ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

অচিন বন্দরে নোঙর

ইমরুল কায়েস
🕐 ৩:০৯ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ২০, ২০১৯

ঐ কাইলা, যাও কই? গোফরা ডাক হাঁকে। কাইলার ভাবগতিক আগের মতোই। গোফরা ডাকের সাড়া না পেয়ে আবার হাঁকে।

কাইলা রে, ঐ কাইলা হুনছো? কাইলা এবার কিছুটা বিরক্তির সুরে মৃদু আওয়াজ দেয়। হুম, গোফরা কয়, তোর কি কানে বাজ পড়ছেনি?

গোফরা ডাকে- নাও ঘাটে ভিড়ায়ে এই হানে আহ। তোর লগে মোর বাচচিত আছে। তয় তুই ঐ হানে দাঁড়ায়ে থাহ। এই বলে কাইলা মাঝি আস্তে আস্তে তার ২০ বছরের ছোট নৌকাটি ফুলতলি ঘাটের দিকে ভেড়ায়। যে দিকটাতে মাঝিদের ছোট ছোট নৌকাগুলো সারি সারি বাঁধা আছে।

ফুলতলি ঘাটের এ একটি আলাদা ব্যাপার; ছোট নৌকার মাঝিদের নৌকার জায়গা হয় সবার পরে। ছোট নৌকাগুলোর সারি বাঁধা এ দৃশ্য আর নৌকাগুলোর পিঠের কালো রঙের দিক দেখলে দূর থেকে মনে হয় কালো কালো ভাসমান ময়লার ভেলা। পানির ঢেউয়ে দুলছে আর দুলছে।

কাইলা মাঝির আজকে এমনিতে মন খারাপ; দিনভর নৌকা নিয়ে নদীর বুক চিরে ছোটাছুটি করে কোনো ফল হয়নি; ঝুড়িতে সামান্য কিছু গুঁড়া মাছ ও পোনা মাছের প্রাপ্তি নিয়ে মন তার ভারী বিষণ্ন। এ ভাবনাতে সে নৌকা না ভিড়িয়ে ঘাটের অদূরে নদীতে স্থির বসে ছিল। ঐ সময় গোফরা মাঝি হাঁক ছাড়ে। কাইলা রে, ঐ কাইলা হুনছো?

গোফরা মাঝি কাইলার চেয়ে বয়সের ফারাকে খুব বেশি বড় নয়; কমজোর বছর দেড়েকের। এক বছরের বড় বলে গোফরার হাবভাব কাইলার প্রতি বড়ভাই সুলভ; কাইলা গোফরাকে ভয়ও পায় আবার খুব কাছের বন্ধুও ভাবে।

অন্য কোনো সময় একসঙ্গে না হলেও চিত্ত বিনোদনের রাতের সাথী দুজনে। রাতভর গাজীর পাঁচালী ও ছায়াবাণী নৃত্য দেখার অকৃত্রিম সঙ্গী দুজনে।

ফুলতলি ঘাট ধরে সোজা ডানের নদী পাড়ে কাদাময় নরম পথ ধরে বাদাম ক্ষেতের মধ্যিখান দিয়ে পথিক প্রবরের পা মাড়ানো পথ দিয়ে আধো আঁধার আধো পূর্ণিমার আলোতে দুজন খালি পায়ে হাঁটছে। হাঁটার তালে তালে তারা মুখে আকিজ বিড়ির সুখটানে দুজন হারিয়ে যাচ্ছে, ছায়াবাণী নৃত্যের নায়িকার আজকের কী দৃশ্য দেখবে, কী হবে? কোন গানের নৃত্যে নায়িকার কোন অঙ্গ বেশি দোলে; কোথায় ভাঁজ পড়ে, আর কে কত দৃশ্য-মধু চোখ দিয়ে শোষণ করে তার এক প্রস্থ লম্বা ফিরিস্তি আর গত সপ্তাহের ছায়াবাণীর নৃত্য নায়িকা চম্পাকলির অদৃশ্য সৌন্দর্যের মুখরোচক কামোউদ্দীপক বর্ণনা। এই তাদের পথে হাঁটার খোরাক। দীর্ঘপথ পাড়ি দেওয়ার উত্তম দাওয়াই।

ছায়াবাণীর জন্য স্থানীয় চেয়ারম্যান কদু মোল্লা তার চাষের চার বিঘা জমিতে জায়গা করে দিয়েছে। দিনের বেলা গেলে মনে হবে; দিনের সূর্যের রাজত্বে এখানে কোনো জনমানব নেই; কিন্তু এশার আজান হওয়া মাত্র ড্রামে এবং হারমোনিয়ামের লম্বা টানের সুরে নদীর স্থির জলের ঢেউয়ের সঙ্গে দু’পাশের অনেক দূর গ্রামের দারিদ্র্যপীড়িত কামক্ষুধার্ত পুরুষদের ঘরের বউয়ের কাছ থেকে এক ঝটকায় তুলে আনে চম্পাকলির আকর্ষণ। ছায়াবাণীর নৃত্যের স্টেজের সামনে।

গোফরা আর কাইলা বয়সের ফারাকে আলাদা। দুজনের একই কপাল; এই বিষয়ে দুজন-দুজনার সমব্যথী। কাইলার গত বছর সন্তান বিয়ানোর সময় স্ত্রী সন্তান দুজনেই মারা যায়। আর গোফরার স্ত্রী রাতের আঁধারে অন্য পুরুষের হাত ধরে পালিয়ে যাওয়া দুজনকে এই পূর্ণিমায় রাতে আকিজ বিড়ির সঙ্গে ধোঁয়া ও অতীত ঘটনা; চম্পাকলির পথে দুর্নিবার আকর্ষণ এক করেছে; এই পথ তাদের অতীতেও ছিল- সেই আদিম ও সত্য আকর্ষণ। দুজনে গভীর গল্পে হারিয়ে যায়। গোফরা বলে, কাইলা? হুম আজকে তো দেরি অইল।

চম্পার সামনে না বসলে তো তার সেই শুভ্র ও কোমল অঙ্গের চিনচিন রিনরিন নৃত্য দেখা যায় না। যা দুজনের দু’পথের নারী বিয়োগের কিঞ্চিৎ মনোক্ষুধা পূরণ করে তাই দুজনে পা চালিয়ে হাঁটে।

কাইলা বলে, দেরি তো অইল তোর লাগি রে গোফরা? তুই সন্ধ্যেবেলা ময়নালের বাড়ির পেছনের বাঁশঝাড়ের লুকিয়ে থাকস কেন?

গোফরা মৃদু হাসে। বলে, হ হ তোরে কইছে; মোর বাঁশঝাড়ে কী কাম?

‘তোর তো কাম সন্ধ্যেবেলা রোজ রোজ ময়নালের বউয়ের চৌকিদারি করা।’

‘সাবধান কাইলা!’

গোফরা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলে, ‘তোরে না কইছি আমার কাছে তেরামো করবি না; তুই তো মোর জিগরি দোস্ত। খবরদার আর কাউরে কইসস তো কিন্তু ঐ কমলার কথা নৌকার ঘাটে গিয়া মোরে মাইক নিয়া কইতে হইব না কিন্তু!’

কাইলা এবার পানি ছেড়ে দেওয়া কিসমিসের মতো চুপসে যায়। মনে মনে ভাবে গোফরা ময়নালের বউ কমলার দিকে প্রথম প্রথম আমারই আদিম বাসনা ছিল; আর অহন তুই বাঁশঝাড়ে। মনে মনে হিংসা করলেও নিজের গোপন কথা সামনে আসার ভয়ে আর ঠোঁট অবধি নিয়ে আসে না।

কাইলারে চুপ থাকতে দেখে গোফরা বলে, ‘কি রে কমলার নাগর? মুখে যে জোর নাই; কেমনে কি অইল কও দেখি হুনি।’

কাইলা আস্তে আস্তে বলে, ‘ময়নালের বউডার গতর ভারী ডাঁসা না রে! পেটওয়ালা ইলশার মতো চওড়া ও পেটানো না?’

গোফরা মুখে রাগ, মনে খুশি ভাব নিয়ে বলে, ‘হু তোরে সাবধান করছি কিন্তু; আমার কমলার দিহে বদখায়েশ করবি না। হুনশ কিন্তু...।’

গোফরা ধমকালেও কাইলা মনে মনে ভাবে, ঐ গতর তো মোর। এই জন্য তো বাঁশঝাড়ে দীর্ঘ ৫ মাস তয় নৌকা চালাচ্ছি; কিন্তু ঘাটও পাচ্ছি না যে, নৌকা ভিড়াবো। মনে মনে গোফরা কমলার পেটানো শরীরের দিকে হারিয়ে যায়। আর ভাবে, কবে, কীভাবে? তা তার হবে। হঠাৎ কাইলা হাত ধরে সজোরে ধাক্কা দেয়- ‘ঐ গোফরা, হুনছস! একটা কীসের যেন আওয়াজ। হাসপাস আর পরিচিত শব্দ।’

‘ঠিক কইছস তো কাইলা! একটু দাঁড়া তো দেহি, কোন দিক থাহি আওয়াজ।’

দুজনে মিনিট খানেক চুপ করে থাকে। শব্দের গতি ও মাত্রা বুঝে দিক নির্ণয় করে গোফরা বলে, ‘ডানে চল দেহি।’

দুজনে হাতের ডান দিক ধরে হাঁটা শুরু করে। মিনিট দশেক হাঁটার পরে দুজনের একসঙ্গে পা ফেলার শব্দ কমে যায়। দুজনেই অনুভব করে অস্বাভাবিক কিছু একটা। নর-নারীর শরীরের আদিম ক্রিয়া, জগতের অন্য সব কিছুকে ছাপিয়ে যায় চরাচরব্যাপী।

কাইলা বলে, ‘এই রাত নয়টা-দশটায় বাদাম ক্ষেতের মধ্যে কারা রে? শুধু মনে হচ্ছে গড়াগড়ি করছে। মনে হচ্ছে একটা বেডা আর মাগি। দেখ তো বাবড়ি চুল, আর আমাগো বগা মাঝির মতো না?’

‘ধুর, কাইলা। বগা এত রাতে এই হানত? আর ওর তো ঘরতান নতুন বউ।’

‘কস কী? গোফরা তুই কিন্তু মাথা ঠিক রাইখস।’ কাইলা ভালোভাবেই দেখতে পেয়েছে। বগার বুকের নিচে পরম আবেশে আলগোছ কাপড়ে একটি মহিলা শুয়ে আছে। আর জোরে জোরে জাগরণী নিঃশ্বাস নিচ্ছে। কাইলা দেখে এই তো ময়নালের বউ কমলা!

কাইলা যার কাছে তার কামনার নৌকা একসময় নোঙ্গর করতে চাইত। কাইলা ভয় পেয়ে যায়। গোফরার কথা ভেবে, গোফরাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় একটু দূরে। বলে, ‘এ তো দেহি তোর পীরিত চান কমলা!’

গোফরা বলে, ‘কস কী? সর দেহি।’

ততক্ষণে বগা আর কমলার আদিম খেলার এক পর্ব শেষ। দুজনে পরম আবেশে বাদাম গাছের সঙ্গে মিশে জড়াজড়ি করে শুয়ে আছে।

গোফরা তা দেখে হতবাক ও জড় হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। মনে মনে ভাবে- হায় কমলা, তোমার তরী এত দিন বাইলাম আর নোঙ্গর হইল বগার ঘাটে!

 
Electronic Paper