস্তান থেকে মুক্তি পেয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বিদেশি সাংবাদিক হিসেবে সম্ভবত প্রথম বঙ্গবন্ধুর একান্ত সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন বিবিসির তৎকালীন সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট। ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি নিউইয়র্ক টেলিভিশনের ‘ডেভিড ফ্রস্ট প্রোগ্রাম ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে সাক্ষাৎকারটি প্রচারিত হয়। খোলা কাগজের পাঠকদের জন্য আজ প্রকাশিত হলো সাক্ষাৎকারটির তৃতীয় পর্ব-

ডেভিড ফ্রস্ট : আপনি নিজের চোখে তাই দেখলেন?
শেখ মুজিবুর রহমান : হ্যাঁ, আমি আমার নিজের চোখে দেখলাম ওরা কবর খুঁড়ছে। আমি আপন মনে বললাম এ কবর আমার কবর। ঠিক আছে। কোনো পরোয়া নেই। আমি তৈরি আছি।

ডেভিড ফ্রস্ট : এমনি অবস্থায় আপনার কেমন করে কাটতো? আপনি কি প্রার্থনা করতেন।
শেখ মুজিবুর রহমান : এমন অবস্থায় আমার নির্ভর ছিল আমার বিশ্বাস, আমার জাতি, আমার পৌনে আট কোটি মানুষের প্রতি আমার বিশ্বাস। তারা আমায় ভালোবেসেছে ভাইয়ের মতো, পিতার মতো। আমাকে তাদের নেতা বানিয়েছে।

ডেভিড ফ্রস্ট : আপনি যখন দেখলেন, ওরা কবর খনন করেছে, তখন আপনার মনে কার কথা আগে জাগল? আপনার দেশের কথা? না, আপনার স্ত্রী-পুত্র পরিজনের কথা?
শেখ মুজিবুর রহমান : আমার প্রথম চিন্তা আমার দেশের জন্য। আমার যা কিছু সুখ-দুঃখ, সে তো আমার দেশেরই জন্য। আপনি তো দেখেছেন, আমাকে তারা কি গভীরভাবে ভালোবাসে।

ডেভিড ফ্রস্ট : হ্যাঁ, এ কথা আমি বুঝি। স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধরত বাংলাদেশের আপনি নেতা। আপনার প্রথম চিন্তা অবশ্যই আপনার দেশের চিন্তা। পারিবারিক চিন্তা পরের চিন্তা।
শেখ মুজিবুর রহমান : হ্যাঁ, জনতার প্রতিই আমার প্রথম ভালোবাসা। আমি তো জানি, আমি অমর নই। আজ, কিংবা কাল, কিংবা পরশু আমাকে মরতেই হবে। মানুষ মাত্রই মরতে হয়। কাজেই আমার বিশ্বাস, মানুষ মৃত্যুবরণ করবে সাহসের সঙ্গে।

ডেভিড ফ্রস্ট : কিন্তু ওরা তো আপনাকে কবর দিতে পারেনি। কে আপনাকে রক্ষা করেছিল সেদিন আপনার ভবিষ্যৎ থেকে।
শেখ মুজিবুর রহমান : আমার বিশ্বাস সর্বশক্তিমান আল্লাহই আমাকে রক্ষা করেছেন।

ডেভিড ফ্রস্ট : আমি একটা বিবরণে দেখলাম, আপনাকে নাকি জেলার এক সময়ে সরিয়ে রেখেছিল। ইয়াহিয়া খান যখন আপনাকে হত্যা করার উদ্যোগ নিয়েছিল, তখন আপনাকে স্থানান্তরে নিয়ে গিয়েছিল। একি যথার্থ?
শেখ মুজিবুর রহমান : ওরা জেলাখানায় একটা অবস্থা তৈরি করেছিল, মনে হচ্ছিল কতগুলো কয়েদিকে ওরা সংগঠিত করেছিল। যেন সকালের দিকে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ওরা আমাকে হত্যা করে ফেলতে পারে। আমার মনে হয়, আমাকে তত্ত্বাবধানের ভার যে অফিসারের ওপর পড়েছিল, আমার প্রতি তার কিছুটা সহানুভূতি জেগেছিল। হয়তো বা সে অফিসার এমনও বুঝতে পেরেছিল যে, ইয়াহিয়া খানের দিন শেষ হয়ে আসছে। আমি দেখলাম, হঠাৎ রাত ৩টার সময়ে সে এসে আমাকে সেল থেকে সরিয়ে নিয়ে তার নিজের বাংলাতে দুদিন যাবৎ রক্ষা করল। এ দুদিন আমার ওপর কোনো সামরিক পাহারা ছিল না। দুদিন পরেই এ অফিসার আমাকে আবার একটা আবাসিক কলোনির নির্জন এলাকায় সরিয়ে নিল। সেখানে আমাকে হয়তো চার-পাঁচ কিংবা ছয় দিন রাখা হয়েছিল। এ সময়টাতে আমার অবস্থান সম্পর্কে নিম্নপদস্থ কিছু অফিসার ছাড়া আর কেউ জ্ঞাত ছিল না।

ডেভিড ফ্রস্ট : এ তাদের সাহসেরই কাজ। এখন তাদের কী হয়েছে, তাই ভাবছি।
শেখ মুজিবুর রহমান : আমিও জানি না। ওদের জন্য যথার্থ শুভ কামনা রয়েছে। এমন কি শেষ মুহূর্তে ইয়াহিয়া খান যখন ভুট্টোর হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়, তখন ইয়াহিয়া বলেছিল, মিস্টার ভুট্টো, আমার জীবনের সবচাইতে বড় ভুল হচ্ছে, শেখ মুজিবুর রহমানকে ফাঁসি না দেওয়া।
ডেভিড ফ্রস্ট : ইয়াহিয়া এমন কথা বলেছিল?
শেখ মুজিবুর রহমান : হ্যাঁ, ভুট্টো এ কথা আমায় বলে, তার পরে বলেছিল, ইয়াহিয়ার দাবি ছিল, ক্ষমতা হস্তান্তরের পূর্বে সে পেছনের তারিখ দিয়ে আমাকে ফাঁসি দেবে। কিন্তু ভুট্টো আর এ প্রস্তাবে রাজি হয়নি।

ডেভিড ফ্রস্ট : ভুট্টো কী জবাব দিয়েছিল? তার জবাবের কথা কি ভুট্টো আপনাকে কিছু বলেছিল?
শেখ মুজিবুর রহমান : হ্যাঁ, বলেছিল।

ডেভিড ফ্রস্ট : কী বলেছিল ভুট্টো?
শেখ মুজিবুর রহমান : ভুট্টো ইয়াহিয়াকে বলেছিল ‘না, আমি তা হতে দিতে পারি না। তাহলে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া ঘটবে। বাংলাদেশে এখন আমাদের এক লাখ তিন হাজার সামরিক লোক বাংলাদেশ আর ভারতীয় বাহিনীর হাতে বন্দি রয়েছে। তা ছাড়া পাঁচ থেকে ১০ লাখ অবাঙালি বাংলাদেশে আছে। মিস্টার ইয়াহিয়া, এমন অবস্থায় আপনি যদি শেখ মুজিবকে হত্যা করেন আর আমি ক্ষমতা গ্রহণ করি, তাহলে একটা লোকও আর জীবিত অবস্থায় বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে ফেরত আসতে সক্ষম হবে না। আর প্রতিক্রিয়া পশ্চিম পাকিস্তানেও ঘটবে। তখন আমার অবস্থা হবে সংকটজনক।’ ভুট্টো একথা আমাকে বলেছিল।

ডেভিড ফ্রস্ট : শেখ সাহেব, আজ যদি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আপনার সাক্ষাৎ ঘটে, আপনি তাহলে তাকে কী বলবেন?
শেখ মুজিবুর রহমান : ইয়াহিয়া খান একটা জঘন্য খুনি। তার ছবি দেখতেও আমি রাজি নই। তার বর্বর ফৌজ দিয়ে সে আমার ৩০ লাখ বাঙালিকে  হত্যা করেছে।     
(চলবে)

 
Electronic Paper