ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

নির্বাচিত উৎসর্গ পত্র

সিরাজুম মুনীরা শ্রাবণ
🕐 ৮:২৫ অপরাহ্ণ, জুলাই ২০, ২০১৮

কয়েক দশক ধরে জাদুকরী ভাষায় পাঠকদের মাতিয়ে রেখেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। গল্প-উপন্যাস তো আছেই, এমনকি তার লেখা ভ্রমণ-স্মৃতিকথাগুলোও ভাষার চমৎকারিত্বে পরিপূর্ণ। ব্যক্তি হুমায়ুন নিজেও ছিলেন বেশ আগ্রহোদ্দীপক এক চরিত্র।

এসবের পাশাপাশি তার আরও একটি চমৎকার জগত রয়েছে, তার বইয়ের উৎসর্গ পত্রগুলো। উৎসর্গগুলো প্রত্যেক বইয়ে বিচ্ছিন্ন আকারে থাকায় এবং এদের আকার ক্ষুদ্র হওয়ায় হয়তো অনেকের উপলব্ধি এড়িয়ে গেছে। কিন্তু সেসব উৎসর্গ পত্র একত্র করলে দেখা যাবে হুমায়ূন আহমেদের নতুন এক জগত উদ্ভাসিত হয়েছে। তাই এখানে হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের নির্বাচিত কিছু উৎসর্গ পত্র তুলে ধরা হলো।
রূপার পালঙ্ক
একবার একজন লেখক আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন। আমাদের তিনকন্যা যে যেখানে ছিল, লেখকের নাম শুনে উড়ে চলে এলো। আমার মেজো মেয়ে বলল, এত বড় লেখকের সামনে সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। তার না-কি পা ঝিমঝিম করছে। আমি তখন লেখককে দেখছিলাম না, মুগ্ধ হয়ে আমার তিনকন্যার উচ্ছ্বাস দেখছিলাম।
সেই লেখকের নাম- শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
দারুচিনি দ্বীপ
মা মনি নোভা আহমেদ
এ উপন্যাসের পাণ্ডুলিপির প্রথম পাঠিকা নবম শ্রেণির বালিকা আমার বড় মেয়ে নোভা আহমেদ। সে বই শেষ করেই আমাকে বলল, আমার যখন একুশ বছর বয়স হবে তখন কি তুমি আমাকে এ বইয়ের নায়িকার মতো একা একা সেন্ট মার্টিন আইল্যান্ড যেতে দেবে? আমি বললাম-না।
সে কঠিন গলায় বলল, তাহলে তুমি এ বইয়ে মিথ্যা কথা কেন লিখলে? আমি তার অভিমানী চোখের দিকে তাকিয়ে বলতে বাধ্য হলাম-আচ্ছা যাও, তোমাকেও যেতে দেব।
চলে যায় বসন্তের দিন
আমার একটি খুব প্রিয় গান আছে, গিয়াসউদ্দিন সাহেবের লেখা ‘মরণ সঙ্গীত’-‘মরিলে কান্দিস না আমার দায়’। প্রায়ই ভাবি আমি মারা গেছি, শবদেহ বিছানায় পড়ে আছে, একজন কেউ গভীর আবেগে গাইছে-‘মরিলে কান্দিস না আমার দায়’।
‘নক্ষত্রের রাত’ নামের ধারাবাহিক নাটকের শুটিং ফ্লোরে আমি আমার ইচ্ছা প্রকাশ করলাম। এবং একজনকে দায়িত্ব দিলাম গানটি বিশেষ সময়ে গাইতে। সে রাজি হলো। উৎসর্গ পত্রের মাধ্যমে তাকে ঘটনাটি মনে করিয়ে দিচ্ছি। আমার ধারণা সময় এসে গেছে।
মেহের আফরোজ শাওন
ছবি পাড়ায় আমার ছোট্ট একটা অফিস আছে। সেই অফিসে রোজ দুপুর বেলা অভিনেতা মাহফুজ আহমেদ উপস্থিত হয় এবং হাসিমুখে বলে, ভাত খেতে এসেছি। সে আসলে আসে কিছুক্ষণ গল্প করার জন্য। ইদানীং মাহফুজ খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। দুপুর বেলা তার হাসিমুখ দেখতে পাই না। মাহফুজ কি জানে, প্রতিদিন দুপুরে আমি মনে মনে তার জন্য অপেক্ষা করি?
বাসর
স্নিগ্ধা করিম। আমার উৎসর্গপত্রগুলো সে খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ে। আমি না-কি উৎসর্গপত্রে অনেক মজা করি। তার ধারণা, কোনো একদিন তাকে একটি বই আমি উৎসর্গ করব। সেখানে অনেক মজার কথা থাকবে। বই উৎসর্গ করা হলো।
আজ আমি কোথাও যাব না
মানুষ পৃথিবীতে এসেছে পঞ্চ ইন্দ্রিয় নিয়ে। শোনা যায় কিছু মহাসৌভাগ্যবান মানুষ ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় নিয়েও আসেন। আমার কপাল মন্দ, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দূরের কথা পঞ্চম ইন্দ্রিয়ের এক ইন্দ্রিয় কাজ করে না। দীর্ঘ পনের বছর ধরে আমি কোনো কিছুর গন্ধ পাই না। ফুলের ঘ্রাণ, লেবুর ঘ্রাণ, ভেজা মাটির ঘ্রাণ কোনো কিছুই না।
এ দেশের এবং বিদেশের অনেক ডাক্তার দেখালাম।
সবাই বললেন, যে নার্ভ গন্ধের সিগন্যাল মস্তিষ্কে নিয়ে যায় সেই নার্ভ নষ্ট হয়ে গেছে। সেটা আর ঠিক হবে না। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে গন্ধবিহীন জগৎ স্বীকার করে নিলাম।
কী আশ্চর্য কথা, অল্পবয়স্ক এক ডাক্তার আমার জগতকে সৌরভময় করতে এগিয়ে এলেন। দীর্ঘ পনের বছর পর হঠাৎ লেবু ফুলের গন্ধ পেয়ে অভিভূত হয়ে বললাম, এ-কী!
যিনি আমার জগৎ সৌরভময় করেছেন, তার নিজস্ব ভুবনে শত বর্ণের শত গন্ধের, শত পুষ্প আজীবন ফুটে থাকুক এ আমার তার প্রতি শুভ কামনা। ডা. জাহিদ
কহেন কবি কালিদাস
এক সময় তার পছন্দের চরিত্র ছিল হিমু। সে হিমুর মতো কথা বলত, হিমুর মতো ভাবতো। তার বোনরা তার কাÐ দেখে তাকে একটা হলুদ পাঞ্জাবিও বানিয়ে দিলো। সে গম্ভীর মুখে হলুদ পাঞ্জাবি পরে আমার সঙ্গে দেখা করতে এলো। কিছুদিন হলো সে জানাচ্ছে হিমু এখন আর তার প্রিয় চরিত্র না। সে এখন মিসির আলির ভক্ত।
মিসির আলির এই বইটি তার জন্য- নুহাশ হুমায়ূন দ্য গ্রেট
আসমানীরা তিন বোন
আমি একজনকে চিনি যিনি দাবি করেন তার শরীরের পুরোটাই কলিজা। চামড়ার নিচে রক্ত মাংস কিছু নেই, শুধুই কলিজা। এ ধরনের দাবি করার জন্য সত্যি সত্যিই অনেক বড় কলিজা লাগে। প্রণব ভট্ট।
কালো যাদুকর
জুয়েল আইচ। জাদুবিদ্যার এভারেস্টে যিনি উঠেছেন। এভারেস্টজয়ীরা শৃঙ্গ বিজয়ের পর নেমে আসেন। ইনি নামতে ভুলে গেছেন।
আমি এবং কয়েকটি প্রজাপতি
তার নাম রোমেল। আমি তাকে রহস্য করে ডাকি ত্রুস্ক, রাশিয়ান সাবমেরিন ত্রুস্ক, নাবিকদের নিয়ে সাগরে তলিয়ে যাওয়া ত্রুস্ক। রোমেলকে দেখলেই আমার কেন জানি তলিয়ে যাওয়া সাবমেরিনের কথা মনে হয়। সে পড়াশোনা করেছে রাশিয়ায়। রূপবতী এক রাশিয়ান মেয়েকে বিয়ে করেছে। মেয়েটি রাশিয়ার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। তাদের পুতুলের মতো একটা ছেলে আছে। রোমেল তার রাশিয়ান পরিবার নিয়ে পাবনায় বাস করছে।
মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ তার মাস্টার্স ডিগ্রি আছে, কিন্তু সে জীবননির্বাহ করছে পত্রিকা বিক্রি করে।
আখতারুজ্জামান রোমেল (ত্রুস্ক)।
বৃষ্টি ও মেঘমালা
মধ্য দুপুরে অতি দীর্ঘ মানুষের ছায়াও ছোট হয়ে যায়। অধ্যাপক তৌফিকুর রহমানকে। যার ছায়া কখনো ছোট হয় না।
তেঁতুল বনে জোছনা
অধ্যাপক হায়াৎ মামুদ। কিছু মানুষ আছেন যাদের দেখামাত্র মন আনন্দে পূর্ণ হয়, কিন্তু তারা যখন কাছে থাকেন না তখন তাদের কথা তেমন মনে পড়ে না। হায়াৎ ভাই সেই দলের আমার দেখা নিখুঁত ভালো মানুষদের একজন।
পারুল ও তিনটি কুকুর
কাকলী প্রকাশনীর নাসির আহমেদ
এবং সময় প্রকাশনীর ফরিদ আহমেদ
এরা দুজনেই জানে না এদের আমি কি পরিমাণ পছন্দ করি। একদিন হুট করে মরে যাব, আমার ভালোবাসার কথা এরা জানবে না। তা তো হয় না। কাজেই এ উৎসর্গপত্র।
ভূত ভূতং ভূতৌ
ছোট্ট বন্ধুরা, তোমাদের কি কখনো এমন হয় যে কোনো একজন কে খুব ভালো লাগে, কিন্তু কখনো মুখ ফুটে ভালোলাগার কথাটা বলতে পার না? আমার প্রায়ই হয়। আমার এমন একজন ভালো লাগার মানুষ হচ্ছেন ছোট মির্জা আসাদুজ্জামান নূর। মুখ ফুটে তাকে এ কথা বলিনি। আজ বললাম। ছোটদের এ বইটি তার জন্য।
জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল হাইস্কুল
সাজ্জাদ শরীফ
ভাই, বঙ্গদেশীয় ‘ইনটেলেকচুয়েলদের’ ব্যাপারে আমার এলার্জি আছে। এদের সহ্য হয় না। আপনাকে কেন সহ্য হলো এবং সহ্য হতে হতে কেন পছন্দ হয়ে গেল বুঝতে পারছি না। আমার পছন্দের ব্যাপারটি কাগজপত্রে থাকুক এ ভেবেই উৎসর্গ লিপি।
দেখা না-দেখা
নিশাদ হুমায়ূন, তুমি যখন বাবার লেখা এ ভ্রমণ কাহিনী পড়তে শুরু করবে তখন আমি হয়তো বা অন্য এক ভ্রমণে বের হয়েছি। অদ্ভুত সেই ভ্রমণের অভিজ্ঞতা কাউকেই জানাতে পারব না। আফসোস!
বাদশাহ নামদার
নিনিত হুমায়ূন
আমার কেবলই মনে হচ্ছে পুত্র নিনিত পিতার কোনো স্মৃতি না নিয়েই বড় হবে। সে যেন আমাকে মনে রাখে এই জন্য নানান কর্মকাণ্ড করছি। আমি ছবি তুলতে পছন্দ করি না। এখন সুযোগ পেলেই নিনিতকে কোলে নিয়ে ছবি তুলি। এ বইয়ের উৎসর্গপত্রও স্মৃতি মনে রাখা প্রকল্পের অংশ।
আমার প্রিয় ভৌতিক গল্প
আমার তিন কন্যা বিপাশা, শীলা, নোভা।
এরা ভূত বিশ্বাস করে না, কিন্তু ভূতের ভয়ে অস্থির হয়ে থাকে। প্রায়ই দেখা যায় তিন কন্যা ঠাসাঠাসি করে এক বিছানায় ঘুমুচ্ছে, কারণ কেউ একজন ভয় পেয়েছে।

 
Electronic Paper