ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

অপ্রত্যাশিত প্রণয়

উম্মে সুমাইয়া জাহান
🕐 ১১:২৪ পূর্বাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২০

সময়গুলো কেমন বেয়াড়া। একটা সময় ভালো গেলে ঠিক তার সময়টা বিপরীতভাবে মন্দ যায়। ২০০৯-এর মার্চ আসতে খুব একটা দেরি ছিল না। কত প্লান করে রেখেছিল সুহাসিনী। কিন্তু সবটা ভণ্ডুল হয়ে গেল সে বছরের বড়দিনের আগে। হিন্দু পরিবার হলেও ইন্ডিয়াতে ধুমসে বড়দিন পালিত হয়। সুহাসিনী ডিম, ময়দা, তেল, চিনি সব মিক্সড করে রেখেছিল। কেকটা ওর হাতে দারুণ হয়। কিন্তু যেখানে মন ভাঙা থাকে সেখানে কেকও ওভেনে ফেটে খানখান হয়ে যায় বোধহয়!

’৮ সালটা সুহাসিনীর খুব লাকি ইয়ার বলতেই হয়। পাঞ্জাবে লাভলী প্রফেশনাল ইউনিভার্সিটিতে অ্যাপ্লাই করাতে ৫০ শতাংশ স্কলারশিপে চান্স পেয়েছে। ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত বর্তমানে ইউনিভার্সিটিতে এ দেশে র‌্যাংকিংয়ে ৬ আর ওয়ার্ল্ড র‌্যাংকিংয়ে ৪৩১। সুহাসিনীর মনে আনন্দের সীমা নেই। কলকাতা থেকে পাঞ্জাব বেশ দূরে। ওর বাবা একটু আনমনা এ ব্যাপারে। ৮০ শতাংশ এ স্কলারশিপ পেলে ভর্তি করে দিত এমন কথা সুহাসিনীকে তার বাবা বলছে। সুহাসিনী কলকাতা ইম্পেরিয়াল কলেজেও পড়ার সুযোগ পেয়েছে। বিষয়টা নিয়ে তেমন মাথাব্যথা নেই। চান্স পেয়েছে ওখানে এটাই বড় কথা ওর কাছে আবার!

আমার মা বাবার আবার এক কথা আমাকে ডাক্তারি পড়াবে। ও, আমার পরিচয়টা দেওয়া হয়নি। আমি পরমা। সুহাসিনীর বান্ধবী। কলকাতা মেডিকেলে চান্স পেলাম না। বাংলাদেশের কুমিল্লাতে আমার মাসির বাড়িতে পাঠিয়ে দিল। সেখানে থেকে এমবিবিএস ভর্তি হতে পারলাম রাজশাহী মেডিকেল কলেজে। বাংলাদেশে যাওয়ার আগে সেবার সুহাসিনীর সঙ্গে দেখা করে এলাম।

দিনটি ছিল ২০০৮-এর ২৬ ডিসেম্বর। সুহাসিনী আমায় ফাটা কেক খেতে দিল। আর তার ভালবাসাও যে ফেটে গেছে, মনটা ভেঙে গেছে সে কথাও শোনাল। ওর কথা বলার ঢঙ দারুণ। অবাক না হয়ে পারা যায় না। খুব সাদামাটা কথা, এত চমৎকার বলে। কিন্তু আজ ও কথা বলার চেয়ে কাঁদছে বেশি। আমার বিদায়, ওর বিরহ বেদনা সবটা মিলে কাঁদছে। বাধা দিলাম না।

চলে এলাম বাংলাদেশে। এমবিবিএস কমপ্লিট করলাম। ইন্টার্ন চালিয়ে নিচ্ছি। আরও ডিগ্রি নেওয়ার ইচ্ছা। কিন্তু মাসি কলকাতায় বাঙাল নেই এসব বলে আমার কুমিল্লাতে বিয়ে ঠিক করল। বিশেষ কোনো পছন্দ না থাকায় রাজি হয়ে বিয়ে করে ফেললাম।
বাবা-মা, আমি, জামাই বাংলাদেশ থেকে কলকাতা গেলাম। সময়টা ২০১৬-এর ডিসেম্বর। বেশ শীত শীত। সুহাসিনীকে কল করলাম দেখা করতে বলার জন্য। ওমন ভাঙা, রুষ্ট কণ্ঠস্বর ওর শুনব ভেবে উঠতে পারিনি।

আমিই ওর বাসায় ছুটে গেলাম অসুখ করেছে কিনা দেখতে। কী হাল হয়েছে ওর! কী সুশ্রী ছিল আর কী বিশ্রী হয়ে গেছে।
কোত্থেকে যেন দমকা ঝড় আসে ওর জীবনে। কথা বলার নাকি সময় পায় না ওর ভালোবাসার মানুষ। সেটা হলেও শুধু সে মেনে নিতে পারত। কিন্তু ফেক পরিচয়ে কে যেন আগে নোংরা ভাষায় খুব গালাগালি করতে শুরু করে। গালাগালটা ওর ভালোবাসার মানুষকে ঘিরে। এক ধরনের পরোক্ষ ইঙ্গিত যেন ভালোবাসার মানুষের থেকে দূরে চলে যাওয়ার জন্য।

সুহাসিনী কিছু বুঝে উঠতে পারে না। সুহাসিনী পাঠক আর ওর ভালবাসার মানুষটা লেখক। এ পাঠক-লেখক ভালোবাসাটা সাধারণ। সুহাসিনীর মনে যে তিনি অমন জায়গা করে নেবেন সেটা বোধহয় বোঝেননি। সুহাসিনী আগ বাড়িয়ে গিয়ে অনেক কথা বলতো। লোকটা প্রথম প্রথম বোধহয় তেমন গভীরতা আন্দাজ করে ওঠেনি। সেও সুহাসিনীর অবুঝ মনের কথা, আবেগী ভালোবাসার কথা মন দিয়ে শুনতো। সুহাসিনী খুব কল্পনাপ্রবণ। সে ভাবতো লঞ্চের ছাদে করে লম্বা একটা পথ তারা দুজন হাত ধরাধরি করে দুজনের চোখের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে পাড়ি দেবে। গভীর রাতে জোছনাস্নান করবে একে অপরকে আলিঙ্গন করে। সেসব হওয়ার আগে ভালোবাসার মানুষটা হঠাৎ হারিয়ে যেতে চায়। অনেক অনুনয়-বিনয় করে। সুহাসিনীর ভালোবাসায় দোষটা কোথায় জানতে পা ধরতে পর্যন্ত দ্বিধা করে না। ফিরিয়ে পেতে চায় সেই ভালোবাসার ক্ষণগুলো। লোকটির এক কথা। তার নাকি সময় হয়ে ওঠে না কথা বলার। আবার বলে, তোমার সঙ্গে আর কথা বলতে চাইছি না। বিরক্ত করো না। সবাই সব কিছু চাইলে পায় না। সুহাসিনী কথাটা ঢের জানত। সবাই সবকিছু চাইলেই যে পাবে এমন দলিল কোথাও নেই। কিন্তু ভালোবাসার সঙ্গে যে তার অমন হবে- ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি।

সুহাসিনীর বুকটা কষ্টে ভরে ওঠে। ঠিকমতো তার খাওয়া নেই, নাওয়া নেই, ঘুম নেই। শুধু দু’চোখে তার বিষণ্নতা। মাঝে মাঝে নাকি তার মরে যেতে ইচ্ছে করে। নেহাত বাবা-মা আর ছোট ভাইটির মুখ চেয়ে জীবনটাকে তুচ্ছ ভাবতে পারে না।

সুহাসিনী বুঝতে পারে মৃত মানুষকে ভোলাও খুব সহজ। কিন্তু ইচ্ছে করে জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া মানুষটাকে হুট করে ভোলা যায় না। শুধু যে হুট করে এমন না, ছয়-সাত বছর হয়ে এল। সুহাসিনীর মন থেকে তার সেই ভালোবাসার মানুষটাকে মুছে যেতে দেখলাম না।
আমি কিছুই বলতে পারলাম না, বোঝাতেও না। শুধু ঈশ্বরের কাছে মন্দিরে সুহাসিনীর নামে কী যেন এক আশায় পূজা দিয়ে এলাম। বাংলাদেশে ফের ফিরে এলাম। সুহাসিনীর ভালোবাসার মানুষটার জন্য ওর জীবন থমকে গেছে মাঝপথেই। যখন চুল উড়িয়ে, খলখল করে হেসে, বান্ধবীদের হাত ধরে কলেজে যাওয়ার সময় তখনই সুহাসিনীর বুকে এক শুষ্ক মরু যেন গজিয়ে উঠেছে যেখানে জল নেই, তাজা প্রাণ নেই শুধুই হাহাকার তৃষ্ণার্ত বুকের। আমার তেমনটা নয়। বিয়ে হয়েছে। বর ভালোবাসার মানুষ। ওর হাত ধরেই বাকি জীবনটা কাটাবার ইচ্ছে। এখন ১৬ পেরিয়ে ২০-এ পড়েছে। সুহাসিনীর জীবনেও বিষের ছোঁয়া লাগতে যেন দেরি হল না। ভালোবাসা না পেয়ে কতদিনই বা বাঁচা যায়। জল ছাড়া কি প্রাণ বাঁচে দেহে? সুহাসিনীর বুকে এক ফোঁটা জলও ছিল না। কিন্তু গাল বেয়ে তবুও তার জল গড়াতো। মুছে কি দিতে পারে গড়িয়ে পড়া জলের এক ফোঁটা সেই ভালবাসার মানুষ তার? কত আশা, কত অপেক্ষা নিয়ে দিন কাটিয়েছে। কপালটা বড্ড ফাটা!
সুহাসিনী বিষ পানে চিরতরে প্রাণ ত্যাগ করল। ভালোবাসার মানুষটার কানে কি সে খবর পৌঁছেছে? নাকি সে তার মতোই জীবন কাটাচ্ছে। অভিমানী সুহাসিনীর শেষ কৃত্যেও বোধ হয় তার দেখা মিলবে না! ভালোবাসা এমন বিরহেরও হয়। সুহাসিনীর সঙ্গে আমার পরিচয় না থাকলে জানতামও না!

 
Electronic Paper