ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

সেই পথ লক্ষ্য করে

মতিয়া চৌধুরী
🕐 ৫:৫০ অপরাহ্ণ, আগস্ট ০৫, ২০১৮

পনেরোই আগস্ট। চেতনা স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার দিন। প্রগতির চাকা পিছিয়ে দেওয়ার দিন। ইতিহাস থমকে দাঁড়াবার দিন।
কেন এই নির্মম-নিষ্ঠুর হত্যা? খুনিরা এবং তাদের জাতীয় আন্তর্জাতিক দোসররা যত কথাই বলুক না কেন বিগত সময়ের ঘটনাবলি দ্বারা একথা স্পষ্টভাবে প্রমাণ হয়েছে যে বাংলার দুঃখী মানুষের মুক্তির পথ রচনা করতে গিয়েই বঙ্গবন্ধু প্রাণ দিয়েছেন। সেই পথ শতাব্দীর পশ্চাৎপদতার গ্লানিকে ঝেড়ে ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথ।

বায়ান্নোর রক্তাক্ত শরীর নিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের লড়াইয়ের যে ধারা সূচিত হয়, সে লড়াই ধাপে ধাপে বিকশিত হয়ে বাঙালি জাতির মুক্তির লড়াইয়ের রূপলাভ করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে। এই দীর্ঘ পথ-পরিক্রমায় বাঙালি জাতীয়তাবাদের আন্দোলন শুধু জাতিগত অধিকারের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকেনি। এই লড়াইয়ের। ভেতর দিয়েই বাংলার কৃষক শ্রমিক মেহনতি জনতার সার্বিক মুক্তির পথটি খুঁজে পেতে চেয়েছিল। তাই ঊনসত্তরের গণআন্দোলনে ছয় দফার পাশাপাশি উঠেছিল জাতীয়করণ, ভূমি সংস্কার, গণমুখী শিক্ষা ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার কর্মসূচি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে এই চেতনা আরও তীব্র ও স্পষ্ট হয়ে শোষণ মুক্তির আকাক্সক্ষায় রূপ নিল। এটাই স্বাভাবিক। কেননা আজকের দিনে মেহনতি জনতার সব লড়াই সচেতন অথবা অচেতনভাবে শোষণের নিগড়কে ভেঙে ফেলার লক্ষ্যে পরিচালিত।
স্বাধীন বাংলাদেশের বুকে জাতির জনক শেখ মুজিব এই সুদীর্ঘ সংগ্রামের চাহিদা ও জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে শুধু উপলব্ধিই করেননি, এই ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথও তিনি রচনা করেন। সদ্য স্বাধীনপ্রাপ্ত এই দেশে দুই শতকের শোষণ ও অনগ্রসরতার গ্লানি বয়ে আনা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পাল্টে দেওয়ার লক্ষ্যে তিনি সমাজতন্ত্রে উত্তরণের কর্মসূচি হাতে নিলেন। বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রে বিঘোষিত চার মূলনীতির অন্যতম নীতি হলো সমাজতন্ত্র। জাতীয়করণের আওতায় শুধু পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত কলকারখানা এলো না, ব্যাংক-বীমা ছাড়াও বড় শিল্পের শতকরা পঁচাশি ভাগই রাষ্ট্রায়ত্ত করে সমাজতন্ত্রের বুনিয়াদ রচনা করা হলো। শিল্পে পুঁজি বিনিয়োগ ও ভূমির সিলিং ঘোষণা করা হলো। ইজারাদারী প্রথা উচ্ছেদ হয়ে গেল। গণমুখী শিক্ষার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে এগারো হাজার প্রাইমারি স্কুলকে সরকারি আওতায় আনা হলো। এসব স্কুলের শিক্ষকরা সরকারি চাকুরে হিসেবে। গণ্য হলেন, তারা রেশনের সুবিধা পেলেন। ডা. কুদরত-এ-খুদার নেতৃত্বে শিক্ষা। কমিশন গঠন করে শিক্ষা সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হলো। জোতদারদের চাপে পরিবারের সংজ্ঞা বদলের ফলে জমির সিলিং বাস্তবে অকেজো হয়ে গেলেও পরবর্তীকালে বাকশালের কর্মসূচিতে বাধ্যতামূলক বহুমুখী সমবায়ের মাধ্যমে তিনি কৃষি উৎপাদন সম্পর্কের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করেন। পাশাপাশি ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ আমলে সৃষ্ট আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনের লৌহ কাঠামোকে ভেঙে ফেলে গণতন্ত্রীকরণের পদক্ষেপ নিলেন। স্বাধীন সক্রিয় জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি ঘোষিত হলো।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যদি চিরাচরিত সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু রাখতেন কিংবা খানিকটা ওপর প্রলেপ লাগিয়ে শোষকদের সঙ্গে একটা আপস রফার পথ বেছে নিতেন তাহলে হয়তো শত্রুরা এমন হিংস্র হয়ে তাকে আঘাত করতো না। কিন্তু তিনি তা করেননি। কেননা বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতাকে শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতা হিসেবে দেখেননি। তিনি এই স্বাধীনতাকে মেহনতি জনগণের কাছে অর্থবহ করে তুলতে চেয়েছিলেন। শোষণের উৎসমুখগুলোতে আঘাত না করে সে কাজ সম্ভব ছিল না। তাই তিনি দেশি-বিদেশি প্রতিক্রিয়ার চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন জনতার ওপর ভরসা করে। কেননা জনতার ভালোবাসাই ছিল। তার শক্তির উৎস। প্রাণের বিনিময়ে বঙ্গবন্ধু সেই আস্থা ও ভালোবাসার মর্যাদা রক্ষা করে গেছেন।
দুই
শোষণহীন সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু সামাজিক অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোর সমাধানের জন্য বাকশালের যে কর্মসূচি নিয়েছিলেন তা দেশের মৌলিক পরিবর্তন আনতে পারতো। কিন্তু পরিবর্তনের এই বাণী জনতার কাছে পৌঁছাবার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে স্বাধীনতা উত্তর যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতির সংকট, দুর্ভিক্ষ, অরাজকতার ফলে সৃষ্ট জনমনের হতাশা, নিষ্পৃহতা ও বিভ্রান্তিকে পুঁজি করে প্রতিক্রিয়াশীলরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে। আজ প্রগতির স্রোতধারা শুধু রুদ্ধ নয়, একে উল্টোদিকে প্রবাহিত করানো হচ্ছে। পাকিস্তানি আমলের দ্বি-জাতি তত্ত্বকে সুকৌশলে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের নামে চালানো হয়েছে। মাতৃভাষা বাংলা আজ আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনে দুয়োরানীর ম্লানমূর্তিতে উপস্থিত। আবহমানকালের বাঙালি সংস্কৃতিকে কলুষিত করে তোলার জন্য শিল্পসাহিত্যে অপসংস্কৃতির বেনোজল ঢুকানো হয়েছে। বিকৃত প্রমোদ উপকরণের মাধ্যমে জনতার প্রতিবাদী চেতনাকে আচ্ছন্ন ও বিবশ করে ফেলার চেষ্টা চলেছে। সংবিধান হতে ধর্মনিরপেক্ষতাকে কেটে বাদ দেওয়ার পাশাপাশি সাম্প্রদায়িকতাকে উসকানো হচ্ছে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে পুরনো বিতর্ক নতুন করে চাঙ্গা করে তোলা হয়েছে।
বিদ্রোহী কবি নজরুলকে নিয়ে সাম্প্রদায়িকতার কুৎসিত প্রতিযোগিতা চলেছে।
মুক্তিযোদ্ধারা জেলে পচছে। রাজাকার আলবদররা মন্ত্রিত্ব চালিয়েছে। পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের খেয়ে বাঁচার তহবিলে ডাকাতি হয়েছে। শহীদের রক্তে পূত, জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত বদলের দাবি উঠেছে।
সামরিক ফরমানকে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে গণতন্ত্রের সাদা পোশাক পরানো হয়েছে।
জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠের ঘোষণা পৃথিবী আজ দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। জালেম আর মজলুম জালেমের পাশে ধনতন্ত্রের মোড়ল সাম্রাজ্যবাদ, মজলুমের পক্ষে সমাজতন্ত্র আজ অনুপস্থিত। বাংলাদেশে সাম্রাজ্যবাদের হাঙ্গর-কুমিররা ঢুকেছে।
স্বনির্ভর অর্থনীতির বাগাড়ম্বরের আড়ালে আমরা বৈদেশিক ঋণের নাগপাশে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়েছি। পেট্রো ডলার আজ আর শুধু দক্ষ জনশক্তি নয় আমাদের মা-বোনদেরও প্রমোদের উপকরণ হিসেবে কিনে নিয়েছে।
এ অবস্থা চলতে পারে না, চলতে দেওয়া যায় না। জনগণ প্রতিকার চায়, প্রতিবাদের মিছিলে তাই শামিল হয়েছে। কিন্তু প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে পাঞ্জা ধরে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের ব্যূহ ভেদ করে জনতার মুক্তির মহাসড়কটি তৈরি করতে পারে এমন রাজনৈতিক নেতৃত্বই এখন প্রয়োজন কুম্ভ সমাজ প্রগতির ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার শক্তি ও মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যগুলোকে রক্ষা করার পক্ষের শক্তি এভাবেই ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়াতে হবে।
বঙ্গবন্ধু আজ আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু রয়ে গেছে তাঁর আদর্শ, তাঁর কর্মসূচি। আমরা বঙ্গবন্ধুকে ক্ষয়ে যাওয়া ইতিহাস হতে দেব না। তাঁর প্রদর্শিত পথে তাঁর। আদর্শকে অনুসরণ করে, ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রামে এগিয়ে যাব। শোষণমুক্ত সোনার। বাংলা কায়েম করে বঙ্গবন্ধুর ‘দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর স্বপ্ন সফল করবো।’
(সংক্ষেপিত)

 
Electronic Paper