প্রাচ্য-চিত্রকলা : স্বভাবে স্বরূপে
মলয় বালা
🕐 ১১:০২ পূর্বাহ্ণ, নভেম্বর ০৮, ২০১৯
জয়নুল গ্যালারিতে বার্ষিক শিল্পকর্ম প্রদর্শনী ৩০ অক্টোবর শুরু হয়েছে, শেষ হয়েছে ৫ নভেম্বর কসমস গ্যালারির প্রদর্শনী সদ্য প্রয়াত শিল্পী কালিদাস কর্মকারকে (১৯৪৬-১৯০৯) উৎসর্গ করা হয়েছে প্রদর্শনীটি ২২ অক্টোবর শুরু হয়েছে, দর্শকদের জন্য খোলা থাকবে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত।
পরম্পরা চিত্ররীতির অনুবর্তন, রেখার প্রাধান্য, দ্বিমাত্রিকতা, সরলীকরণ, বহুকৌণিক দৃষ্টিকোণ, প্রতীকের ব্যবহার, অভ্যন্তরীণ অভিব্যক্তি, আধ্যাত্মিকতা, অলংকরণধর্মিতা, ঐতিহাসিক ও পৌরাণিক কাহিনীনির্ভর, ধর্মীয় বিষয় প্রধান প্রভৃতি বৈশিষ্ট্য প্রাচ্য-চিত্রকলার মূল বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এছাড়া চিত্রে ভারতীয় ও চীনা সুরঙ্গের গুণাবলি বজায় থাকে। পৃথিবীর পূর্ব-দেশীয় বিশেষত ভারত উপমহাদেশ, পারস্য এবং চীন ও জাপানি ঐতিহ্যবাহী শিল্পধারার বৈশিষ্ট্যের মধ্যে এসব গুণবৈশিষ্ট্যের একটা ঐক্য লক্ষণীয়। উল্লেখিত চিত্রজ বৈশিষ্ট্যগুলোর কারণেই পাশ্চাত্য চিত্রকলা থেকে প্রাচ্য-চিত্রকলা স্বাতন্ত্র্য।
বাংলার চিত্রকলার ঐতিহ্যিক প্রেক্ষাপট মূলত ভারতীয় উপমহাদেশের চিত্রকলা। অতীতকাল থেকে লোকজ ও দরবারি ঘরানায় ভারতীয় উপমহাদেশে চিত্রকলার বিস্তার ঘটেছে। দরবারি হোক আর লোকজ হোক উল্লেখিত বৈশিষ্ট্যগুলোর এক বা একাধিক বৈশিষ্ট্য এসব চিত্রে খুঁজে পাওয়া যায়। অতএব অজন্তা, পাল, মোগল, কালিঘাট প্রভৃতি ঘরানার চিত্রকলার রীতি-বৈশিষ্ট্যৈর সঙ্গে পাশ্চাত্য প্রাতিষ্ঠানিক চিত্ররীতির বিষয়, আঙ্গিক, মাধ্যম ও করণকৌশলে সুনির্দিষ্ট পার্থক্য সুনিশ্চিত।
উপনিবেশিক যুগে ভারতসহ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে যখন ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর শাসন চলছিল, তখন ওইসব শাসকশ্রেণির নিজস্ব শিল্প-সংস্কৃতি ও জীবনধারা থেকে এশীয় জনগোষ্ঠীর শিল্প-সংস্কৃতি ও জীবনধারাকে পৃথকভাবে নির্ণয় করার জন্য প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য বিভক্তকরণ মতবাদের সূত্রপাত। ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনামলে তাদের প্রয়োজনে প্রাতিষ্ঠানিক চিত্রচর্চার শুরু করেন পাশ্চাত্য প্রাতিষ্ঠানিক ধারায়। পরবর্তী সময়ে কলকাতা গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলকে কেন্দ্র করে নব্য-বেঙ্গল স্কুলের সূচনা হয়।
তারই ধারাবাহিকতায় কলকাতা আর্ট স্কুলের ‘ইন্ডিয়ান আর্ট’ বিভাগের আদলে ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচ্যকলা বিভাগের কোর্স কারিকুলাম শুরু হয়।
বাংলাদেশের পাশ্চাত্য একাডেমিক শিল্প শিক্ষায় শিক্ষিত শিল্পীরা এবং এদেশের স্বশিক্ষিত শিল্পীরা কোনো-না-কোনোভাবে প্রাচ্য চিত্রকলার মূলনীতি বা উপাদান নিজেদের চিত্র চর্চায় ব্যবহার করে আসছেন। তবে বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক চর্চায় ‘প্রাচ্যকলা বিভাগ’ প্রাচ্যের চিত্ররীতির মূলনীতি বজায় রেখে চিত্রশিক্ষা দিয়ে আসছে। যদিও প্রাতিষ্ঠানিক চর্চায় বৃহৎ প্রাচ্যের অর্থাৎ দূরপ্রাচ্য ও মধ্যপ্রাচ্যের চিত্র বৈশিষ্ট্যের উপাদান তেমন একটা চর্চা করানো হয় না। বরং পাশ্চাত্যের প্রাতিষ্ঠানিক এবং পাশ্চাত্যের রেনেসাঁ পরবর্তী সময়ের মতবাদগুলোর সংমিশ্রণে চিত্রকলায় একটা ভিন্ন ধরার নান্দনিকতা লক্ষণীয়।
সম্প্রতি কসমস গ্যালারির ‘প্রাচ্যের প্রাচীন ধারা’ এবং জয়নুল গ্যালারিতে প্রদর্শিত প্রাচ্যকলা বিভাগের ‘বার্ষিক শিল্পকর্ম প্রদর্শনী ২০১৯’ শীর্ষক প্রদর্শনীর কাজ বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশের সমসাময়িক প্রাচ্যচিত্র চর্চার গতিপ্রকৃতি অনুমান করা সম্ভব।
কসমস গ্যালারির নির্বাচিত ২৫ শিল্পীর ২৪ জনই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রাচ্য-চিত্রকলায় দীক্ষিত। এদের মধ্যে প্রাচ্যকলা বিভাগের শিক্ষকগণের কাজে সমকালীন গবেষণা নেই বললেই চলে। শিল্পী নাসরীন বেগম এ পর্যন্ত যেসব প্রাচ্য ধারার নিরীক্ষাধর্মী চিত্র এঁকেছেন, এই প্রদর্শনীতে সেরকম মানের দৃষ্টান্ত মেলে না। তবে অমিত নন্দীর কাজে ঐতিহ্যবাহী চিত্ররীতির সমকালীন পুনরপাঠ লক্ষণীয়। তার চিত্রের শিরোনাম ‘সাগা অব মিথিক্যাল হেরিটেইজ’।
এলহাম হক খুকু, নাসিমা খানম কুইনি, দিলরুবা লতিব রোজীর কাজে পাশ্চাত্য রীতির করণকৌশলের প্রাধান্যে সমকালীন পাশ্চাত্য ঘরানার চিত্রের সঙ্গে আলাদা তেমন বৈশিষ্ট্যে পার্থক্য করা যায় না। শেখ নাজমুল হক বাপ্পি ‘বিউটি অব নেচার’ শীর্ষক কাজে চায়নিজ ট্রেডিশনাল পেন্টিংয়ের অনুবর্তন দেখিয়েছেন। তরুণ প্রজন্মের শিল্পীদের মধ্যে সামিনা জামান ও ফাহমিদা হক মাহি’র কাজে প্রাচ্যরীতির অনুশাসন এবং সমসাময়িক দৃষ্টিভঙ্গির নিরীক্ষা প্রশংসনীয়।
জয়নুল গ্যালারির প্রদর্শনীতে নাহিদ জাহান নাবিলা, পূর্ণিমা আক্তার, সৌরভ ঘোষ, শৈলী শ্রাবন্তী, শাহানাজ আক্তার, একরাম উল্লাহ জুবায়ের বিন আজিম ও গোলাম উল্লাহ নিশানের কাজে রয়েছে প্রাচ্য ধারাকে এগিয়ে নিতে সাম্প্রতিক গবেষণার ছাপ। প্রাচ্য রীতির মৌলিক অনুশীলনের জায়গা থেকে হাবিবা ইসলামের গাছের গুঁড়ির কম্পজিশন ও মারিয়া মিমের ফিগারেটিভ কাজ নিশ্চয়ই সকল চিত্রকলা থেকে আলাদা করেছে। শিক্ষানবিস এই শিল্পীদের কাজ আমাদের অবশ্যই আশা জাগায়।
আরও আশা জাগায় পাশ্চাত্য ধারায় শিক্ষিত না হয়ে যে সব শিল্পী প্রাচ্যধারার নানা উপাদান তাদের চিত্রকর্মের ব্যবহার করে একটা নতুন নান্দনিকতা দাঁড় করাচ্ছেন। লাইলি লায়লা মনসুর, সৌরভ চৌধুরী, জাহাঙ্গীর আলমসহ বাংলাদেশের আরও অনেক শিল্পীর কাজই উদাহরণ হিসেবে বলা যায়। ভবিষ্যতে প্রাচ্য দর্শন ও চিত্রাঙ্কনের বৈশিষ্ট্যগুলো বাংলাদেশি শিল্পকলাকে স্বতন্ত্র করবে বলে আশা করা যায়। সর্বোপরি, জয়নুল গ্যালারির প্রাচ্যকলা প্রদর্শনী আমাদের জন্য স্মরণযোগ্য, কারণ এই প্রদর্শনীতে তরুণ প্রজন্মের শিল্পীদের নিরীক্ষাধর্মী কাজ প্রাচ্য চিত্রকলার স্বভাব ও স্বরূপকে যথার্থই গতিশীলতা দিয়েছে।