ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

জল জোছনার গল্প

ইমরুল কায়েস
🕐 ১২:৪১ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ০৭, ২০২০

নিরন্তর নিষ্পলক চোখে আকাশের নীলাভ সমুদ্রের নীলিমায় নিমা নিজের অতীতকে আজ বারবার খুঁজতে চাইছে। শুভ্র মেঘের ভেলায় হারিয়ে যাওয়ার অভ্যাসটা কিশোরী বেলার চিরায়ত আয়োজন ছিল। মন খারাপ হলেই নিমার কাছে জল আর শরতের আকাশকে সবচেয়ে আপন মনে হয়। আজ নিমার মনকে কেন জানি জল-জোছনাই টানছে...।

নিমা একপা দুপা করে তাদের পুরনো বাড়ির ভিটের দিকে এগিয়ে গেল। সুরমোহনা গাঁয়ের কোল ঘেঁষে বয়ে চলা একমাত্র নদী। নদীটির সঙ্গে নিমার ছোটবেলার সই পাতানোর সম্পর্ক। নিমার মা যখন নদীর পাড়ে বসে কাপড় কাচত, সে তখন মায়ের আঁচলে বাঁধা চাবির গিঁট ধরে পিঠের সঙ্গে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত; আর নদীর জলের কুলকুল শব্দ শুনত। কাপড় আছাড় দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাবানের ফেনার ময়লা-তুলোর মতো ঢেউয়ের মাথায় উঠে আবার জলের অতল তলে হারিয়ে যেত। এটা দেখে দেখে নিমার বেড়ে ওঠা। সাঁতার শিখতে যেন ভয় না লাগে তাই সুরমোহনার সঙ্গে প্রথমে সই পেতেছিল।

সই পাততে যে কত শত ছোট ছোট আচার-আয়োজন করতে হয়! নিমা তার বড় বোনদের কাছে দেখে সই পাতার সব আয়োজন শিখেছে। সে আর তার খালাতো বোন সুমু সুরমোহনার সঙ্গে সই পাতানোর দিনক্ষণ ঠিক করে। ফাল্গুনের পরে পূর্ণিমার চাঁদ যখন সবে ভরাট হয়ে উঠবে ওই সময়ের সন্ধ্যে বেলা ওরা সই পাতানোর উপহার সুরমোহনাকে দেবে। কিন্তু দু’বোনে চিন্তার আগামাথা উদ্ধার করতে পারে না।

নদীর বাড়ি কই? নদীর তো ছেলেমেয়ে হয় না; তাছাড়া সই পাতাতে তো দুজনকে দুজনের বাড়িতে যেতে হয়; নতুন জামা পরে, একই কলাপাতার প্লেটে ভাত খেতে হয়; পুতুলের বিয়ে দিতে হয়; এসব কেমনে সে করবে। সেই পুতুল বর-কনের জন্য কত শত কাপড়চোপড় দিতে হবে। কাপড় কাটার পরে ছেটে ফেলা ঝুট নিমা আর সুমু গত একমাস ধরে টুকরো দর্জির বাড়ি থেকে এনে রেখেছে। পুতুল বানানোর জন্য পাটকাঠি যেটা খুব মোটা আর সুন্দর তা বাছাই করা শেষ। এ রকম কত জোগাড় যত্ন করে ফেলেছে দু’বোনে মিলে। সমস্যা বাঁধল সুরমোহনাকে নিয়েই; ওর তো এসব কিছু নেই। নিমা আর সুমু গেল ওদের নানির কাছে বুদ্ধি নেওয়ার জন্য।

নানি ওদের সব কথা শুনে বুদ্ধি বাতলে দিল- কাল সকালে ফযরের আজানের সঙ্গে সঙ্গে নিমা চোখ বন্ধ করে এক দমে দুটি কচি কলাপতা কাটবে; পাতাটি গ্রামের সাতটি কুয়োর জল দিয়ে ধুয়ে নেবে। তারপর সেই পবিত্র কলাপাতায় খাবার সাজাবে, পাশে পুতুল বর-কনেকে শুইয়ে দিয়ে একটা নিমার হাতে আর একটা সুমুর হাতে রাখবে; আর একটা ওই সকালে সুরমোহনাতে প্রথম যে ঢেউ আসবে তার সঙ্গে ছেড়ে দেবে। ওরা বসে থাকবে যতক্ষণ সেই সাজানো কলাপাতা ওদের গ্রাম ছেড়ে চলে যায়; তাতেই সই পাতানো হয়ে যাবে।

নিমার কোনো তাড়া নেই; সে সুরমোহনার কাছে এসে দাঁড়ায়; আজ তার নেই কোনো পিছুটান, নেই বন্ধনের মিথ্যে মায়া; সবই তার সুদূর অতীত। ছোটবেলার এ সইয়ের সঙ্গে নিমার আজ অনেক বোঝাপড়া আছে। নিমা মনে মনে হাজারো প্রশ্ন আওড়ায়- সুরমোহনার তো একসময় ভরা যৌবন ছিল! তারও কি নিমার মত দু-কূল ছাপিয়ে কান্না আসত? নাকি ভরা এ পূর্ণিমার জোছনায় রুপালি রঙয়ের জলে সুখের দোঁলনচাপা দুলত? নানান কিসিমের সাদা, লাল, নীল, হলুদ ও বাদামি ভাবনা নিমার মনে উঁকি দিচ্ছে...। গভীর বেদনা আর অতীতের সুখস্মৃতিগুলো আস্তাবলের ধুলোবালির সঙ্গে মিলেমিশে কেমন একটা অসহ্য যন্ত্রণা দিচ্ছে নিমাকে। সে ছোটবেলার এ সই সুরমোহনার জলের দিকে পা বাড়িয়ে দিল। জলের পানে হাঁটছে আর ভাবছে। আহা রে! তার সইয়ের এখন নেই উচ্ছল চলার পথ। ভরা যৌবনে বুকের ওপর দিয়ে বয়ে চলা পাল তোলা নৌকা নেই। রাতে নদীর বুকের ওপর কী দৃশ্য! নৌকার ঘুপরির মধ্য থেকে কেরোসিনের বাতির আলোর মৃদু মৃদু দল ছোটানো ঝলকানি সুরমোহনার ঢেউয়ের সাথে লুকোচুরি গল্প বুনত। তেমন গল্প নিমারও আছে নয়নের সঙ্গে।

আহা! জলের সঙ্গে আজ বুঝি জোছনার শুভ পরিণয় হবে। কত সুন্দর! ভরা পূর্ণিমার চাঁদ যেন মেঘের ভেলাকে দু’হাত দিয়ে সরিয়ে উঠে আসছে...। চোখ বন্ধ অবস্থায় শুনতে পায় গভীর রাতে তার জানালার কাছে ফিসফিস ডাক- এই নিমাআআআআ...। নিমা না শোনার ভান করে ঠিক ৫ মিনিট পরে জানালার একটি কপাট হালকা ফাঁক করে বলে, ‘চান্দু, এত্ত রাতে কী চাও?’

চান্দু বললে নয়ন ক্ষেপে যায়। তাই নিমা ইচ্ছে করে বেশি করে ডাকে। নয়ন রেগে গেলে তার চোখে একধরনের অগ্নিস্ফূরণ খেলা করে।

তখন নয়নকে পুরুষসুলভ মনে হয়। মনের অজান্তে নিমার শরীরে একটি অনুভূতির পিঁপড়ে সুই সুই করে পা থেকে মাথা অবধি চলাচল শুরু করে। নিমার এতেই সুখ লাগে।

ভরা পূর্ণিমার রাতে সুরমোহনার জলে পা ডুবিয়ে নিমা স্মৃতির মরুভূমিতে শেষ তিয়াস মেটাচ্ছে। নয়ন নিমার প্রথম বসন্তের কোকিল। নয়নের সঙ্গে নিমার ইস্টিকুটুম সম্পর্কের পরিবেশনা ছিল পরিচিত আর দশটি প্রেমের মতো না। গভীর রাতে বাইরে বিদঘুটে অন্ধকার। ভয়ংকর সব পোকামাকড়ের ডাক; বাতাসের হু হু শব্দের সঙ্গে নয়ন নিমার জানালার শিক ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে। সাপের নিঃশ্বাসের মতো ফিসফিসিয়ে বলে, ‘ঘুরে দাঁড়াও; তোমার রেশমি চুলের খোঁপাটা শিকের সঙ্গে লাগিয়ে দাও’।
নয়ন এক হাতে শিক ধরে অন্য হাতে একটি অফুটন্ত কচি টুকটুকে লাল গোলাপ নিমার খোঁপায় গুঁজে দেয়। নয়ন যখন খোঁপায় ফুল গুঁজে দিচ্ছে নিমার মন তখন অনুপম ভালোবাসার মোহ আবিষ্ট ময়ূরের মতো পেখম তুলে নাচছে... হারিয়ে যায় কোন এক অজানা জগতে।

নয়ন নিমার কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে বলে ‘কই হারিয়ে গেলে! গোলাপটি আমি এ রাতে গোরস্তানের ভেতরের বাগান থেকে তুলে এনেছি।’

দিনের বেলায় মনে ছিল না বলে এ কাণ্ড! নিমার মুখ তখনও ঘরের ভেতর দিকে; মিনিট তিনেক পরে দু’হাত দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে সে ঘোরে। নয়নের দু’হাত যে শিক ধরে আছে তার ওপর দিয়ে হাত রাখে। নিমু তার ডান হাতের চারটি আঙ্গুল নয়নের বাম হাতের চারটি আঙ্গুলের ফাঁকে জড়ায়। এভাবে নয়ন তার ডান হাতের চারটি আঙ্গুল নিমার বাম হাতের চার আঙ্গুলের ফাঁকে বসিয়ে শক্ত করে চাপ দিয়ে ধরে রাখে। নিমার চোখের জলের অঝর ধারা বয়ে তার নাকের দুপাশ গলিয়ে ঠোঁটের ওপরে এসে জড়ো হয়েছে। রাতের শেষ বেলায় ডুবন্ত চাঁদের বাঁকা আলো জানালার শিক গলে ঠিক নিমার চোখের জলে এসে পড়েছে। নয়ন দেখছে সেই আলোতে নিমার কান্নার জলকণাগুলো হীরের মতো দ্যুতি ছড়াচ্ছে। নয়ন দুই শিকের মাঝখান দিয়ে নিমার নাকের দুপাশে ডান-বাম করে ছুঁয়ে দিল।

আচমকা নিমার দু-কাঁধে নরম হাতের ধাক্কা পেয়ে তার ঘোর কেটে গেল; চোখ খুলে দেখে সুমু। সুমু বলে, ‘কী রে আপু? তুই এ রাত দশটায় এখানে একলা! ওই দিকে খালামনি খুঁজে মরে’। ভরা পূর্ণিমায় কড়া জোছনার আলোর ঝলকানিতে নিমার চোখের জল আর সুরমোহনার জলের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে যায়।

 
Electronic Paper