ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

প্রেসিডেন্ট ম্যান্ডেলা

আবু রায়হান খান
🕐 ৯:০১ অপরাহ্ণ, জুলাই ২০, ২০১৮

আফ্রিকান সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভের পর জনমানুষের নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল এত কাল ধরে নির্যাতিত কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করা। কেননা দীর্ঘসময় অত্যাচারিত হয়ে আসা কৃষ্ণাঙ্গরা বর্বর শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক আচরণ করাটাই ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক।

এ ছাড়া ক্ষমতার অপব্যবহার হওয়াটাও তখন অস্বাভাবিক ছিল না। কিন্তু এরূপ ঘটলে প্রকৃত অর্থে বর্ণবাদহীন সমাজ গঠনের অগ্রযাত্রা মারাত্মকভাবেই ব্যাহত হতো। তাই এমনটা ঘটতে দেননি সত্যিকারের জনমানুষের এ নেতা। এবং তা দূরীকরণের লক্ষ্যে জাতীয় পুনর্মিত্রতা নীতি প্রণয়ন করেন; যা ছিল সে সময়ের সবচেয়ে সময়োপযোগী পদক্ষেপ।
এ ছাড়াও দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে তিনি বহুসংখ্যক সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ করেন যা সমগ্র আফ্রিকাদের জীবনযাত্রার ঊর্ধ্বগতিকে ত্বরান্বিত করে। এর পাশাপাশি আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রেও অসামান্য ভূমিকা পালন করেন বিচক্ষণ এ নেতা। নির্যাতিত-নিপীড়িত আফ্রিকাকে তিনি নিয়ে যান সভ্যতার অনন্য এক শিখরে, তার হাত ধরেই নতুন করে লেখা হয় সভ্য আফ্রিকার ইতিহাস।
প্রথম মেয়াদে সফলভাবে দায়িত্ব পালনের পর ১৯৯৯ সালে স্বেচ্ছায় প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরে দাঁড়ান স্বাধীনতার চ্যাম্পিয়ন ম্যান্ডেলা। তত দিনে দক্ষিণ আফ্রিকাসহ সমগ্র বিশ্ব তার জনপ্রিয়তা আকাশ ছোঁয়া। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার শ্রদ্ধাভাজন হয়ে উঠেছেন তিনি। এত অর্জনের পরেও জীবনে তিনি একবারের জন্য ঔদ্ধত্য প্রকাশ করেনি। সর্বদাই ছিলেন অমায়িক ও বিনয়ী একজন খাঁটি মানবতাবাদী।
রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানান সমস্যা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করতেন এবং বিভিন্ন মূল্যবান পরামর্শ প্রদান করতেন। তবে এ সময়ও সকল প্রকার অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে তার কণ্ঠস্বর ছিল প্রতিবাদমুখর। ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের ব্যাপক সমালোচনা করার পাশাপাশি মার্কিনীদের বিভিন্ন কপটতার বিরুদ্ধেও নিন্দা জ্ঞাপন করেছেন আপোসহীন এ মানুষটি।
২০০৪ সালে সকল ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে অবসর গ্রহণ করেন মাদিবা। এরপর শুধু সামাজিক সেবা ও সচেতনতামূলক কাজ করে গেছেন। এর মধ্যে এইআইভি সম্পর্কে সচেতনতা ক্যাম্পেইন অন্যতম। তিনি শেষবারের মতো জনসম্মুখে আসেন ২০১০ সালের দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠেয় ফুটবল বিশ্বকাপের আসরে। বস্তুত আফ্রিকায় ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজনের পেছনে তারই ছিল গুরুভুমিকা।
জীবনের শেষ বয়সে এসে রোগ যেন তার পিছু ছাড়তেই চাচ্ছিল না। ভেঙে পড়ছিল শরীর। ২০১১ সালে শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের কারণে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হলে তা সমগ্র বিশ্বের নজরে আসে। সেবার খুব স্বল্পসময়ের মধ্যেই তিনি ছাড়া পেয়ে যান সেখান থেকে। তবে এরপর ফুসফুসের সংক্রমণের কারণে তাকে বেশ ভুগতে হয়। এবং ২০১২ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার হাসপাতালগামী হতে হয়। ২০১৩ সালের জুনে তার ফুসফুসের সংক্রমণের অবস্থা আরও খারাপ হলে আবারো তিনি ভর্তি হন হাসপাতালে।
জীবন যখন আর শরীরের ভার টানতে চাচ্ছিল না, তখন হয়তো অবচেতন মনে স্বর্গলোকের ডাক শুনেছিলেন মাদিবা। তাই সেবার বিশেষ উন্নতি ছাড়াই সেপ্টেম্বরে বাসায় ফিরে আসেন পরিবারের সঙ্গে একান্ত কিছু সময় কাটাবার উদ্দেশ্যে। তবে খুব বেশিদিন স্বর্গলোকের সাক্ষাৎ উপেক্ষা করতে পারেননি তিনি। সে বছরেরই ৫ ডিসেম্বর সমগ্র বিশ্বকে কাঁদিয়ে অন্তিম নিদ্রায় শায়িত হন মানব মুক্তির এ মহান অগ্রদূত। আর এর মাধ্যমে গণতন্ত্রের পক্ষে, বর্ণবাদবিরোধী, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও শান্তির পথে তার ৯৫ বছরের সংগ্রামী জীবন নিমীলিত হয়।
সে সময় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রায় ৯০ জন প্রতিনিধি তার প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করতে দক্ষিণ আফিকা ভ্রমণ করেন। এর মধ্যে তাকে সন্ত্রাসবাদী আখ্যা দেওয়া সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার, বিল ক্লিনটন, বুশ, বারাক ওবামা, তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনসহ আরও অনেক মান্য ব্যক্তিরা। তার মৃত্যু সম্পর্কে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেন, ‘আমরা হারিয়েছি বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী, নির্ভীক, নির্ভেজাল একজন ভালো মানুষকে।’

 
Electronic Paper