ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

সেই নদীটা

আনোয়ার রশীদ সাগর
🕐 ৬:৩৫ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ২৭, ২০১৯

আজিজ মাস্টার ভোরের আলোয় মেঠোপথ ধরে হাঁটে। হয়তো রাতে হালকা বৃষ্টি হয়েছে, সজনে ফুলঝরা সকাল সেটাই যেন বলছে। মিষ্টি ও আবেগঘন আবহাওয়া, কুসুম-কুসুম ওম-ওয়ালা বাতাস, শরীরে স্পর্শ করে কোথায় যেন হারিয়ে যায়। অথচ ওই বাতাসের মিষ্টি সাধ নলির মধ্যে বা কণ্ঠনালিতে লেগে থাকে। লেগে থাকে শরীর ও মনে। দেখতে দেখতে সে বুড়ো হয়ে যায়! মনে হচ্ছে, ক’দিন আগেই সে বিয়ে করেছিল।

দেখতে দেখতে বাসরঘর যুবতী বউ সব, সব স্মৃতি হয়ে যায় তার কাছে। শিক্ষকতা করে মাত্র পাঁচ টাকা বেতন পেত, তাই দিয়ে অতি কষ্টে, দুটি ছেলে ও একটি মেয়েকে লেখাপড়া করিয়েছে। তারাও উচ্চশিক্ষিত হয়ে, একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, একজন বড় কোম্পানিতে চাকরি করে, অনেক বেতন পায়। মেয়েটাও শিক্ষকতা করে। এবার মেয়ের কথা মনে হতেই মনটা বিগড়ে যায়। মেয়ে তো নয়, যেন আস্ত এক কলাগাছ সে। যে মেয়েকে এত স্নেহ, এত ভালোবাসা দিয়ে মানুষ করেছে, সে মেয়েই বৃদ্ধ বাবাকে বোঝে না, কী একগুঁয়েমি মেয়ে গো!

মেয়ে শিক্ষকতা করে, এ কথা মানতে নারাজ আজিজ মাস্টার। মনে মনে বলে, রোমেলা খাতুন চাকরি করে-মাস্টারির চাকরি, সে শিক্ষকতা করে না। বোধহয়, এখনকার প্রায় সব ছেলেমেয়েই মাস্টারির চাকরি করে, কেউই শিক্ষকতা করে না। পাঁচ টাকা বেতনের আজিজ মাস্টারের ছিল আদর্শ এবং মূল্যবোধ। মনে মনে আজিজ মাস্টার অহংকার করে। এখনকার মাস্টারদের কোনো আদর্শ নেই। ঘণ্টা ধরে সময় কাটায়। আর তখন সকলেই শিক্ষকতা করত, ছাত্র-ছাত্রীদের আদর্শবান ও দেশদরদী করে গড়ে তুলত। এখন তো শিক্ষকদেরই কোনো আদর্শ বা দেশপ্রেম নেই, তারা যায় আর আসে। ডাক্তারদের মতো প্রাইভেট প্র্যাক্টিস নিয়ে ব্যস্ত থাকে।

তিনি প্রায়ই তার প্রিয় ছাত্রদের বলতেন, শিক্ষকতা মহান পেশা। যে পেশার মানুষকে বংশ পরম্পরায়, এলাকার মানুষ মনে রাখে। ভালো শিক্ষকের কথা, বাবা-মা তার ছেলেমেয়ের কাছে গল্প করে শোনায়। আবার তার ছেলেমেয়েরা ছেলেমেয়েদের কাছে ভালো শিক্ষকের কথা শোনায়। এর চেয়ে ভালো পেশা কি পৃথিবীতে আছে!

আজিজ মাস্টার গাঁয়ের মেঠোপথ ধরে, নদীর ধারে যেতে যতে মনে মনে নিজে নিজে, নিজের কথা বলে। কিন্তু নদীর ধারে গিয়ে, চোখ পড়ে, স্নানরত কোনো এক নববধূর দিকে। লাল ব্লাউজে, কালো শাড়িতে ঢাকা ভেজা শরীরে, ডুব দিয়ে, উঠে মৃদু পা ফেলে আজিজ মাস্টারের প্রায়ই শরীর ছুঁয়ে, চলে যায় মেয়েটি। কেমন যেন মাতোয়ারা এক ঘ্রাণ তাকে ঘিরে ধরে। বয়স্ক বা বৃদ্ধ আজিজ মাস্টারের মনে কষ্টের বন্যা বয়ে যায়।

মেয়েটির পায়ের দিকে চোখ পড়তে-পড়তেই বুকের মধ্যে টান-টান ব্যথা করে ওঠে। ধবধবে গোলাপি ফর্সা পা দুটো আড়াল হয়ে যায়। আড়াল হয় না আজিজ মাস্টারের মন থেকে। তারও এক সময় যৌবন ছিল, প্রেম ছিল, ভালোবাসা ছিল, সুন্দরী একখান বউ ছিল। কী থেকে কী হয়ে যায়, হঠাৎ বউটা মারা যায়। হুড়মুড় করে চলন্ত জীবনের রেলগাড়িটা ভেঙে-চুরে পথ হারায়।

সে পথ আর উদ্ধার হয় না। পুরুষ মানুষ জোরে-জোরে গলা ছেড়ে, যদি একবার চিৎকার করে কাঁদতে পারত, তাহলে হয়তো পাতলা হতে পারত, বুকের যন্ত্রণা বুকের মধ্যে সারাক্ষণ মোচড় দেয়, শিলাবৃষ্টির মতো ঠুকরে-ঠুকরে পড়ে টিনের চালে।

বুনো বাতাস বয়, পূর্ব আকাশে লাল সূর্য ওঠে। আজিজ মাস্টারের মনে পৌরুষত্ব জেগে ওঠে। কিন্তু মেয়ে-জামাই অথবা বড় ছেলে হতাশার কথা শোনায়। তারা সাফ-সাফ বলে দেয়, আমার মায়ের জায়গায়, মায়ের ঘরে, অন্য কোনো মেয়ে আসতে পারবে না- থাকতেও পারবে না।

আহ্হা কষ্ট! এ বৃদ্ধ আজিজ মাস্টারের কষ্ট, কেউ বুঝল না। না গাঁয়ের লোক, না আত্মীয়-স্বজন। ছেলেমেয়েরা তো বলেই দিয়েছে, বুড়োকালে আব্বার বিয়েটিয়ে করা দরকার নেই, আমরা সবাই মিলে তাকে দেখাশোনা করব। হায় জীবন, ছেলেমেয়েরা কি সব চাহিদা পূরণ করতে পারে? পারে বৃদ্ধ বয়সে তার মনের কথা শুনতে!

জীবনানন্দ দাশের কবিতার কথা মনে পড়ে। অল্প অল্প করে, ঠিক সবটুকু মনে করতে পারে না। শুধু মনে হয়, দু’দণ্ড শান্তি...। কিন্তু কোথায় শান্তি বা স্বস্তি, হায় শান্তি! আফসোস হয় তার।

কীভাবে, কোন আদর্শে ছেলেমেয়ে মানুষ করলাম! তারা তো, তাদের নিয়েই ব্যস্ত? আজিজ মাস্টার নদীর ধার দিয়ে হাঁটে আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। চিন্তায় মাথার মধ্যে আগত বসন্তের সাদা-কালো-ছায়া রঙের মেঘ ভেসে যায়।

এলাকার একমাত্র ছেলে আজিজ মাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করত। শহর থেকে বাড়ি এলে, গ্রামের মানুষ দেখতে আসত। ফর্সা চটপটে চেহারার আজিজ মাস্টার এ এলাকার ছেলেমেয়ে ও অভিভাবকদের আদর্শের প্রতীক ছিল, বিশাল আকাশের একমাত্র চাঁদ। এই তো সেদিনের কথা- গ্রামের বড় গৃহস্থ বাড়ির বড় ছেলে আজিজ মাস্টার। কোনো কিছুর অভাব ছিল না।

বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ পরিচয় হয় সুরভীর সঙ্গে। যেমন লম্বা, পিঠ থেকে পা পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা চুল, গোলাপি গায়ের রঙ, ঝলমলে সোনালি-নীল চোখ। আজিজ মাস্টার সেদিন চোখ ফেরাতে পারেনি। পিছু নেয় সুরভীর। হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় বিহারিপাড়ায়। একদিন-দুদিন হতে হতে সপ্তাহ-মাস হয়ে যায়। তারপর ধীরে ধীরে সুরভীও আজিজ মাস্টারকে ফলো করে এবং বিনিময় হয় চোখ ও মনের।

বিহারি মেয়ে। স্বাধীনতার পর লড়াই করে, বিহারিরা শহরে টিকে আছে। অভিভাবকরা বড়ই সাহসী ও দুর্দান্ত বদমেজাজি। এরপরও আজিজ মাস্টার অর্থনীতিতে অনার্স পরীক্ষা দিয়েই, বেশ সাহস করে, সুরভীকে সঙ্গে নিয়ে পালিয়ে, গ্রামে চলে আসে। গ্রামের মা ও মেয়েরা সুরভীকে দেখে, তার রূপের প্রশংসায়, স্রোতের মতো কলকলিয়ে ছড়িয়ে দেয়, আজিজ মাস্টারের প্রেমের অনুকূলের বাতাস, দুজন যা মানিয়েছে রে বু, এক্কেবারে মদনকুমার আর রাজার মেয়ে। যেন বা পরীরা স্বপ্নে, পাখনায় করে, উড়িয়ে নিয়ে এনেছে।

কিন্তু এ বিয়ে মানতে নারাজ আজিজ মাস্টারের বাবা মজিবর রহমান। তার কথা- ছেলেকে পড়তে দিছি, বিহারি মেয়ি সঙ্গে আনতে বলিনি।
গাঁয়ের অনেক মানুষ অনেকভাবে বুঝিয়ে যখন হয়নি, তখন এলাকার চেয়ারম্যান সাহেব, নিজে তার বাড়িতে জায়গা করে দেয়, সুরভী ও আজিজ মাস্টারের জন্য।

তখনও আজিজুর রহমান আজিজ মাস্টার হয়নি। যখন গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠা করে, সে স্কুলে আজিজুর রহমান শিক্ষকতা শুরু করে, তখন থেকে ধীরে ধীরে আজিজ মাস্টার নামে পরিচিত হতে থাকে। দিন যায়, বছর যায়, আজিজ মাস্টার অভিভাবকদের কাছে পূজনীয় হয়ে ওঠে। একসময় বাবা মজিবর রহমানও তাদের ঘরে তুলে নেয়।

জীবনের বাঁকবদল হতে হতে আজিজ মাস্টার আজ, বড় একা হয়ে যায়। বাবা-মা দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে। ভাইয়েরা যার যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে রয়েছে।

এত কষ্ট করে, ছেলেমেয়ে মানুষ করেও কাউকে, সে শুভাকাক্ষী হিসেবে খুঁজে পাচ্ছে না। হাহাকার তার চারদিকে, বড়ই একা-নিঃসঙ্গ জীবন। হাঁটে আর ভাবে, যে নদীর ব্যাপক স্রোত ছিল, কলকাতা থেকে পালতোলা নৌকা নিয়ে মাঝিরা এসে, নদীর ধারে বসে থাকত, হো হো করে হাসত। তারা ব্যবসায়ী কাজে এসে, মাড়োয়াড়িদের সঙ্গে, তাদের গদি ঘরের পাশে বসে, তাস খেলত। তারা আর আসে না, এ নদীপথে। কারণ নদী তার স্রোত হারিয়েছে।

নদীটার বুকের পানি শুকিয়ে গেছে। নদীর ধার কেটে কেটে গরিব কৃষকরা ধান লাগাতে থাকে, নদী তার গভীরতা হারাতে থাকে। আজিজ মাস্টার নিজের শরীরটাকে, খাখা শুকানো নদীর মতো, ভাবতে ভাবতে বসে পড়ে নদীর কিনারে...।

 
Electronic Paper