ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

স্পন্দমান দিনগুলোর দুঃস্বপ্ন

নাজমুল হাসান পলক
🕐 ৩:০১ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ০১, ২০১৯

কবিতা কেবলমাত্র অন্তঃপ্রেরণা সঞ্জাত নয়- এ কথা আদ্যোপান্ত বিশ্বাস করতেন সমর সেন। কবিতার বিশুদ্ধতায় তিনি ছিলেন আস্থাহীন; ভাবনায় জানিয়েছেন- কবিতা বিশুদ্ধ কল্পনা নয়, পরিবর্তনশীল এবং সার্বিক অর্থে স্থান, কাল, পাত্রের মুখাপেক্ষী। সমর সেনের কবিসত্তার দুটি প্রধান প্রান্ত রয়েছে; বহির্জগত এবং সমাজ পরিস্থিতি, তিনি এটিও মানতেন- কবিতার মাধ্যমে সমাজের পরিবর্তন সম্ভব। এ প্রসঙ্গে সমর সেনের আবির্ভাবকাল বিস্মৃত হলে চলবে না।

গত শতাব্দীর তিরিশের দশকের প্রথমপাদে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা প্রকট করে তুলেছিল পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সংকটকে; যে সংকট থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার অভিপ্রায়ে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল ধনতান্ত্রিক প্রতিভূরা। বৈশ্বিক পরিস্থিতির সমান্তরালে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ঘটনাক্রমও বাঁক পরিবর্তন করছিল বিভিন্ন অভিমুখে। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতিও এসব ঘটনার প্রভাববঞ্চিত ছিল না। এক্ষেত্রে, তিরিশের প্রধান কবিরা আবির্ভূত হচ্ছিলেন রবীন্দ্রনাথকে বাতিল করে; আবার, তাদের কাব্যভাবনা চূর্ণ করে যেসব কবি বেরিয়ে আসেন- সমর সেন তাদের অন্যতম এবং বিশিষ্ট।

কাব্য রচনায় তিনি ভাষার ব্যক্তিগত ও স্বতন্ত্র ব্যবহারের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছিলেন- ‘আমরা কোনো বিশেষ সমাজে, বিশেষ সময়ে জন্মাই এবং সামাজিক জীব হিসেবে প্রচলিন কোনো ভাষা ব্যবহার করি। কিন্তু কবিতা লেখার সময় সে ভাষার উপরে যে স্বতন্ত্র ছাপ পড়ে তার নাম ডিকশন এবং এই স্বতন্ত্র ব্যবহারের শক্তি কবির পুরস্কারের পরিচায়ক।’ অবশ্য, এটি সবাই স্বীকার করে থাকবেন যে কাব্যভাষা সর্বকালেই মৌখিক ভাষার তুলনায় স্বতন্ত্র, তবুও এর মাধ্যমে তার কাব্যভাব রচনার পরিচয় মেলে। সমর সেনের কাব্যরচনার পরিধি অত্যল্প- মাত্র এক যুগের; ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৬ কাল পরিসরে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা পাঁচ।

সমর সেনের কবিতার প্রতি দৃষ্টি দিলে প্রত্যক্ষ করা যায়- যে সমাজে তিনি বাস করেন সেখানে মানুষগুলোর জীবনযাপনের অভ্যস্ত কিছু মাত্রায় ঐক্য থাকলেও, তারা মৌলত পরস্পর বিচ্ছিন্ন। তাদের জীবন, যাপন, সমাজ, রাষ্ট্র সম্পর্কে রয়েছে নিরন্তর কৌতূহল এবং জিজ্ঞাসা; কিন্তু, অনুপস্থিত কোনো সদুত্তর, বা সদুত্তরের প্রাণপণ আকাক্সক্ষা। যাপনিক স্রোত, কালিক প্রবাহ হৃদয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করলেও বিচারবুদ্ধি এবং সিদ্ধান্তের প্রশ্নে এই মানুষেরা নিরন্তর দোদুল্যমান।

সমর সেনের কবিতায় এরা মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিনিধি। সমর সেন নিজেকেও বারবার চিহ্নিত করেছেন এদের সমগোত্রীয়, সমশ্রেণির বলে; তার একান্ত উচ্চারণ- ‘ব্যক্তিগত জীবনে নানা বিভ্রান্তি আসে। তবু সময় কেটে যেতে থাকে মধ্যবিত্ত পথে।’ অবশ্য, তার জীবনে এর প্রমাণ অদূর্লভ নয়, সমর সেনের জন্ম, পরিবর্ধন কলকাতার মধ্যবিত্তশ্রেণি পরিসর এবং প্রতিবেশে; এর বদৌলতে মধ্যবিত্তশ্রেণিকে একান্ত নিকট হতে পর্যবেক্ষণের সুযোগ ঘটেছিল তার। এই পর্যবেক্ষণেরই সুগভীর রূপ প্রকাশিত হয় তাঁর কবিতায়।

সমর সেন প্রত্যক্ষ করেছিলেন- সমাজে বিত্তবানশ্রেণির নিকটবর্তী হলেও, তাদের সঙ্গে মধ্যবিত্ত জীবনের যাপনিক বাস্তবতার দীর্ঘ ব্যবধান। এক বিবর্ণ, আলকাতরা আচ্ছন্ন কলকাতা প্রত্যক্ষ করে ‘নাগরিক’ কবিতায় তিনি লিখেছিলেন- ‘আর কত লাল শাড়ি আর নরম বুক, আর টেরিকোটা মসৃণ মানুষ/ আর হাওয়ায় কত গোল্ড ফ্লেকের গন্ধ,/ হে মহানগরী!’ প্রশ্ন রয়ে যায়- এই লাল শাড়িতে আবৃত কমনীয় বক্ষ, টেরিকোটা মসৃণ মানুষ, দামি গোল্ডফ্লেক কাদের জন্য? এর সরল উত্তর উচ্চবিত্তদের জন্য; আর, এখানেই কবি উন্মোচিত করেছেন উচ্চবিত্তের সঙ্গে তার চারপরশের যাপনিক ব্যবধান। সমর সেনের কাব্যে মধ্যবিত্তশ্রেণির যে মানচিত্র আমরা প্রত্যক্ষ করি, তা শুধুমাত্র সরলকথন বা জীবনের রূপায়ন নয়, তিনি এই শ্রেণির প্রতি দৃষ্টি দিয়েছিলেন সার্বিকভাবে এক বিশ্লেষকের মনোভঙ্গি নিয়ে।

প্রায় নয় দশক পূর্বে ‘কলকাতা’ শিরোনামের এক মুক্তগদ্যে বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন- ‘য়োরোপে দেখতে পাই প্রতিভাবান লেখকরা তাদের রাজধানীকে গভীরভাবে ভালোবেসেছেন এবং তাকে ফুটিয়ে তুলেছেন অপরিসীম যত্নে, নিপুণ রেখার পর রেখায়, রঙের পর পাকা রঙের ছোপে।’ সমর সেনও তার কবিতায় তুলে ধরেছেন কলকাতাকে, বিশেষত এর নাগরিক পরিসরকে। তবে, মহানগর কলকাতাকে নিয়ে তিনি কোনো কৃত্রিম রোমান্টিকতায় নিজেকে বিলিয়ে দেন নি; নগরীর বিবর্ণ, অর্থহীন জীবন প্রত্যক্ষ করে বাস্তবতাবিদীর্ণ কবি লিখেছেন- ‘মহানগরীতে এল বিবর্ণ দিন, তারপর আলকাতরার মতো রাত্রি/ আর দিন/ সমস্ত দিন ভরে শুনি রোলারের শব্দ,/ দূরে বহুদূরে কৃষ্ণচূড়ার লাল, চকিত ঝলক,/ হাওয়ায় ভেসে আসে গলানো পিচের গন্ধ;/ আর রাত্রি/ রাত্রি শুধু পাথরের উপরে রোলারের মুখর দুঃস্বপ্ন।’ তিনিই সার্বিক অর্থে বাংলা ভাষার প্রথম আধুনিক কবি, যিনি নাগরিক পরিসরকে তাঁর কাব্যের বিষয় করে তুলেছিলেন। কলকাতা শহরের অভ্যন্তর, তার চারপাশের ক্ষয় এবং বিকৃতি, তথা নাগরিক জীবনের হাহাকারকে নিদারুণ হৃদয়, মস্তিষ্কে প্রত্যক্ষ করেছিলেন সমর সেন। তিনি দেখিয়েছিলেন কলকাতায় ফরাসি নগ্ন সিনেমার মোহে, ফিটন গাড়ির সামন্ত ইশারায়, চারপাশের চাকচিক্যের আলকাতরাময় অন্ধকারে কিভাবে হারিয়ে যায় শোষিত মানুষের অসীম আর্তনাদ। সমর সেন যে কলকাতায় বাস করতেন, তা ছিল অনেকটা শিল্পনগরীর তুল্য- যেখানে মানুষ আসে চাকুরি করতে, খানিকটা জীবন সংগ্রামে লিপ্ত হতে। এমন বাস্তবতাই তার কবিতায় ভাষা পেয়েছে।

সমর সেন যে যুগের কবি; বৈশ্বিক কবিতা তাকে পরিচিত করে তুলেছিল নৈরাশ্য, বিষাদ, বিচ্ছিন্নতা এবং অবক্ষয়ের যুগ বলে। বাংলা সাহিত্যও এর প্রভাববিবর্জিত থাকেনি- এখানে সমাজচেতনার বিষয়টি গভীর দৃষ্টি দাবি করে; সমাজে একদিকে ধণিকশ্রেণি, তাদের লোভ, অপরদিকে রয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠ শোষিত মানুষ এবং তাদের বঞ্চণা; বৈষম্যমূলক ব্যবস্থায় যেকোনোভাবে টিকে থাকার চেষ্টা। সমর সেনও পরিবর্ধিত হয়েছেন এমন পরিস্থিতিতে; উপলব্ধি করেছেন এই বাস্তবতা। প্রত্যক্ষ করেছেন এই ব্যবস্থার অবসান ঘটানোর মতো কিছু চারপাশে ঘটছে না; ফলে তিনিও ভুগেছেন নৈরাশ্যে, তার হৃদয় পূর্ণ হয়েছে বিষাদে, বোধ করেছেন বিচ্ছিন্নতা। এর ফলশ্রুতিতে মহানগর কলকাতার বিকার, বিচ্ছেদ, হাতাশা এবং ক্লান্তি রূপক-প্রতীকের আভরণে ধরা দিয়েছে তার কবিতায়- ‘অন্ধকারে শুনি কীসের বিবর্ণ পদক্ষেপ,/ আর কর্কশ হাসির স্রোত/ অকারণে অন্তর কাঁপে।’

কিংবা, কখনো প্রিয়ার চোখও কবিহৃদয়ে ধরা দিয়েছে বিষণ্নবদনে- ‘কান পেতে শুনি/ কোন সূদূরের দিগন্তের কান্না;/ সে কান্না যেন আমার ক্লান্তি,/ আর তোমার চোখের বিষণ্ন অন্ধকার।’ সমর সেন প্রথমজীবনে কবির থেকেও অধিক গুরুত্ব দিয়ে দেখেছিলেন তাঁর মার্কসিস্ট পরিচয়কে, বামপন্থার প্রতি নিবেদনকে। তবে, মধ্যবিত্তশ্রেণি পরিচালিত সাম্যবাদী আন্দোলনে তিনি আস্থা রাখতে পারেন নি; এখানেই তার সমকালের অপর বিশিষ্ট কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সমর সেনের কাব্যচেতনার পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। সমর সেনের সমকালে পরিচালিত সাম্যবাদী আন্দোলন সম্পর্কে বলা চলে- কোনো সৎ বিবেকবান কবিই অবক্ষয়িত মধ্যবিত্তশ্রেণি দ্বারা পরিচালিত ঐ সাম্যবাদী আন্দোলনের ওপর পূর্ণ আস্থা রাখতে সক্ষম হন নি। তিনিও এর ব্যতিক্রম নন; ফলে- অন্তরে অন্তরে অনুভব করেছিলেন নিঃসঙ্গতা, হতাশা, ব্যর্থতাবোধ।

তার কবি চেতনায় দেখা দিয়েছিল একটা অস্থিরতা। এই অস্থিরতাই তাকে টেনে নিয়ে গিয়েছে নিঃসঙ্গতার দিকে। ভারসাম্যহীন সমকাল, চারদিকের অবক্ষয়; ব্যক্তিত্বের বিপন্নতার মধ্যে কবি প্রত্যক্ষ করেছেন ঈশ্বর মৃতপ্রায়, প্রকৃতি নির্মম, সমাজ ব্যভিচারী, রাষ্ট্র কপট। ফলে-তার কবিতার মাধ্যমে তিনি তুলে ধরেছেন অবক্ষয়িত এক ব্যবস্থার ছবি। যে পৃথিবীতে জীবনের স্বপ্ন, কল্পনা, যাপন এবং সার্বিক সংগ্রাম ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

 
Electronic Paper