প্রকৃতির পর্বান্তর হেমন্তের হাওয়া
ফারুক সুমন
🕐 ২:২৫ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ১৫, ২০১৯
সময় ঋতুবর্তী হয়ে বয়ে যায় অবিরাম। বদলায় প্রকৃতি, বদলায় অভিযাত্রিকের মন। গ্রীষ্মের দাবদগ্ধ পথিক যেমন বর্ষার বর্ষণে সিক্ত হয়। আবার সেই সিক্ততার অনুভব নিয়ে বর্ষার পরে আসে শরৎ। শরৎঋতুর শারদীয় কাশবন আর সাদা মেঘের নন্দনে অবগাহন শেষে অভিযাত্রিকের তনুমনে হেমন্তের রিক্ততা জমা হয়। মাঠে মাঠে শিশিরসিক্ত কাঁচাপাকা ধান। কৃষকের কণ্ঠে ফসলের গান। অতঃপর শীত আসে ধূলিবসন নিয়ে। শুরু হয় পাতাঝরার হাহাকার। তাই নিয়ে মলিনবিধুর দিনযাপন শুরু হয় অভিযাত্রিকের। কখন আসবে বসন্ত? অপেক্ষার ইতি টেনে অবশেষে আসে বসন্ত। সবুজের সমারোহ আর বাহারি ফুলের বর্ণিল সাজ। এভাবেই ঋতুচক্রে চলে প্রকৃতির বিরামহীন পরিভ্রমণ। প্রকৃতিতে ঘটে পর্বান্তর।
কার্তিক ও অগ্রহায়ণ এই দুই মাস হেমন্তকাল। ঋতুর পালাবদলে প্রকৃতি পরে নেয় স্বতন্ত্র সাজ। শরতের শারদ আবহ ধীরে ধীরে অপসৃত হতে থাকে। বাংলার পথঘাট এবং জলহাওয়ায় আসে পরিবর্তন। আবহমান বাঙালি নারীর সিঁথির মতো চোখে পড়ে হেমন্তের বাঁকফেরা নদী। জল কমে যাওয়ায় দেখা দেয় নদীর কোমর। হেমন্তের ঈষৎ কুয়াশাসিক্ত বিকেল বেলায় মেতে ওঠে চিরায়ত গ্রামবাংলার চিরসবুজ কিশোরের দল। এভাবেই সন্তর্পণে প্রকৃতির কোলজুড়ে আশ্রয় নেয় ‘ঋতুকন্যা’ খ্যাত আদুরে হেমন্ত। যদিও বর্ষার জলজ জীবনের কিছু রেশ শরতেও বিরল নয়। তবে হেমন্ত তার ব্যতিক্রম। ‘না শীত, না গরম’ এরকম আবহ ধারণ করে দাঁড়িয়ে থাকে হেমন্ত। তথ্যমতে, কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাসের নাম রাখা হয়েছে ‘কৃত্তিকা ও আর্দ্রা’ এ দুটি তারার নাম অনুসরণে।
বর্ষায় বোনা ধান হেমন্ত ঋতুতে পরিপক্ব হয়। পাকা আমন ও আউশ ধানের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে চৌদিকে। পাকা ধানের গন্ধে কৃষকের মন পুলকিত হয়। শুরু হয় নবান্ন উৎসব। ফসল উৎপাদনের বিবেচনায় এক সময় হেমন্তঋতু কেন্দ্রিক বাংলা বছর শুরু হতো। এছাড়া অগ্রহায়ণ মাসের শব্দগত বিশ্লেষণে ফসল কাটার ইঙ্গিতময়তা লক্ষণীয়। যেমন- অগ্রথ ও হায়ণথ- এ দু’অংশের অর্থ যথাক্রমে ‘ধানথ ও কাটার মওসুমথ’। ফলে, অলক্ষ্যে হেমন্ত নিয়ে আসে আনন্দ-বারতা। কৃষিনির্ভর গ্রামীণ জীবনে হেমন্ত নিয়ে আসে সচ্ছল নির্ভার দিন। বাড়ির আঙিনাজুড়ে কনক আভাময় ধানের হাসি কৃষক ও কৃষাণির মনে অনাবিল আনন্দ স্রোত বইয়ে দেয়। প্রথম কাটা ধানের আঁটি আলাদা করে রাখা হয়। যাকে বলে ‘জেদ্দানি’ তোলা। প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই ধানের আঁটিকে ‘আগধান’ বলেও অভিহিত করা হয়। ‘জেদ্দানি’ কিংবা ‘আগধান’-এর চাল ঢেঁকিতে ছেঁটে গুঁড়া করা হয়। সেই গুঁড়ার সঙ্গে খেঁজুরের গুঁড় মিশিয়ে মজাদার পিঠা তৈরি হয়। নবান্নের আনন্দে নিকটাত্মীয়দের মধ্যে চলে নিমন্ত্রণ বিনিময়। হেমন্তে কৃষকের ব্যস্ত সময় কাটে। পাকা ধান গোলায় তোলার পাশাপাশি চৈতালি বা রবি ফসল বোনার কাজ শুরু হয়। তবে গ্রামীণ জীবনের ন্যায় নাগরজীবনে ঋতুর পর্বান্তরের প্রভাব পুরোপুরি আঁচ করা যায় না। নাগরিক ব্যস্ততায় ঋতুর স্বতন্ত্র সৌন্দর্য আড়ালেই রয়ে যায়।
হেমন্তের চাঁদনী রাতে কামিনী কিংবা ছাতিম ফুলের ঘ্রাণে মন ভরে যায়। এসময় সংবেদনশীল মানুষের মন স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ে। সুদূর অতীতের কোনো অজানা অধ্যায় হাতছানি দিয়ে ডাকে। আবেগাক্রান্ত মনে জেগে ওঠে নিঃসঙ্গ বালুচর, নেমে আসে রাজ্যের শূন্যতা। রাজ অশোক, শিউলি, গন্ধরাজ, মল্লিকা, হিমঝুরি, দেব কাঞ্চন এবং বকুলফুলসহ নাম না জানা ফুলে সেজে ওঠে প্রকৃতি। হেমন্তের শান্ত স্নিগ্ধ প্রকৃতি সংবেদনশীল কবিচিত্তে কিংবা শিল্পী-সাহিত্যিকের মনোভূমিকে ভাবালুতায় আচ্ছন্ন করে।
ভাববিহ্বল হৃৎমহলে হেমন্তের হাওয়া হানা দেয়। বোধকরি, হেমন্ত ঋতুর এই বিস্ময় জাগানিয়া অনুভব নিয়ে কবি সুফিয়া কামাল লিখেছেন : ‘সবুজ পাতার খামের ভেতর/হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে/কোন পাথারের ওপার থেকে/আনল ডেকে হেমন্তকে?’ হেমন্তে পল্লীজীবন ও প্রকৃতির নিখাদ রূপবৈচিত্র্য আভাসিত হয় জসীমউদদীনের কবিতায়- ‘সবুজ হলুদে সোহাগ ঢুলায়ে ধান ক্ষেত,/পথের কিনারে পাতা দোলাইয়া করে সাদা সঙ্কেত।/ছড়ায় ছড়ায় জড়াজড়ি করি বাতাসে ঢলিয়া পড়ে,/ঝাঁকে আর ঝাঁকে টিয়া পাখিগুলি শুয়েছে মাঠের পরে।/কৃষাণ কনের বিয়ে হবে হবে তার হলদি কোটার শাড়ি,/হলুদে ছোপায় হেমন্ত রোজ কচি রোদ রেখা-নাড়ি।’
প্রকৃতির পর্বান্তরের ভেতর দিয়ে মানুষ অব্যাহত রাখে তার অভিযাত্রা। জন্মলগ্ন থেকে এই অভিযাত্রিক অভিধাকে মান্য করে ক্রমাগত সবকিছু ছুটছে তো ছুটছেই। কোথায় ছুটছে? কিসের উদ্দেশ্যে, কোন আলোকবিন্দুর ইশারায় নিরন্তর এই ছুটে চলা? উদয়াস্ত এত খাটুনি? এর উত্তর এককথায় পাওয়া মুশকিল। এই জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজতে গেলে দুর্বোধ্য এবং দুর্জ্ঞেয় দার্শনিক প্রশ্নের গহ্বরে পড়ে যেতে হয়। কখনো কখনো ব্যক্তিজীবন স্থবির কিংবা অচল মনে হলেও প্রকৃতি সচল রয় আপন অভীপ্সায়। কারণ ব্যক্তিজীবনের স্থবিরতা কখনোই বৃহত্তর জীবন ও প্রকৃতিকে স্থবির করতে পারে না। গতিশীলতাই প্রকৃতি ও জীবনের আরাধ্যদেবতা। প্রকৃতির পরতে পরতে রয়েছে স্বতন্ত্র পর্বান্তর। ঋতুর এই পর্বান্তর, গতিশীল অভিযাত্রারই বৈচিত্র্যময় রূপ।
এভাবেই ঋতুচক্রের বৈচিত্র্যের পরিক্রমায় ভর দিয়ে মানুষ অতিক্রম করে নির্দিষ্ট আয়ুরেখা। সীমাবদ্ধ জীবনযাত্রায় মানুষের অবলম্বন আসলে কী? এমন প্রশ্ন চকিতে উদয় হয় পথিকের মনে। কখনো কোলাহল, কখনো নীরবতাই অভিযাত্রিকের একান্ত চলন; বিশেষ অবলম্বন। চলতে চলতে আচমকা থেমে গিয়ে পরক করে নেয় তার ডানার বিস্তার। কতটা আকাশ উড়ে এসে কতটা খসে গেছে ডানার পালক। কিছুটা খসে যাওয়া ডানার শোকে মুহ্যমান মনমরা পথিক আবারো মনোবল সঞ্চয় করে। পুনরায় শুরু হয় তার অভিযাত্রা। প্রকৃতি ও বস্তুজগতের নানাবিধ বূহ্য ভেদ করে অগ্রসরমান জীবনই অভিযাত্রিকের আকাক্সক্ষা। জীবনের দায়ভার কাঁধে নিয়ে ঘর্মাক্ত মুখাবয়ব যেন অভিযাত্রিকের পরিশেষ আনন্দ। অনাগত অজানার অন্বেষায় কী এমন ঘোর আছে, যা অভিযাত্রিকের বোধকে অবশ করে রাখে? আমন্ত্রণ জানায় অন্তহীন অভিমুখে? এসব জিজ্ঞাসা ঋতুর পর্বান্তরে খুঁজে নিতে হয়।
জীবনপলাতক হয়ে কিংবা জীবনবিমুখ হয়ে যিনি বিপরীত স্রোতে পাল তোলেন। তারও অভিমুখ আছে, আছে গন্তব্যের তাড়া। ভিন্ন পথের এই সারথি, এই অভিযাত্রী খুঁজতে চান স্বতন্ত্র কোনো উৎসদেশ। ঋতুর পর্বান্তর আমাদের সেদিকেই ধাবিত করে।