আফ্রিকার মুক্তি-সূর্য
জগন্নাথ বিশ্বাস
🕐 ৯:০২ অপরাহ্ণ, জুলাই ২০, ২০১৮
রংধনুর দেশেই জন্মেছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। মুক্তির সূর্য হয়ে। তাঁর হাত ধরেই ‘কৃপণ আলোর অন্তঃপুর’ থেকে স্বাধীনতার পথে বেরিয়ে এসেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। তাই এ এক বিবর্তনের গল্প। আবার এটা একটা রূপকথাও। রংধনুর রূপকথা। দক্ষিণ আফ্রিকার অন্য নাম যে ‘রেইনবো কান্ট্রি’।
উদভ্রান্ত আদিম যুগে, আফ্রিকাকে যখন ডাকা হতো ‘মানহারা মানবী’ নামে, তখন ‘বনস্পতির নিবিড় পাহারায়’ ঘেরা দেশটাতে এসেছিল ‘মানুষ-ধরার দল।’ শ্বেতাঙ্গরা। নখ যাদের তীক্ষ্ম ছিল নেকড়ের চেয়ে। গর্বে যারা অন্ধ ছিল আফ্রিকার সূর্যহারা অরণ্যের মতো। শ্বেতাঙ্গদের বর্বর লোভ আর নির্লজ্জ অমানুষতায় পঙ্কিল হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার ‘অপমানিত ইতিহাস’। মাদিবা সে ইতিহাসকেই বদলে দিয়েছিলেন।
ম্যান্ডেলার সংগ্রাম শুরু হয়েছিল কুনু থেকে। ছোট ছোট মাটির ঘর, আর গুল্মঘেরা সমতলভূমিতে বক্সার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ছেলেবেলা কেটেছিল নেলসনের। আদর করে ম্যান্ডেলাকে এই নামে ডাকতেন কুনুর এক শিক্ষক। সেখান থেকে আইন পড়তে গেলেন শ্বেতাঙ্গপ্রধান উইটওয়াটার্স্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। তেইশ বছরের যুবক ম্যান্ডেলার সঙ্গে পরিচয় হলো আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের প্রাণপুরুষ ওয়াল্টার সিসুলুর। আফ্রিকার বর্ণবিদ্বেষের বর্বরতা সম্পর্কে তিনিই প্রথম চোখ খুলে দেন ম্যান্ডেলার। আফ্রিকার ভাবী রাষ্ট্রনায়ক এরপর যোগ দিলেন এনসিসিতে। আন্দোলন আর সংগ্রামে কাটতে লাগল দিন। এসে গেল ১৯৬০ সালের ২১ মার্চ। ট্রান্সভাল প্রদেশে শার্পভিল শহরে কৃষ্ণাঙ্গদের বিক্ষোভ দমন করতে গিয়ে ৬৯ জনকে গুলি করে হত্যা করল শ্বেতাঙ্গ পুলিশ। সারা দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে প্রতিবাদে ফেটে পড়লেন ম্যান্ডেলাও। নিষিদ্ধ হলো আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস। ১৯৬২ সালের ৫ আগস্ট নাশকতা ও হিংসার মাধ্যমে সরকার উৎখাতের অভিযোগে গ্রেপ্তার হলেন ম্যান্ডেলা। ‘রিভোনিয়া ট্রায়ালে’ শোনা গেল, তার দৃপ্ত কণ্ঠস্বর-‘আমি এমন একটা গণতন্ত্র ও স্বাধীন সমাজের আদর্শে বিশ্বাস করি, যেখানে সব মানুষই পারস্পরিক সৌহার্দ্যরে মাধ্যমে সমান সুযোগ নিয়ে বাঁচবে। এই আদর্শের জন্য আমি জীবন দিতেও প্রস্তুত।’ ১৯৬৪ সালের ১২ জুন রিভোনিয়া ট্রায়ালের রায় ঘোষণা হয়। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল নেলসন ম্যান্ডেলার। এখান থেকেই শুরু রোবেন দ্বীপের রূপকথা। প্রিজোনার্স থেকে প্রেসিডেন্ট হওয়ার গল্প।
কেমন ছিল রোবেন দ্বীপের নিঃসঙ্গ কারাগারে ম্যান্ডেলার বন্দিজীবন। ‘ঘরটা এত ছোট ছিল, তিন পা যেতে না যেতেই ধাক্কা খেতে হতো দেয়ালে।’ মুক্তির পর বলেছিলেন মাদিবা। সাত ফুট বাই দশ ফুটের ছোট্ট খুপরি। একটা কম্বল। কাঠের টুল। লাল রঙের একটা বালতি। কাপ আর অ্যালুমিনিয়ামের প্লেট। এই নিয়ে জীবনের ১৮টি বসন্ত কাটিয়েছিলেন রোবেন দ্বীপের নিঃসঙ্গ কারাগারে। খাবার বলতে ১০০ গ্রাম চাল, ৭৫ গ্রাম আটা আর সামান্য সবজি। প্রতিবাদ করলে ক্ষিপ্ত শ্বেতাঙ্গরা তেড়ে আসতেন-‘ইউ নিগার, উইল ইউ গেট অ্যাট হোম হোয়াট ইউ আর গেটিং হেয়ার। থ্যাঙ্ক ফোরফাদার্স ইউ আর ইন আওয়ার প্রিজন।’
এই নরকে বসেই ১৯৭৬ সালের ১৫ এপ্রিল উইনিকে লেখা মিষ্টি প্রেমের চিঠিতে হৃদয় উন্মুক্ত করেছিলেন ম্যান্ডেলা-‘তোমার সুন্দর ছবিটা আমার বাঁ কাঁধের ঠিক দুই ফুট ওপরে রাখা আছে। তার নিচে বসেই আমি লিখছি। প্রতিদিন সকালে আমি খুব যত্ন করে ছবিটা মুছি। দারুণ আনন্দ হয়। মনটা ফিরে যায় পুরনো দিনে। মনে হয় তোমাকে যেন আদর করছি। আমি নিজের নাকটা নিয়ে আসি তোমার নাকের ওপর। আগে সত্যি যখন এটা করতাম, তখন সারা শরীরে বিদ্যুৎতরঙ্গ খেলে যেত। এখন অনুভব করার চেষ্টা করছি। আমার ঠিক বিপরীতে যে ছোট্ট টেবিলটা আছে, তার ওপরে আমি অন্যকিছু আর ইচ্ছে করেই রাখিনি। তোমার মতো সুন্দরীর চোখের চাহনিতে যে মনোযোগ, তাই দেখেই তো আমি নিজেকে চাঙ্গা রাখি।’ সাতাশ বছর পর জেল থেকে যেদিন বেরুচ্ছেন নেলসন ম্যান্ডেলা, তার ঠিক পাশটিতে দাঁড়িয়ে বিজয়িনীর হাসি নিয়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত আকাশের দিকে ছুড়ে দিয়েছিলেন উইনি। ১৯৯০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারির সেই ছবিটা ইতিহাসে অমর হয়ে আছে।
যাই হোক, রবেন দ্বীপের নিঃসঙ্গ কারাগারে উইনির সঙ্গেও বছরে একবার মাত্র দেখা করার সুযোগ পেতেন ম্যান্ডেলা। চিঠি সেন্সর করা হতো। শ্বেতাঙ্গদের মনমতো না হলে কালো কালি দিয়ে মুছে দেওয়া হতো লাইনগুলো। ফলে জানতে পারতেন না আন্দোলনের খবর। ১৯৮০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার নির্বাসিত নেতা অলিভার তাম্বো যখন ম্যান্ডেলার মুক্তির দাবিতে বিশ্বব্যাপী গণআন্দোলন গড়ে তুলছেন। ১৯৮৮ সালে লন্ডনের ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে সমবেত ৭২ হাজার মানুষ যখন বলছে, ম্যান্ডেলাকে মুক্ত করো। তিনি নেলসন কী করছিলেন? খনি শ্রমিক হিসেবে নিস্তরঙ্গ জীবন কাটাচ্ছিলেন রোবেন দ্বীপে? মোটেই না। খনির মাটিতে লুকিয়ে রাখছেন বই আর সংবাদপত্র। বাইরের আন্দোলন সম্পর্কে সচেতন করছেন সঙ্গীদের। এই না হলে বিপ্লবী।
ম্যান্ডেলা অনেকবার স্বীকার করেছেন তার জীবনে মহাত্মা গান্ধীর প্রভাবের কথা। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ১৯৯৩ সালে পিটারমারিজবার্গে গান্ধী মূর্তি উন্মোচনের সময় তিনি বলেছিলেন, ‘আমার জীবনে এ এক অনন্য সম্মান। আমাদের দেশে এই প্রথমবার আশার প্রতিমূর্তি উন্মোচিত হলো। সেই আশা, যা বলে যে দক্ষিণ আফ্রিকায় সব মানুষ ঔপনিবেশিকতা এবং বর্ণবৈষম্যের অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়ে নতুন এক অহিংস সমাজের অংশীদার হবে।’ দক্ষিণ আফ্রিকাকে অহিংস সমাজের অংশীদার করার ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শক ছিলেন নেলসন। এ প্রসঙ্গে উদাহরণস্বরূপ তার জীবনেরই একটা গল্প বলা যাক। ম্যান্ডেলার মুক্তির পরও দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবিদ্বেষ আইন জারি ছিল। ১৯৯০ সালে কারামুক্তির কিছুদিন পর জোহানেসবার্গের আলেকজান্দ্রা শহরে প্রবল উত্তেজনার মধ্যে রাজনৈতিক সভা করছিলেন ম্যান্ডেলা। খবর এলো একদল কৃষ্ণাঙ্গকে হত্যা করেছে শ্বেতাঙ্গরা। সভা অগ্নিগর্ভ। স্ফুলিঙ্গের মতো ফুঁসছে জনতা। সামান্য প্ররোচনায় দাঙ্গা বেঁধে যাবে, এমন মুহূর্তে বক্তৃতার মাঝে চুপ হয়ে গেলেন ম্যান্ডেলা। দেখলেন কৃষ্ণাঙ্গদের ভিড়ে দাঁড়িয়ে এক শ্বেতাঙ্গিনী। হাসিতে ভরে উঠল মাদিবার মুখ। শ্বেতাঙ্গিনীকে দেখিয়ে বললেন, ‘ওই যে ওকে দেখছেন। উনি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন। ১৯৮৮ সালে কেপটাউনের জেলে আমার যখন টিবি হয়, তখন উনিই আমায় সারিয়ে তোলেন।’ এরপর শ্বেতাঙ্গিনীকে মঞ্চে ডেকে পরম মমতায় জড়িয়ে ধরলেন ম্যান্ডেলা। মুহূর্তে কৃষষ্ণাঙ্গদের প্রতিশোধ স্পৃহার আগুন নিভে গেল। এমন জনদরদি নেতার না থাকা মানে তো কেবল শূন্যতা নয়, দক্ষিণ আফ্রিকার মুক্তি-সূর্যের অস্তাচলে যাওয়া। আফ্রিকা তাই এখনো কেঁদে ফেরে মাদিবার জন্য। কৃষ্ণাঙ্গদের মাদিবা। শে^তাঙ্গদেরও। ২০১৩ সালে ম্যান্ডেলার শেষকৃত্যে এসে ঠিকই বলেছিলেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা-‘আমি সেই অগণিত লাখো মানুষের একজন, যারা ম্যান্ডেলার জীবন থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। জীবনের প্রথমবার যে রাজনৈতিক বিক্ষোভে যোগ দিয়েছিলাম, সেটা ছিল বর্ণবিদ্বেষবিরোধী বিক্ষোভ।
তিনি জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর বুঝেছিলাম, মানুষ যদি ভয় কাটিয়ে নিজের আশা ও দৃঢ়সংকল্পের দ্বারা চালিত হতে পারে, তাহলে কত কী-ই না করা সম্ভব।’ ‘উপেক্ষার আবিল দৃষ্টি’ থেকে মুক্তি পাওয়া দক্ষিণ আফ্রিকার চেয়ে কে আর ভালো বুঝবে একথার সত্যি মানে?